ওজন বাড়ানোর কার্যকরী প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায়
ওজন কমানো নিয়ে যেমন একদল মানুষ উঠেপড়ে লাগে, আবার ওজন বাড়ানো নিয়েও অনেকে উঠেপড়ে লেগে যান। ওজন কম থাকা ভালো, কিন্তু ওজন অনেক কম থাকা ভালো না। আগের আর্টিকেল গুলোতে কম ওজন ও ওজন কমানো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলে ওজন বাড়ানোর কার্যকরী প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জানতে পারবেন।
বিএমআই ( BMI) রেট ১৮.৫ এর কম হলে সেটা কম ওজন হওয়া মানে Underweight। ওজন বেশি হওয়া যেমন ভালো না, ওজন কম হওয়াও ভালো না। মানবদেহের ওজনের মাপ বা বিভিন্ন স্কেল রয়েছে যেগুলো ওজনের বিভিন্ন স্তরের অবস্থা নির্দেশ করে। ওজনের বিভিন্ন স্তর পরিমাপ করা হয় BMI ( Body mass index) রেট অনুযায়ী। ওজনের স্তরগুলো হলো-
- বিএমআই (BMI) রেট ১৮.৫ এর কম হলে সেটা হচ্ছে কম ওজন বা আন্ডারওয়েট (Underweight)
- বিএমআই (BMI) রেট ১৮.৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত হলে সেটা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর অর্থাৎ উপযুক্ত ভালো ওজন।
- বিএমআই (BMI) রেট ৩০ এর বেশি হলে সেটা অতিরিক্ত ওজন বা Overweight।
BMI level |
আপনার ওজন কোন স্তরের তা আপনার উচ্চতা ও ওজন দিয়ে হিসেব করলে যে BMI মান পাবেন, সেটাই আপনার ওজনের স্তর। অনলাইনে BMI চেক করার অনেক ওয়েবসাইট আছে। অথবা আপনি নিজে নিজেও অঙ্ক বা গণিতের মাধ্যমে জানতে পারবেন।
ওজন কমানোর জন্য যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা হয়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালরি খরচ ( Burning Calories) করতে হয়। আর ওজন বাড়ানোর জন্য করতে হয় এর উল্টো। অর্থাৎ আপনি যত ক্যালরি প্রতিদিন বার্ন (Burn) বা খরচ করবেন, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতে মানে খেতে হবে। দ্রুত ওজন বাড়াতে চাইলে দৈনিক ৭০০-১০০০ ক্যালরি বাড়তি গ্রহণ করতে হবে। আর যদি ধীরেধীরে বাড়াতে চান তাহলে দৈনিক ৩০০-৫০০ ক্যালরি বাড়তি গ্রহণ করতে হবে।
আপনি যদি আপনার BMI মান নিয়ে চিন্তিত থাকেন যে, আপনার ওজন কম বা বেশি এখন কী করতে পারি- তাহলে এই ব্লগের ওজন নিয়ে অন্য আর্টিকেল গুলো দেখে নিতে পারেন।
ওজন কম বা Underweight হলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকতে পারে না। ওজন বেশি থাকলে যেমন বিভিন্ন রোগ ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, ওজন অনেক কম থাকলেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। তাই সুস্থ থাকতে চাইলে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ওজন রাখতে চেষ্টা করতে হবে।
ওজন বাড়ানোর কার্যকরী প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জেনে নিন-
ওজন বাড়ানোর কার্যকরী উপায়
১. খাবার
আমিষ (Protein): ওজন বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে প্রোটিনজাত খাবার। আপনার খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫% এর বেশি প্রোটিন রাখতে হবে। আপনার প্রতি পাউন্ড ওজনের জন্য ০.৭-১.০ গ্রাম প্রোটিন খেতে হবে। আর যদি কিলোগ্রাম(Kg) মাপ অনুযায়ী চান, তাহলে প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের জন্য ১.৫-২.২ গ্রাম প্রোটিন খেতে হবে।
প্রোটিন পাওয়া যায় মাছ, মাংস, ডিম, বিভিন্ন সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ, বিভিন্ন বীজজাতীয় খাবার, ফলমূল থেকে।
মুরগি,গরু, ছাগল, মহিষের মাংস তে অতিমাত্রায় প্রোটিন ও চর্বি বা ফ্যাট( Fat) থাকে। যা ওজন বাড়াতে কার্যকর। স্যামন মাছ ( Salmon), টুনামাছ, রুই, পাঙ্গাশ, বোয়াল, রুপচাঁদা ইত্যাদি মাছগুলো প্রোটিন ও ফ্যাট এর বড় উৎস। সামুদ্রিক মাছগুলোতে থাকে শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড ( Omega-3 fatty acids), যা বেশি বেশি খেলে ক্যালরি গ্রহণের হারও বাড়বে। এছাড়াও এসব মাছ থেকে চর্বি বা ফ্যাট পাওয়া যায় যা ওজন বাড়াতে পার্শ্ব সহায়ক হয়।
বিভিন্ন রকম বাদাম, শিম, বরবটি, মটরশুঁটি, ডাল ইত্যাদি বীজজাতীয় খাবারগুলো প্রোটিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়ক।
ওজন বাড়াতে চাইলে যত বেশি সম্ভব ক্যালরি গ্রহণ করুন, সেই ক্যালরির ঘাটতি পূরণে উত্তম সহায়ক হচ্ছে প্রোটিন।
কার্বোহাইড্রেট( Carbohydrate): ওজন কমাতে কার্বোহাইড্রেট কম খেতে বলা হয়। কিন্তু ওজন বাড়াতে হলে কার্বোহাইড্রেট ও শর্করাজাত খাবার খেতে হবে বাড়তি ক্যালরি নিতে। ১ কাপ সাদা ভাত থেকে ২০৪ ক্যালরি পাওয়া যায়।
ওজন বাড়ানোর মানে এই নয় যে শরীরে চর্বি বা ফ্যাট( Fat) বেশি হতে হবে, বরং ওজন বাড়াতে স্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করতে হবে। শরীরে অধিক চর্বি থাকা ওজন বাড়ানো নির্দেশ করে না।
আলু, গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদি খাবারগুলো থেকে শর্করা ( Starch) পাওয়া যায়, যা ক্যালরি বাড়াতে দরকারী।
ওজন বাড়াতে হলে এই খাবারগুলো খেতে হবে অন্যবারের তুলনায় বেশি করে। এছাড়াও শর্করাজাত এই খাবারগুলো মাংসপেশির গ্লাইকোজেন ( Glycogen) এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
ফলমূল ( Fruits): প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল ও আরও অনেক পুষ্টিসমৃদ্ধ উপাদানে ভরপুর খাদ্য হচ্ছে ফলমূল। কিছু কিছু ফলমূলে কার্বোহাইড্রেটও থাকে। অ্যাভোকাডো ( Avocado), আপেল, কলা, খেজুরের মতো শুকনোজাত ফলগুলো স্বাস্থ্যের জন্য দরকারী।
একটি বড় সাইজের অ্যাভোকাডো থেকে ৩২০ ক্যালরি পাওয়া যায়। আর খেজুর সহ অন্যান্য শুকনো ফলমূলে থাকে আঁশ ( Fiber), যা ওজন বাড়াতে কাজে লাগে।
দুধ ( Milk): ওজন বাড়াতে ও মাংসপেশির গঠনে কার্যকরী একটি খাদ্য হচ্ছে দুধ। দুধে থাকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম (Calcium), মিনারেল (Minerals) ও অন্যান্য পুষ্টিকর আরও উপাদান। দিনে কমপক্ষে ২ গ্লাস দুধ পান করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। এক কাপ দুধে ১৫০ ক্যালরি পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাহলে ২ গ্লাস দুধ খেলে নিশ্চিতভাবেই অনেক ক্যালরি পাওয়া যাবে।
উচ্চমাত্রার ক্যালরিযুক্ত খাবার : অতিমাত্রায় প্রোটিন রয়েছে এমন খাবারগুলো যেমন- চিনাবাদাম (Peanut), কাজুবাদাম (Almond), আখরোট ( Walnut), দুধ, ডিম, কলা, দই, সয়া, মাখন, পনির, ডার্ক চকোলেট ( একটি ১০০ গ্রাম ডার্ক চকোলেটে ৬০০ ক্যালরি পর্যন্ত থাকে) এসব খাবার বেশি বেশি করে খেতে হবে।
এসব খাবার নিয়মিত খেতে থাকলে অধিক ক্যালরি গ্রহণের মাধ্যমে ওজন বাড়ানো সহজ হয়ে যাবে।
খেজুর আর শসা একসাথে টানা কয়েকদিন খেতে থাকলেও ওজন বাড়িয়ে স্বাস্থ্যবান হওয়া যায়।
খাবার খাওয়ার আগে কোন খাবারে কত ক্যালরি থাকে তা জেনে নিয়ে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করলে ওজন বাড়ানোর কাজ সহজ হবে। খাদ্য তালিকা আপনি প্রাকৃতিকভাবে ও ঘরোয়া ভাবে তৈরি করে খেতে পারেন। উপরে বলা খাবারগুলো বেশিরভাগই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ও খাওয়া যায়। তবে কিছু খাবার আপনি ঘরোয়াভাবে বানাতে পারেন। যেমন- বিভিন্ন হালকা খাবার বা স্ন্যাকস (Snacks) , ফলের জুস, দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার, এক খাবারের সাথে অন্য খাবারের মিশ্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার।
ওজন বাড়াতে সঠিক খাবার তালিকা সম্পর্কে এ ডায়েট চার্ট দেখুন।
২. ব্যায়াম( Exercise)
আপনি খাবার খেলেন এবং অধিক ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খেলেন, এখন খাবারের সেই ক্যালরি আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশে, মাংসপেশিতে পাঠাতে হবে। ক্যালরিগুলো শরীরে ঠিকঠাকভাবে না পৌঁছালে ওজন বাড়বে কীভাবে?
এর জন্য আপনাকে ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন সম্ভব না হলেও সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যায়াম করতে হবে।
সহজ ও কম কষ্টসাধ্য ব্যায়ামের চেয়ে চেষ্টা করবেন বেশি ভারী ব্যায়াম করার। ভারোত্তোলন করা যেসব ব্যায়াম গুলো আছে, সেগুলো বেশি বেশি করতে হবে। প্রথমবার যদি ১০ কিলোগ্রাম ভারোত্তোলন করেন, পরবর্তীতে পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ভারোত্তোলন করবেন।
পুশ-আপ, দঁড়ি টানা, ভারী বস্তু বহন করা, দৌঁড়ানো এরকম ব্যায়াম গুলো করতে চেষ্টা করতে হবে বেশি করে।
ঘরোয়াভাবে ঘরেই অনেক ব্যায়াম করা যায়, তবে বেশি পরিশ্রমের ব্যায়াম করতে হলে ব্যায়ামাগার বা জিমে যাওয়া লাগে।
যেভাবে সম্ভব হবে সেভাবে চেষ্টা করুন বেশি বেশি ব্যায়াম ও পরিশ্রম করতে।
ঘুম ( Sleep): খাবার খেয়ে ক্যালরি জমানো আর ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালরি শরীরে পৌঁছানোর সাথে সাথে যে কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে পর্যাপ্ত ঘুম। ঘুমের ফলে শরীর পূর্ণ বিশ্রাম পায় ও ক্যালরি জমা হয়। শুধু ঘুমালেই হবে না, পরিপূর্ণ ও পর্যাপ্ত ঘুম হতে হবে। দৈনিক ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। বেশি রাত জাগা উচিত নয়। সুস্থ, সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে দরকার পর্যাপ্ত ঘুম। ঘুমের ফলে শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকে। যার ফলে কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়।
ওজন কমানো যেমন সহজ কাজ না, আবার ওজন বাড়ানোও সহজ না। পরিপূর্ণ খাদ্য তালিকা বা ডায়েট চার্ট ( Diet chart) মেনে চললেই হবে না, ব্যায়ামও অবশ্যই করতে হবে।
রাতারাতি কোনো কিছু করে সুফল পাওয়া সহজ না। ম্যারাথন গতিতেও যদি আপনি উপযুক্ত খাবার, ব্যায়াম, ঘুম এই কাজগুলো দৈনন্দিন জীবনযাপনে মানিয়ে নিয়ে চলতে থাকেন, তাহলে আপনি ওজন বাড়ানোর সুফল পাবেন।
দ্রুত ফলাফলের আশা না করে আগে মনকে পরিপূর্ণভাবে স্থির করুন যে আপনি কাজগুলো করতে পারবেন। তাহলেই আপনি ফলাফল পেয়ে যাবেন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মনস্থির করা। তাই, মনকে ওজন বাড়ানোর কাজে পরিপূর্ণভাবে স্থির করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
উপসংহার
ওজন বাড়ানোর কার্যকরী উপায় সম্পর্কে উপরে যা বলা হয়েছে তা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মাধ্যমে প্রমাণিত কার্যকর উপায়। এগুলো অবলম্বন করলে ফলাফল নিশ্চয়ই পেতে থাকবেন।