টনসিল স্টোনের কারণ, লক্ষ্যণ, ক্ষতি ও ঘরোয়া চিকিৎসা।

টনসিল স্টোনের কারণ, লক্ষ্যণ, ক্ষতি ও ঘরোয়া চিকিৎসা।

মানবদেহের অভ্যন্তরে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। যেগুলোর একেকটির কাজ একেক রকম। টনসিল হচ্ছে তেমনই একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অংশ। টনসিল হচ্ছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাক, মুখ দিয়ে বিভিন্ন ভাইরাস ও ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে টনসিলই সর্বপ্রথম তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। টনসিলের একটি সমস্যা হচ্ছে টনসিল স্টোন বা পাথর হওয়া। টনসিল স্টোন কী? টনসিল স্টোনের কারণ, লক্ষ্যণ, ক্ষতি এবং ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিতে এই আর্টিকেল শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

Tonsil stone causes, symptoms, and harms


টনসিল ও টনসিল স্টোন 

মানুষের গলার ভিতরে আলজিভের পিছনে দুই পাশে দুটি গ্রন্থি থাকে যা নরম মাংসল অংশ, যাদেরকে টনসিল ( Tonsil) বলা হয়। টনসিলে অসংখ্য ছিদ্র ও ফাটল থাকে যেখানে খাবারের অবশিষ্ট অংশ, লালা, মৃত কোষ, শ্লেষ্মা বা মিউকাস আঁটকে যায়। সেই আঁটকে যাওয়া অবশিষ্ট অংশ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। আমাদের মুখের ভিতর বিভিন্ন রকমের অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া (Bacteria)  ও ছত্রাক (Fungi) গুলো টনসিলে আঁটকে পড়া অংশগুলোকে আরও খাদ্য জোগায়। 

ফলে সেখানে পাথরের মতো সাদা বা হালকা হলুদ রঙের একধরণের বাড়তি বস্তুর সৃষ্টি হয়, যা টনসিল স্টোন (Tonsil Stones) বা টনসিলের পাথর নামে পরিচিত। এই অবস্থাকে Tonsilloliths -ও বলা হয়। টনসিল স্টোন এর বড় হওয়ার পেছনে মানুষের দেহের ক্যালসিয়াম ভূমিকা রাখে, আর ক্যালসিয়াম আসে খাবারের বিভিন্ন উপাদান থেকে।


টনসিল স্টোন হয়েছে কি-না বুঝতে নিজে নিজেই দেখে নিতে পারবেন। মুখ বড় হা করে গলার ভিতরে ভালোভাবে তাকালে সাদা বা হালকা হলুদ রঙের কোনো বাড়তি অংশ দেখা গেলে তাহলে বোঝে নিবেন টনসিল স্টোন বা পাথর হয়েছে। 

সাধারণত আকৃতিতে ছোট ছোট একটি বা দু'টি স্টোন বা পাথর হতে পারে, আবার আকারে বড়ও হতে পারে। তবে এমন কিছু ছোট ছোট স্টোন থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এর মাধ্যমে তা নির্ণয় করতে হয়। 

টনসিল স্টোন কেন হয়?

  • দাঁত ব্রাশ ঠিকমতো না করলে এবং জিভের আশেপাশে অর্থাৎ মুখের ভেতরে ভালোভাবে পরিষ্কার না রাখলে।
  • পানি কম পরিমাণ পান করলে বা প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি খাওয়ার ফলে।
  • টনসিল বা গলার সেই মাংসল গ্রন্থির আকার বেশি বড় হলে।
  • দীর্ঘদিন ধরে সাইনাস (Sinus) এর সমস্যা থাকলে। 
  • টনসিলে প্রদাহ বা ফোলা থাকলে।
  • অনেকের লালা বেশি ঘন হলেও এটা হতে পারে। 

এসমস্ত কারণে খাবারের অবশিষ্ট অংশ, শ্লেষ্মা বা মিউকাস (Mucus), লালা, মৃত কোষ টনসিলের চারপাশে আঁটকে গিয়ে টনসিল স্টোন সৃষ্টি করে থাকে।


টনসিল স্টোন এর লক্ষ্যণসমূহ

  • টনসিল স্টোন এর আসল লক্ষ্যণ হলো মুখে দুর্গন্ধ, দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাস। টনসিল স্টোন যত বড় হবে, দুর্গন্ধ তত বেশি হবে। অনেকটা পঁচা ডিমের গন্ধের মতো গন্ধ হয়। 
  • গলা ব্যথা অন্যতম একটি লক্ষ্যণ। সেই সাথে গলার স্বরের পরিবর্তন, ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া ও গলায় কোনো কিছুর স্বাদ টক বা তিতা হয়ে থাকে।
  • অনবরত কাশি হয়ে থাকে।
  • গলার সাথে কানের অনেক স্নায়ু (Nerve) যুক্ত থাকে, যার ফলে টনসিল স্টোন হলে কানে ব্যথা করতে পারে। 
  • টনসিলের পাশে সাদা এবং হালকা হলুদ রঙের দানার মতো হয়ে থাকে, যা ক্রমশ ফুলতে থাকে ও বড় হয়। তবে খুব ছোট আকৃতির হলে তা দেখা যাবে না। পরীক্ষার মাধ্যমে তা নির্ণয় করতে হয়। 
  • শিশুদের টনসিল স্টোন হলে জ্বর ও ঠাণ্ডা লাগে।


টনসিল স্টোন কি মারাত্মক কোনো ক্ষতি করে? 

বেশিরভাগ টনসিল স্টোন তেমন কোনো ক্ষতিকর না। টনসিল স্টোন থেকে বড় ধরণের ও মারাত্মক কোনো সমস্যা হওয়ার ঘটনা খুব বিরল, তবে বড় কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। 

টনসিল স্টোন থেকে বড় যে সমস্যা গুলো হতে পারে তা হচ্ছে গলায় বিভিন্ন ইনফেকশন, টনসিলে ইনফেকশন। টনসিল স্টোন যখন পেকে বড় হতে থাকে তখন বেশি সতর্ক হতে হবে। টনসিল স্টোন বড় আকারের হয়ে গেলে তা টনসিলের কোষের ক্ষতি ও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এসব ইনফেকশন থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। কারণ, টনসিল স্টোন ও টনসিলাইটিস (Tonsillitis) এর অনেক কার্যকরী চিকিৎসা আছে। তাই ভয় না পেয়ে ও অবহেলা না করে সচেতন থাকতে হবে। 


টনসিল স্টোন এর চিকিৎসা

যদি স্টোন আপনার বেশি সমস্যা সৃষ্টি না করে এবং আপনি যদি স্বাভাবিক থাকেন তাহলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসেই টনসিল স্টোন বা পাথর অপসারণ করতে পারবেন।

টনসিল স্টোন এর ঘরোয়া চিকিৎসা-

বেশিরভাগ টনসিল স্টোন ঘরোয়াভাবে নিজে নিজেই সরিয়ে ফেলা যায়। সহজ কিছু উপায়ের মাধ্যমেই টনসিল স্টোন মুক্ত করা যায়। সেগুলো হলো-

  • দাঁত ব্রাশ করার সময় জিভের আশেপাশে ও জিভের পিছনের অংশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা।
  • হালকা গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া ( Gargling) করার ফলে টনসিল স্টোন খসে যায় অর্থাৎ স্টোন সরে যায়।
  • কটন বাড( Cotton bud) দিয়ে হালকা করে নাড়া দিলে স্টোন খুলে যায় বা খসে যায়। 
  • গলার ভিতর থেকে জোর দিয়ে কাশতে থাকলেও স্টোন খুলে যায়। 
  • বেশি বেশি পানি পান করার মাধ্যমে। 


সতর্কতা

  • শক্ত কোনো বস্তু দিয়ে স্টোন সরানোর চেষ্টা করা যাবে না। শক্ত বা ধারালো কোনো বস্তু লাগালে সেটার আঘাতে গলায় ও তালুতে কেটে যেতে পারে, যা পরে বড় ধরণের ক্ষতি করতে পারে। 
  • ধুমপান ও তামাকজাত পণ্য পরিহার করতে হবে। 


কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

  • টনসিল স্টোনের আকার বড় হয়ে গেলে।
  • ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হলে এমনকি শ্বাস-কষ্ট দেখা দিলে। যাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep apnea) বলে।
  • টনসিল স্টোন বারবার হতে থাকলে। একবার সেরে ওঠার পর আবার ফিরে আসলে। 
যেমন, 

  • এক বছরেই ৬-৭ বারের মতো টনসিল স্টোন হলে।
  • এক বছরে ৫ বার এবং পরের বছরও হলে। অর্থাৎ টানা ২ বছরে ৫ বার করে ১০ বারের মতো হলে।
  • টানা ৩ বছর হতে থাকলে এবং প্রতি বছরে ৩ বার হলে।

এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তখন অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। 


ডাক্তাররা যেসকল চিকিৎসার মাধ্যমে টনসিল স্টোন সরিয়ে ফেলেন। সেগুলো হচ্ছে - এন্টিবায়োটিক (Antibiotics), লেজার (Laser) রশ্মির ব্যবহার করে, টনসিলেকটমি (Tonsillectomy), সার্জারির মাধ্যমে। 


উপসংহার

টনসিল স্টোন কোনো ছোঁয়াচে রোগ না। এটির চিকিৎসা আছে। আপনার টনসিল স্টোন হলে তা জটিল আকার ধারণ করলে এবং সমস্যার সৃষ্টি করলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। টনসিল স্টোনের কারণ, লক্ষ্যণ, ক্ষতি ও ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে টনসিল স্টোন প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে। ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকুন, সচেতন থাকুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url