রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা, কখন মেডিসিন নিতে হবে, সতর্কতা

রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা
Do's for diabetes patients


রমজান মাস রহমতের মাস। এই মাসে সারা বিশ্বের মুসলিমরা রোজা পালন করে থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের অনেকেই রমজানে রোজা রাখেন। কিন্তু রমজানে রোজা রেখে কীভাবে কী করবেন তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা, কখন মেডিসিন নিতে হবে, সতর্কতা ও করণীয় কী - সম্পর্কে সহজ ধারণায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিন। 

 

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে 

          ডায়াবেটিস এর আগাম লক্ষণ 

যা যা জানবেনঃ
  • রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীর সমস্যাগুলো।
  • সাহরি ও ইফতারে খাবার।
  • গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা।

রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীর যে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে, সেগুলো হচ্ছেঃ

১. হাইপারগ্লাইসেমিয়া (Hyperglycemia): এটি হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজ তথা শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। এর মাত্রা হচ্ছে ১৮০-২০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা ১০-১১ মিলি মোল/লিটার এর উপরে। এর দু'টি ধরণ আছে। কীভাবে বুঝবেন হাইপারগ্লাইসেমিয়া আছে কি-না, লক্ষ্যণসমূহ-
  • প্রচণ্ড পিপাসা লাগা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া। 
  • ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া।
  • ক্লান্তি, চোখে ঝাপসা দেখা। 
  • পেটে ব্যথা করা এবং দূর্বল হয়ে পড়া।
  • মূত্রনালীর সংক্রমণ, ত্বকে বা চামড়ায় সংক্রমণ হওয়া।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসে বিশ্রী গন্ধ, মুখে ঘা। 

২. হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia): রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমাণ কমে গেলে এটি হয়। এর মাত্রা হচ্ছে ৭০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা ৩.৯ মিলি মোল/লিটার নিচে। এটি সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা। এর জন্য রোগীরা বেশি ভয়ে থাকে। কীভাবে বুঝবেন হাইপোগ্লাইসেমিয়া আছে কি-না, লক্ষ্যসমূহ-
  • হৃৎস্পন্দন/ হার্টবিট অনিয়মিত ও দ্রুত হওয়া।
  • সবসময় অবসাদ, হতাশ, মনমরা, বিরক্ত অবস্থা। 
  • শরীর কাঁপা। 
  • মলিন, ম্লান মুখ। ফ্যাকাশে চেহারা।
  • খিদে বেড়ে যাওয়া।
  • ঠোঁট, জিহ্বা নাড়াতে কষ্ট হওয়া।
  • চোখে ঝাপসা দেখা। 

৩. পানিশূন্যতা: পানিশূন্যতা হচ্ছে শরীরে পানির সরবরাহ কমে যাওয়া। এর ফলে- প্রস্রাবে কষ্ট হওয়া বা কম প্রস্রাব হওয়া, শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়া, পিপাসা বেড়ে যাওয়া সমস্যা দেখা দেয়।

৪. কিটোয়াসিডোসিস (Ketoacidosis): এর মানে হলো প্রস্রাবের সাথে কিটোন থাকা। যা টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ওষুধ ও ইনসুলিন এর কোনো ডোজ নেওয়া বাদ দিলে, ভুল ওষুধ ও ভুল ডোজ নিলে এটা হয়। এটার লক্ষ্যণগুলো হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মতোই। 

৫. ওজন কমবেশি হওয়া। এটা বুঝতেই পারছেন ওজন কারও কমে যেতে পারে আবার বেড়েও যেতে পারে। এখান থেকে ওজন কমাতে ও বাড়াতে কী করতে হবে তা জানুন।


রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর খাবার

ডায়াবেটিস রোগীরা অন্যান্য সময়ে যেসব খাবার খেয়ে আসছেন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী,  রমজানেও সেভাবেই খেতে পারবেন। শুধু সময় আর ক্যালরির পরিমাণে পার্থক্য হবে।

সাহরিতে যা খাবেনঃ

কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ জটিল শর্করাযুক্ত ও আঁশযুক্ত খাবারগুলো খেতে হবে। ভাত, রুটি, বিভিন্ন শাক-সবজিতে শর্করা পাওয়া যায়। শাক-সবজি, ফলমূল, শুকনো ফল যেমন খেজুর এসবে আঁশ (Fiber) থাকে। তবে ভাত বেশি না খাওয়া ভালো। আরও খাবেন মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, ফলমূল, সালাদ, খেজুর, কাজুবাদাম, অলিভ অয়েল। রোজার আগে যেসকল খাবার খেতেন ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক, সেই খাবারগুলোই খেতে পারেন। 

ইফতারে যা খাবেনঃ

খেজুর, স্যুপ, পানি দিয়ে রোজা ছাড়ার ১০-১৫ মিনিট পর অন্যান্য খাবার খাবেন। ডিম, দুধ, শাক-সবজি, ফলমূল, রুটি, মুড়ি মাখা, ছোলা বুট, কাজুবাদাম, দই, দই ও চিড়া এগুলো খাবেন। ইফতারে বেশি বেশি তরল খাবার খেতে পারলে ভালো। তবে মিষ্টি জুস, রঙিন শরবত এসব খাওয়া উচিত নয়। ডাবের পানি, ফলের জুস বা ফল, লেবুর শরবত চিনি ছাড়া খাবেন। পানিই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো তরল খাবার। পানি পান করুন বেশি করে। 

রাতে যা খাবেনঃ

ভাত, রুটি, ডিম, মুরগির মাংস, মাছ, শাক-সবজি খেতে পারবেন। ভাত, রুটি বেশি পরিমাণে খাবেন না কারণ এগুলোতে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। উচ্চ শর্করা রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া সৃষ্টি করতে পারে। অল্প পরিমাণে খাবেন।

অবশ্যই ইফতারের পর থেকে সাহরির সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে।  কমপক্ষে ৮-১২ গ্লাস পানি পান করুন।


রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগী কখন ওষুধ বা মেডিসিন নিবেন

ওষুধের পরিমাণ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণের সময় নির্ধারণ করতে হবে। এর জন্য আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ খাওয়ার সময় ঠিক নিলেই ভালো হবে। 
সকালে যে ওষুধ নিতেন, তা ইফতারের সময় নিবেন। আর রাতের ট্যাবলেট সাহরির সময় খাবেন। যদি দুপুরে ওষুধ নিতে হয়, তাহলে সেটা রাতে ঘুমানোর আগে নিতে পারেন।

আর ইনসুলিন নেওয়ার ক্ষেত্রে, সকালের ইনসুলিন ডোজটি ইফতারের কিছু সময় আগে যেমন- ইফতারের ১০-১৫ মিনিট আগে নিবেন। আর রাতের ইনসুলিন ডোজ নিবেন সাহরির সময়। ইনসুলিন নেওয়ার সময় সকালের ডোজের পুরোটাই ইফতারের আগে নিবেন। আর রাতের ডোজের অর্ধেক নিবেন সাহরির সময়। অর্ধেক ডোজ নেওয়ার কারণ হচ্ছে সাহরির পর সারাদিনে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রায় প্রভাব পড়বে, তাই অর্ধেক নেওয়া ঠিক। ইফতারের ১০-১৫ মিনিট আগে ইনসুলিন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। 


রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীর সতর্কতাঃ

  • খাবার তালিকা ঠিক করে নিতে হবে। অনিয়মিত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যাবে না। 
  • ভাজাপোড়া, চিনিযুক্ত বা মিষ্টিজাতীয় খাবার, ক্যাফেইন (চা, কফি) খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
  • রমজান মাসে রোজা রাখলে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি বার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা মাপতে হবে। অর্থাৎ অন্যান্য মাসে যদি দিনে ২ বার পরীক্ষা করেন, রমজান মাসে ৩-৪ বার পরীক্ষা করবেন। এতে রোজা নষ্ট হবে না বা রোজার ক্ষতি হবে না। 
  • রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৩.৯ মিলি মোল/লিটার এর নিচে চলে আসলে সাথে সাথে রোজা ছেড়ে দিতে হবে। নইলে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। গ্লুকোজের মাত্রা ১০ মিলি মোল/লিটার এর বেশি উঠে গেলেও রোজা ছেড়ে দিতে হবে। দুই অবস্থার কোনো একটি দেখা দিলে রোজা ছেড়ে দিয়ে বেশি বেশি তরল খাবার খেতে হবে।
  • সাহরি না খেয়ে রোজা রাখা ঠিক হবে না। 
  • ইফতারে একসাথে সব খাবার খেতে যাবেন না। কম করে খাবেন।
  • অধিক ক্যালরির খাবার কম খেতে হবে। 
  • রোজা রেখে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা যাবে না। 
  • ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে এবং রোজা রাখতে হবে।

আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বান্দার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। তাই অসুস্থ ও ক্ষতির আশংকা আছে এমন মানুষদের জন্য রমজান মাসে রোজা না রাখার বিধান রয়েছে। টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা না রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা। তাই কোনো ক্ষতি ও মারাত্মক অবস্থা এড়াতে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তবেই রোজা রাখতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url