রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকাঃ সাহরি ও ইফতারে কী কী খাওয়া ভালো

রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার
রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার

রমজান মাস মুসলমানদের জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস, সিয়াম সাধনার মাস। রমজানে রোজা রাখতে অর্থাৎ সিয়াম পালন করতে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হয়। রমজানে সুস্থ, সবল থাকতে প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর ও কার্যকরী খাবার। সাহরি ও ইফতার হচ্ছে রমজানের মূল খাবার মুহুর্ত। অনেকেরই আগে থেকেই জানা আছে কী কী খাওয়া ঠিক আর কী কী ঠিক না। রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা: সাহরি ও ইফতারে কী কী খাওয়া ভালো- এই আলোচনায় একটু ভিন্ন ও নতুন কিছু জানতে পারবেন। 


সারাদিন রোজা রাখতে হলে সাহরি খাওয়া অত্যাবশ্যক একটি কাজ। সুবহে সাদিক অর্থাৎ শেষরাতে সাহরি খেতে হয়। সাহরি খাওয়ার মাধ্যমেই সারাদিন কাটাতে হয় রোজা রেখে। আপনি যদি সাহরিতে ঠিকঠাকভাবে না খান, তাহলে সারাদিন আপনার জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে। রমজানে যেসকল সমস্যা ও অসুস্থতাগুলো হয়ে থাকে-

  •  অনিদ্রা বা ঘুমের ঘাটতি
  • অবসাদ, ক্লান্তি, খিদে, পানিস্বল্পতা/ পানিশূন্যতা
  • হেডেক, মাংসপেশিতে ব্যথা।

রোজা রাখলে শরীরে কী কী প্রভাব পড়ে?

দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকায় শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি উৎপন্ন হতে পারে না। আপনি সাহরিতে যা যা খাবেন সেগুলোই আপনাকে সারাদিন শক্তি জোগাবে। আপনি রাতে বা সাহরিতে যা খাবেন, সেসব খাবার থেকে আপনার শরীরে কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate) ও চর্বি বা ফ্যাট ( Fat) জমা থাকে। 

যখন শরীরে শক্তি সরবরাহ কমে যায়, তখন জমা করে রাখা কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট থেকে ক্যালরি গ্রহণ করে শরীর শক্তি জুগিয়ে থাকে নিজে থেকেই। কার্বোহাইড্রেট মূলত শরীরের মাংসপেশি ও যকৃতে ( Liver) এ জমা হয়। কিন্তু শরীর নিজে থেকে পানি উৎপন্ন করতে পারে না। ফলে দীর্ঘসময় পানি শরীরে না পোঁছালে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।মূত্রের পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া পরিশ্রমের কাজ করলে পানি ঘাম হয়ে বেরিয়ে শরীরকে আরও পানিশূন্য করে তুলে। 


এই সমস্যা গুলো থেকে মুক্ত থাকতে হলে সাহরি ও ইফতারে খেতে হবে স্বাস্থ্যকর ও কার্যকরী খাবার, যাতে তা শরীরকে সুস্থ রাখে এবং স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

কী কী খাওয়া ভালো এবং কী কী খাওয়া ঠিক না তা সম্পর্কে এখন বলা হবে-

রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার

রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার

সাহরিতে যা খাওয়া ভালো-

রোজা শুরু করতে হয় সাহরি খেয়ে। আপনি যদি সাহরি না খান, তাহলে একটি ফজিলত পূর্ণ সুন্নাত আদায় করা থেকে বঞ্চিত হলেন। সেই সাথে সাহরি না খাওয়ায় আপনাকে সারাদিন খিদে, অস্বস্তি, পিপাসা, পানিশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সাহরি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার।


কী কী খাবেন?

সাহরিতে খেতে হবে উচ্চ শর্করা ( Starches) ও আঁশযুক্ত খাবার। আঁশযুক্ত খাবারগুলো খিদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দারুণ কার্যকর। রমজান ছাড়া অন্যান্য সময়ে দুপুরে ও রাতে যেসকল ভারী খাবার খান, সাহরিতে সেই খাবারগুলোই খেতে পারেন। সহজে হজম হয় এমন খাবারগুলো খাওয়া ভালো।

শর্করা যেমন- ভাত, রুটি, শাক-সবজি, বীজজাতীয় খাবারগুলো থেকে শর্করা ও আঁশ ( Fiber) পাওয়া যায়। আঁশযুক্ত খাবারগুলো  দীর্ঘসময় খিদের অনুভূতি নিবারণ করে রাখে। তাই সাহরিতে বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার খান। ফলমূল, শাক-সবজি বেশি করে খাবেন। 

ডিম, দুধ, মুরগির মাংস এই খাবারগুলো উচ্চ প্রোটিন ( Protein) সমৃদ্ধ খাবার। এই খাবারগুলো খিদের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখে। 

এক গ্লাস দুধ ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত খিদে থেকে মুক্ত রাখে অর্থাৎ এক গ্লাস দুধ খেলে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত খিদে লাগে না। এটা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। দুধ গ্লাসে করেও খেতে পারেন আবার চাইলে ভাত, চিড়া, কলা, আম দিয়ে মেখেও খেতে পারেন। 

একটি ডিম ২-৩ ঘণ্টা পর্যন্ত খিদে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। ডিমে থাকে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন। প্রতিদিন ১ টি করে ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী।

দই এমন একটি খাবার, যা আপনার পেটের শান্তি বজায় রাখে। দই খেলে খিদে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়, পানিশূন্যতা থেকে মুক্ত থাকা যায়, এবং পেটের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়। চেষ্টা করুন সাহরিতে অন্তত ১ চামচ হলেও দই খাওয়ার। দই আরও উপভোগ করে খেতে চাইলে দই ও চিড়া একসাথে মেখে খেতে পারেন। 

আপেল, কলা, অ্যাভোকাডো এই ফলগুলো স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। কারণ এগুলোতে ক্যালরি কম থাকে এবং বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান ও ভিটামিন থাকে যা আপনাকে অবসাদ, ক্লান্তি থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। কলাতে থাকে পটাসিয়াম ( Potassium), প্রাকৃতিক চিনি, শর্করা। কলা খেলে পাবির পিপাসা কম লাগে, খিদে কম অনুভূত হয়, শরীরে শক্তি সরবরাহ বাড়ায়। 

এছাড়াও মেজাজ/ মুড ভালো করতেও কলা ভূমিকা রাখে। আর আপেলের কথা তো জানেনই। প্রতিদিন একটি আপেল অনেক রোগ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। 


খেজুর শুধু ইফতারে না, সাহরিতেও খান। খেজুর কতটা উপকারী একটি খাদ্য, তা আল্লাহ'র রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন খেজুরের গুণাগুণ সম্পর্কে। খেজুরে থাকে পটাসিয়াম, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-৬, উচ্চমাত্রার আঁশ বা ফাইবার ( Fiber), মিনারেল ( Minerals) সহ আরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খেজুর রক্তচাপ ( Blood pressure) নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে, হার্টের বিভিন্ন রোগ ও কোলন ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে।  এছাড়াও খেজুর শরীর থেকে শক্তি সরবরাহ ঠিকঠাক রাখতেও ভূমিকা পালন করে। তাই সাহরিতে ২-৩ টি খেজুর খান।

এছাড়াও কাজুবাদাম, আখরোট খেতে পারেন। এগুলো অনেক কার্যকরী খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ খাবার, যা খিদে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক। 

সাহরিতে এই খাবারগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে খান, এসব খাবার আপনার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং সারাদিন রোজা সুস্থভাবে রাখতে সাহায্য করবে।


সাহরিতে যা যা খাওয়া ঠিক নয়-

রমজান মাস বরকতময় মাস। রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে রোজার পবিত্রতা রক্ষা করতে সহজ হয়।

  • গরু,মহিষের মাংসে কোলেস্টেরল (Cholesterol) থাকে, যা সবার জন্য ভালো না। তাই গরু,মহিষের মাংসের মতো অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার কম খাওয়া ভালো।
  • ডাল না খাওয়ায় ভালো। কারণ ডাল খেলে হজমে সমস্যা হয়ে থাকে। 
  • ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন- চা, কফি সাহরির সময় খাবেন না। এসব পানীয় পান করলে ঘনঘন প্রস্রাব করতে যেতে হবে যার ফলে পানিশূন্যতার হার বেড়ে যায়। তাই সাহরির সময় এসব পানীয় খাবেন না। 

জাঙ্কফুড বা অধিক মশলাযুক্ত খাবার সাহরিতে না খাওয়া ভালো। কারণ, মশলাদার খাবার ঘনঘন পানির পিপাসা লাগায় যা পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে। আর চিনিযুক্ত বা মিষ্টিজাতীয় খাবারও না খাওয়া ভালো। কারণ, মিষ্টিজাতীয় খাবার তাড়াতাড়ি খিদে লাগায়। রোজায় সারাদিন পিপাসা ও খিদে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে জাঙ্কফুড ও মিষ্টিজাতীয় খাবার না খাওয়া-ই ভালো। মিষ্টিজাতীয় খাবারের পরিবর্তে বেশি করে ফলমূল খাওয়া ভালো, যা পানিশূন্যতা রোধ করতে উপকার করবে।


ইফতারে যা খাবেন-

সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার প্রয়োজনীয় ও অনেক বরকতময় খাবার মুহুর্ত। সুস্থ থাকতে রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। কেননা, খাওয়ার সময়ের পার্থক্য হওয়ায় নতুন রুটিন মোতাবেক চলতে হয় এই মাসে।


কী কী খাবেন? 

অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত আঁশযুক্ত খাবার এবং লবণাক্ত খাবার ইফতারে না খাওয়া সবচেয়ে ভালো। কারণ, এসব খাবার খেলে কিছু সময়ের মধ্যে আপনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন যেমন- ক্লান্তি, হজমে সমস্যা, পেটে ব্যথা, বমি । ইফতারে খেতে হবে সহজপাচ্য খাবার। কারণ সারাদিন না খেয়ে থাকায় শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তি দিতে হয় তখন। তাই এই সময় অতিরিক্ত চর্বি, চিনি, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া ঠিক না। 


খেজুর দিয়েই সাধারণত সবাই ইফতার খাওয়া শুরু করে। খেজুর খান ইফতারে। খেজুরের গুণাগুণ সম্পর্কে উপরে বলা হয়েছে। 

তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আগে খেজুর খান, পানি দিয়ে রোজা ছাড়ার পর স্যুপ ও ফলের জুস বা শরবত খান। এই খাবারগুলো সহজেই হজম হবে এবং সারাদিনের খালি পেটে এসব খেলে কোনো সমস্যা দেখা দিবে না। 

এই খাবারগুলো খেয়ে রোজা ছাড়ার ১০-১৫ মিনিট পর আপনার পছন্দের খাবারগুলো খেতে পারেন। বেগুনি, পিঁয়াজু, জিলাপি, ছোলা বুট মুড়ি মাখা, নুডলস, দুধ, দই, ডিম, খিচুড়ি, তেহারি, হালিম খাবেন। তবে তেলেভাজা বা ভাজাপোড়া ও বাইরের খাবার বেশি খাওয়া মোটেই ঠিক নয়। ফলমূল, শাক-সবজি হচ্ছে স্বাস্থ্যকর খাবার, এগুলো বেশি বেশি খাবেন ইফতারের পর।


অনেকেই ইফতারে একসাথে সব খেতে চায়, যা একদমই ভুল কাজ। সুস্থ থাকতে ও আপনার বিপাকীয় কাজ সঠিক রাখতে খেতে হবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার। ডিম, ফলমূল বিশেষ করে আপেল, অ্যাভোকাডো (Avocado) খাওয়া সবচেয়ে ভালো কারণ এগুলোতে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট রয়েছে যা শরীরের জন্য দরকারী। 

সারাদিন কষ্ট করার পর যদি খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তো আপনার জন্যই ক্ষতি। তাই খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। 


ইফতারে যা যা খাওয়া ঠিক নয়-

এটা বলা হয়েছে যে, ইফতারে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ও চিনিযুক্ত খাবার না খাওয়া ভালো।তাই  ইফতারে লবণাক্ত খাবার, অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, কৃত্রিম জুস ও বেশি চিনিযুক্ত শরবত কম খেতে চেষ্টা করবেন বা পারলে এড়িয়ে যাবেন।


রাতের খাবার -

ইফতারের পর অনেকেই রাতের খাবার খান। রাতে হালকা খাবার খেতে পারেন, যাতে সাহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাওয়া যায়। ভাত, রুটি, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ডাল ও  বিভিন্ন তরকারি খেতে পারেন।

রোজার সময় সবচেয়ে যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে বেশি করে পানি পান করা। সারাদিন রোজা রাখায় শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়, যা অনেককে ভিষণ পানিশূন্যতায় ভোগায়। সাহরিতে ও ইফতারে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। শুধু সাহরিতে বা শুধু ইফতারে ৮-১০ গ্লাস, তা না। আপনি এই দুই সময় মিলিয়ে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি খাবেন। সম্ভব হলে আরও বেশি খেতে পারেন, ২ লিটার বা আরও বেশি। রাতের খাবার এর সময়ও পানি খাবেন। রোজা ছাড়া মুহুর্তে যত সম্ভব চেষ্টা করবেন পানি ও বিভিন্ন তরল খাবার খাওয়ার।


সবশেষে

উপরে বলা খাবারগুলো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং সঠিক খাবার। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও অসুস্থতায় ভুগছেন, তাদেরকে পুষ্টিবিদ ও ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক রমজানে খাবার তালিকা মেনে চলতে হবে। 

রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার কর্তব্য। অস্বাস্থ্যকর, হারাম বস্তু ও খাবার খেয়ে এবং ব্যবহার করে রোজার পবিত্রতা নষ্ট করবেন না। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রমজান মাসে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিজেকে সুস্থ রাখুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url