ওজন কমাতে কার্যকর ও উপযোগী খাবারগুলো
বর্তমান যুগে ওজন নিয়ে অনেকেই চিন্তায় থাকেন। চিন্তা করবেননা, কারণ চিন্তা করলে ওজন বাড়তে থাকে। তাই, চিন্তা না করে ওজন কমাতে কার্যকর ও উপযোগী খাবারগুলো সম্পর্কে জেনে নিন।
ওজন কমাতে চাইলে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে ক্যালরি খরচ করার। অর্থাৎ আপনি যত ক্যালরির খাবারই খান না কেন, আপনাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর যত পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করবেন অর্থাৎ যত ক্যালরি খাবেন, তারচেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালরি বার্ন (Burn) করতে হবে বা খরচ করতে হবে। এই আর্টিকেলে ওজন কমাতে কার্যকর ও উপযোগী খাবারগুলো যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ওজন কমানোর জন্য শুধু খাবার খেয়ে গেলেই ওজন কমানো যাবে না, সেই সাথে ক্যালরি ঝরানোও লাগবে। কারণ, এটা জানেন হয়তো যে- ওজন কমাতে খাবারের অবদান ৮০% আর ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্যালরি বার্ন করার অবদান ২০%। সুতরাং, শুধু খাবার খেয়ে বা শুধু ব্যায়াম করেই ওজন কমানো যাবে না। খাবার ও শারীরিক পরিশ্রম দুটোই চালিয়ে যেতে হবে। একটি বাদ দিলে আপনি ফলাফল পাবেন না।
দেখে নিন -
ওজন কমাতে কার্যকর ও উপযোগী খাবারগুলো
এখন জেনে নিন কোন খাবারগুলো ওজন কমাতে বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে -
Scientifically proved foods to lose weight
প্রোটিন (Protein): আপনি যদি সকালের নাস্তা ডিম (Egg) দিয়ে শুরু করুন, তাহলে দিনটা আপনার শরীরের জন্য কত উপকার বয়ে আনবে তা নিজেই দিনশেষে বুঝতে পারবেন। ডিমে উচ্চমাত্রার প্রোটিন (Protein) থাকে যা ওজন কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যারা সকালের নাস্তায় ডিম খায়, তারা নাস্তায় অন্যান্য খাবার খাওয়া লোকদের তুলনায় সারাদিনে খিদে কম অনুভব করে, অর্থাৎ নাস্তায় ডিম খাওয়া লোকদের খিদের মাত্রা কম থাকে। যা ওজন কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খিদে কম লাগলে শরীরে বাড়তি ক্যালরি গ্রহণ করতে হয় না, ফলে ওজন কমার হার বাড়তে থাকে। এই গবেষণার শেষে দেখা যায় যারা সকালের নাস্তায় ডিম খায় তাদের শরীরে ১৬% পর্যন্ত চর্বি বা ফ্যাট (Fat) হ্রাস পেতে থাকে এবং ৬৫% পর্যন্ত ওজন হ্রাস পাওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়।
প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলে খিদে কম লাগায় ক্যালরি গ্রহণের হারও কম থাকে, যা ওজন কমাতে কার্যকর এবং খিদেও নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ, ওজন কমানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজই হচ্ছে ক্যালরি কম রাখা।
প্রোটিন (Protein) গ্রহণের ফলে শরীরের বিপাক হার ( Metabolic Rate) বাড়তে থাকে, আর যদি ডিমের মতো উচ্চমাত্রার প্রোটিন খাওয়া হয় তাহলে বিপাকীয় হার ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
সপ্তাহে ৭-১২ টি ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই ওজন কমানোর জন্য মনস্থির করলে অবশ্যই খাদ্য তালিকায় ডিম, মাছ, মাংস রাখুন। প্রোটিন ওজন ও ফ্যাট কমাতে উপযোগী একটি খাবার। ডিম, মাছ,মাংস ও কিছু ফলমূল থেকে প্রোটিন পাওয়া যায়। প্রোটিনে ক্যালরির মাত্রা কম থাকে, সেইসাথে প্রোটিন গ্রহণের ফলে ক্যালরি বার্নও হয়।
শাক-সবজি ( Vegetables): বিভিন্ন রঙের শাক-সবজি মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। কেননা, শাক-সবজিতে থাকা ভিটামিন, মিনারেল, আঁশ মানবদেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আর আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তাহলে শাক-সবজি হতে পারে দারুণ উপযোগী।
শাক-সবজি খাওয়ার ফলে দেহে বিপাকীয় হার বাড়ে ও খিদের মাত্রা কম থাকে, যা ওজন ও ফ্যাট কমাতে কাজে আসে।
বিভিন্ন রকম শাক-সবজি রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সবুজ শাক-সবজি, পাতাকপি,ফুলকপি, পালংশাক, ব্রকোলি অধিক কার্যকর। এসব শাক-সবজিতে থাকা ক্যালসিয়াম (Calcium) শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধি বা হাড়ের গঠনে অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান।
প্রোটিন, আঁশ বা ফাইবার( Fiber), নিম্ন ক্যালরি - এই ৩টি উপাদানই যথেষ্ট শরীরের ওজন ও ফ্যাট কমাতে।
ফলমূল ( Fruits): প্রাকৃতিক এই খাবার সুস্থ, অসুস্থ সবার জন্য প্রয়োজন। ফলে থাকা প্রাকৃতিক চিনি ( Natural Sugar) ও নিম্ন ক্যালরি আপনার ওজন কমানোর সহায়ক হতে পারে। বেশি বেশি ফলমূল খাওয়া মানুষরা অন্যান্যদের তুলনায় বেশি সুস্থ ও সবল থাকতে পারে।
অ্যাভোকাডো (Avocados) এমন একটি ফল যেটিতে রয়েছে নিম্ন মাত্রার ক্যালরি, যা ওজন কমাতে প্রয়োজন। বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল, ও অন্যান্য অনেক পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি ফল হচ্ছে অ্যাভোকাডো। জাম্বুরা, আঙুর, আপেল এসমস্ত ফলগুলো স্বাস্থ্য ভালো রাখতে অনেক উপকারী। ফল খাওয়ার পাশাপাশি এসমস্ত ফল দিয়ে জুস বানিয়েও খেতে পারেন।
চর্বিমুক্ত মাংস ( Lean meats): আমিষের ( Protein) অন্যতম একটি উন্নত উৎস হচ্ছে মাংস। তবে সব মাংসই সবার জন্য উপযোগী নয়। কারণ, গরু ও মহিষের মতো প্রাণীগুলোর মাংসে চর্বি বা ফ্যাট এর মাত্রা বেশি থাকে যা অতিমাত্রায় গ্রহণ করা মোটেই ঠিক না। প্রোটিনের ঘাটতি পূরণে উন্নত ও উত্তম খাদ্য হচ্ছে চর্বিমুক্ত মাংস। যেমন, মুরগির মাংস। আয়রন, প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস মুরগির মাংস। চর্বি ঝরাতে ( Burning fat) যত রকমের খাবার আছে, মুরগির মাংস সেগুলোর মধ্যে একটি। মাংসপেশির গঠনেও মুরগির মাংসের প্রভাব কাজ করে।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে, মুরগির মাংসের মতো চর্বিমুক্ত মাংস খাওয়ার ফলে খিদের মাত্রা কম থাকে অর্থাৎ খিদে কম অনুভূত হয়। যার কারণে ক্যালরির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে। যা ওজন কমানোর একটি নিয়ামক।
সামুদ্রিক মাছ (Sea Fish): আমাদের দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য উপাদান হচ্ছে "ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড (Omega-3 fatty acids) "। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই খাদ্য উপাদানটি আমরা পেতে পারি। স্যামন মাছ তেমনই একটি খাবার যা ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড ও উচ্চমাত্রার প্রোটিনসমৃদ্ধ। শুধু তাই নয়, দ্রুত ওজন কমাতেও দারুণভাবে উপযোগী বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছগুলো। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছগুলো বেশিরভাগ চর্বিমুক্ত মাছ, যেগুলোতে বাড়তি চর্বি বা ফ্যাট নেই। যা আপনার ফ্যাট কমাতেও কার্যকরী।
স্যামন মাছ, টুনামাছ, বিভিন্ন মিঠাপানির মাছগুলো থেকে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড, আয়োডিন, প্রোটিন এর মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান গুলো পাওয়া যায়। এই সমস্ত উপাদানগুলো ওজন ও ফ্যাট কমানোর জন্য অনেক সহায়ক।
বীজজাতীয় খাবার ( Beans): আরও একটি চর্বি ঝরাতে কার্যকর খাবার হচ্ছে বীজজাতীয় খাবারগুলো। মটরশুঁটি, শিম, ডাল এসমস্ত খাবারগুলো বীজজাতীয় খাবার। এজাতীয় খাবারগুলোতে থাকে প্রোটিন, আঁশ( Fiber), যা নিম্ন ক্যালরি গ্রহণ ও খিদে নিয়ন্ত্রণ করে। ওজন ও ফ্যাট কমানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে কম ক্যালরি ও খিদে নিয়ন্ত্রণ। বীজজাতীয় খাবারগুলো এই প্রক্রিয়া সম্পাদনে ভূমিকা পালন করে।
বাদামজাতীয় খাবার ( Nuts): চিনাবাদাম (Peanuts), কাজুবাদাম( Almonds), আখরোট (Walnuts) এর মতো খাবারগুলো খিদে নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। বাদামে থাকা প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম ( Magnesium), ও স্বাস্থ্য উপযোগী ফ্যাট শরীরে এমন কিছু এন্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) উৎপন্ন করে যা শরীরের কোথাও ব্যথা, ফোলা, প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে।
চর্বি ঝরানোর অন্যতম একটি খাবার হচ্ছে বাদামজাত খাবারগুলো বিশেষ করে কাজুবাদাম বা Almonds.
পানি ( Water): নিশ্চয় জানেন পানি মানবদেহের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করার মাধ্যমেও ওজন কমানো সম্ভব। দেহের রক্ত চলাচল, হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, বিপাকক্রিয়া ও রেচনক্রিয়া সম্পাদনের জন্য পানি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
পানি কোনো খাদ্য না, পানি জীবনধারণের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। জীবনধারণের জন্য পানি পান করতেই হয় সবাইকে। পানির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে- ওজন কমাতে পানি উপকারী।
অন্যান্য খাবারগুলো( Other Foods):
উপরের খাবারগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে বলা হয়েছে। এসবের বাইরে আরও অনেক খাবার রয়েছে যা ওজন ও ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে। সেরকম কিছু খাবার হচ্ছে- চিংড়ি, কাঁচা কলা, ডার্ক চকোলেট, মরিচ, তরমুজ, দারুচিনি, বিভিন্ন রকম স্যুপ, দই, গ্রিন-টি বা সবুজ চা,কফি, নারিকেল তেল।
উপরিউক্ত আলোচনায় যে সমস্ত খাবারগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে এসব খাবার ওজন কমাতে কার্যকর ও উপযোগী। বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে এসব খাবারগুলো।
সবশেষে
ওজন ও ফ্যাট কমাতে শুধু খাবারের দিকে লক্ষ্য রাখলে হবে না, শারীরিক কাঠামো ও গঠনের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম ও উপযুক্ত ক্যালরির খাবার গ্রহণের মাধ্যমেই ওজন কমানোর লক্ষ্য রাখতে হবে।
ওজন কমানোর কার্যকর ও উপযোগী খাবার তালিকা মেনে চেষ্টা চালিয়ে যান। অল্পতেই হতাশ ও নিরাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে ফলাফল অবশ্যই পেতে থাকবেন।