আমাদের ওজন বাড়ে কেন? বয়স বাড়ার সাথে ওজন বাড়ে কেন?
বয়স বাড়তে থাকলে সবারই ওজন বাড়তে থাকে। এমনকি মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদেরও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ওজন বাড়ে। কিন্তু কেন? আমাদের ওজন বাড়ে কেন? বয়স বাড়ার সাথে ওজন বাড়ে কেন?
আমাদের দেহে রয়েছে কয়েকশো অস্থি, তরুণাস্থি, অগণিত কোষ। বয়স বাড়ার ফলে দেহের অভ্যন্তরীণ এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকার, আয়তন, ওজন বাড়তে থাকে। একটি শিশু জন্মের পর থেকে তার দৈহিক বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে তার ওজনও বাড়তে চলে। কিন্তু কেন ওজন বাড়ে?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ওজন বাড়ে কেন?
Why people gain weight as they get older?
আমাদের দেহে এক ধরণের চর্বি স্তর বা ফ্যাট সেল ( Fat cell) রয়েছে, যাকে লিপিড ( Lipids) বলা হয়। লিপিড হচ্ছে একধরণের অদ্রবণীয় জৈব যৌগ। এখানে থাকে চর্বি, তেল, মোম, স্টেরয়েড, হরমোন, কোষঝিল্লির কিছু উপাদান। লিপিড স্তর শরীরের শক্তি সঞ্চয়কারী হিসেবে কাজ করে। শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পাদনে শক্তি সঞ্চয়কারী অনেক অণু বিদ্যমান এই লিপিড স্তরে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশই শরীরের গুরুত্বপূর্ণ এই লিপিড স্তরের কার্যক্ষমতা ধীরগতির হয়ে যেতে থাকে। যা ওজন বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ।
আপনি এটা জানেন হয়তো, ওজন বাড়ার পেছনে শরীরে জমা হওয়া চর্বি বা ফ্যাট ( Fat) অনেকাংশে দায়ী। বয়স বাড়লে লিপিড স্তরের গতি কমে যায় এবং চর্বি জমা হয়ে তা ওজন বাড়িয়ে তুলে। এছাড়াও কিছু হরমোন আছে যা ওজন বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
শরীরের যাবতীয় শক্তি সঞ্চয়ের কাজ করে লিপিড। শুধু শক্তি সঞ্চয়ই নয়, শক্তি সঞ্চয়ের পাশাপাশি আমাদের দেহের কোষঝিল্লির চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক স্তর ( Protective layer) স্তর সৃষ্টি করে যা কোষকে সুরক্ষা দেয়। বাঁচার জন্য আমাদের দেহে লিপিড এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল কাজ হচ্ছে ক্যালরি বার্ন (Burn) করা বা ক্যালরি ঝরানো। ৪০-৫০ বছর এর আগ পর্যন্ত একজন মানুষ পুরোদমে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করতে পারে, যার ফলে ক্যালরি বার্ন হয় এবং ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকে। কিন্তু ৪০-৫০ বছর পার হলে দেহের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে, পরিশ্রম কম হয়, ক্যালরি বার্ন না হওয়ায় অতিরিক্ত ক্যালরি চর্বি হিসেবে জমা হয়- যা ওজন বাড়ায়।
ক্যালরি বার্ন হওয়ার ফলে লিপিড বা চর্বি স্তরে বাড়তি চর্বি জমা হতে পারে না এবং সারা শরীরে শক্তি সরবরাহ হতে পারে, যা লিপিডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়ার কারণে ক্যালরি বার্ন কম হওয়ায় লিপিডের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন বাড়তে থাকে। এর ফলে শরীরের ওজনও বাড়তে থাকে।
১৩ বছর ধরে চলা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে- গবেষণায় যে ৫৪ জন নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছিল, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের দেহের চর্বি স্তর বা ফ্যাট সেল (Fat cell) বাড়তে থাকে, এবং চর্বি ঝরানোর( fat burning) ক্ষমতা ও ক্যালরি ঝরানোর ( burning calories) ক্ষমতা কমতে থাকে ক্রমশ। যা তাদের ওজন বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু গবেষণা চলাকালীন যারা বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্যালরি বার্ন করে গেছে, তাদের মধ্যে ওজন বাড়ার প্রবণতা কম দেখা গিয়েছে।
মূলত, লিপিড এর কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া-ই বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ওজন বাড়িয়ে তুলে। ৭০-৮০ বছরের পর মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে ওজনও কমতে থাকে, তখন লিপিড এর বিপর্যয় কম হয় ফলে ওজন বাড়ে না। এটা আপনি নিজেই আশেপাশে তাকালে বুঝতে পারবেন যে, যাদের বয়স ৭০/৮০ পার হয়ে গেছে তারা আগের মতো মোটা আর স্বাস্থ্যবান নেই, তাদের ওজনও কমে গেছে।
আমাদের মাংসপেশির ভর যত বেশি হয়, ক্যালরি বার্ন করার ক্ষমতা তত বেশি হয়। কিন্তু ৩০ বছরের কাছাকাছি সময় থেকে আমাদের মাংসপেশির সেই সক্ষমতা কমতে থাকতে। মাংসপেশির এই অবস্থাকে Sacropenia বলা হয় যা ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত দ্রুতগতিতে হতে থাকে। এই অবস্থা চলার ফলে কিছু বাড়তি ক্যালরির দরকার হয়, শরীরের বিপাকীয় হার ( Metabolic rate) কমে যায়, এবং যে মাংসপেশিগুলো ক্ষয় হয়ে যায় সেগুলো চর্বিতে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি ওজন বাড়াতে অবদান রাখে।
শারীরিক ও মানসিক চাপ আর হতাশা থেকে কর্টিসল (Cortisol) নামক হরমোন উৎপন্ন হয়, যাকে স্ট্রেস হরমোনও (Stress Hormone) বলা হয়। এই কর্টিসল হরমোন দেহে চর্বি বা ফ্যাট দীর্ঘ সময় ধরে জমা করে রাখে, যা ওজন বাড়াতে বেশি ভূমিকা রাখে।
ইনসুলিন হরমোন ( Insulin hormone) আমাদের রক্তে গ্লুকোজের (Glucose) মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, অতিরিক্ত গ্লুকোজকে যকৃতে ( Liver) স্থানান্তর করে, বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে, পেশিতে শক্তি সরবরাহ করে। কিন্তু যখন এস্ট্রোজেন হরমোন ( Estrogen hormone) বেড়ে যায়, তখন ইনসুলিন হরমোন উৎপন্ন করার কোষগুলোর কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং গ্লুকোজ অতি পরিমাণে চর্বিতে (Fat) পরিণত হয় যা ওজন বাড়ায়।
আরও যেসকল কারণে ওজন বাড়ে-
- মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা দিনদিন কমে যাচ্ছে, এর ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন করা হচ্ছে না- যা ওজন বাড়াচ্ছে।
- খাবার খাওয়ার সময় ক্যালরি হিসাব করে খাওয়া হয় না, বাড়তি ক্যালরির কারণে ওজনও বাড়তি হয়।
- বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিপাক হার ( Metabolism rate) কমতে থাকে। বিপাক হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যা শরীরে খাবার থেকে বিভিন্নভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে।
- অতিরিক্ত হতাশা, মানসিক চাপ।
- পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া। কম ঘুম হওয়া।
- অতিরিক্ত চিনিজাত বা মিষ্টি খাবার খাওয়া।
- থাইরয়েড জনিত সমস্যা।
উপরে বর্ণনা করা কারণগুলোই সাধারণ এবং মূল কারণ বয়স বৃদ্ধির সাথে ওজনও বৃদ্ধি করতে। অর্থাৎ এই কারণগুলোর ফলে মানুষের বয়স বাড়ার সাথে ওজন বাড়ে যা ৭০-৮০ বছর বয়স পর্যন্ত চলতে থাকে।
Very good. Now I am clear about it.