কীভাবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হবেন? হতাশা মুক্ত থাকার উপকারী পদক্ষেপ
আজ আমার মন খারাপ, ভালো লাগছে না, মুড অফ, এই শব্দগুলো আজকাল কমন হয়ে গেছে। ছোট থেকে শুরু করে বয়সে বড়দের মধ্যেও এই কথাগুলো বলতে দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে ডিপ্রেশন (Depression) বা মানসিক বিষন্নতা, হতাশার লক্ষ্যণ। কীভাবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হবেন? হতাশা মুক্ত থাকার উপকারী পদক্ষেপ, ধর্মীয় ও সামাজিক উপায় সম্পর্কে এই আর্টিকেলে জানবেন।
বিষয়বস্তু গুলো
- ডিপ্রেশন কী? ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়।
- ডিপ্রেশন বা হতাশা থেকে মুক্তির ধর্মীয় ও সামাজিক উপায়।
- ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির মেডিসিন।
- চিকিৎসা
ডিপ্রেশন কী?
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে "কেমন আছো?" - বুকে পাহাড়সম কষ্ট, মনে অসংখ্য চাপ নিয়ে হাসি মুখে বলতে হয় ভালো আছি। কারও মন খারাপ, ডিপ্রেশনের গল্প শোনার জন্য সময় নেই অন্যদের।
তাই নিজের মন খারাপের জানান দিতে বেছে নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ততাও ডিপ্রেশন আরও বাড়িয়ে দেয়। তা থেকে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে এগোতে থাকে কেউ কেউ। মানসিকভাবে ভালো থাকা তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
ডিপ্রেশন এর কঠিন কোনো লক্ষ্যণ নেই। সচরাচর যে লক্ষ্যণগুলো কারও ডিপ্রেশনে থাকা নির্দেশ করে, সেগুলো হচ্ছে-
- সবসময় মন খারাপ, মনমরা থাকা।
- মেজাজ খারাপ থাকা।
- আত্মহত্যা প্রবণতা, জীবন নিয়ে হতাশ, অসহায়ত্ব।
- এই হাসি আবার এই কান্না করা।
- নিজেকে সম্মান না করে নিজেকে তুচ্ছ ভাবা ও মূল্যায়ন না করা।
- মনোযোগে ঘাটতি।
- অনিদ্রা বা ঘুম না হওয়া। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব।
- ক্ষুধামন্দা।
- ওজনের ভারসাম্য না থাকা। ওজনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে এটাতে গিয়ে দেখে নিন।
- বেশি শব্দ ও আলোতে বিরক্তি লাগা।
এগুলোই মূলত একজন ডিপ্রেশনে থাকা মানুষের সাধারণ লক্ষ্যণ।
ডিপ্রেশন কেন হয়?
বিভিন্ন কারণে একজন মানুষের উপর ডিপ্রেশন বা হতাশা ভর করতে পারে। যেমন- অতীতে করা কোনো অপরাধ বা বর্তমানে করা কোনো অপরাধ ও খারাপ কাজের জন্য নিজের মধ্যে অপরাধবোধ হওয়া, একাকীত্ব, জীবন নিয়ে হতাশ থাকা, ব্যর্থতা - এসব কারণে ডিপ্রেশন হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশন কোনো কঠিন রোগ নয়, এটি একটি মানসিক অবস্থা। মানসিক স্বাস্থ্যের বিরূপ অবস্থা।
why depression happens |
ডিপ্রেশনের প্রকারভেদ
ডিপ্রেশনের কয়েকটি প্রকার থাকে। সে অনুযায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা একেকজনের ডিপ্রেশনের মাত্রা নির্ণয় করে থাকেন। যে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ডিপ্রেশনের মাত্রা নির্ণয় করা হয়, সেগুলো হলো-
- স্বাভাবিক মাত্রার ডিপ্রেশন (Normal depression)।
- বড় বা গুরুতর মাত্রার ডিপ্রেশন ( Major depression)।
- ছোট বা কম মাত্রার ডিপ্রেশন (Minor depression)।
- অস্বাভাবিক মাত্রার ডিপ্রেশন (Atypical depression)।
সকল প্রকারের ডিপ্রেশনের লক্ষ্যণ একরকম হলেও স্থায়িত্ব কমবেশি হওয়ায় একেক প্রকার ডিপ্রেশনের মাত্রা একেক রকম।
হতাশা থেকে মুক্তির ধর্মীয় ও সামাজিক উপায় গুলো
ডিপ্রেশনে পড়লে মানুষ অসহায় হয়ে যায়। সবসময় নিজের মধ্যে হাহাকার আর শূন্যতা নিয়ে থাকে ডিপ্রেশনে পড়া মানুষেরা। এই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত থাকার অনেক উপায় রয়েছে। এখানে কার্যকরী কিছু উপায় নিয়ে বলা হলো-
১. মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা : প্রথমেই যেটা কটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে আগে নিজের মনকে ভালো ও স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় রাখা। কাজের চাপ, পড়াশোনার চাপ, সম্পদের চিন্তা, জীবন নিয়ে হতাশার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য দিনদিন খারাপ হতে থাকে যা ডিপ্রেশনে রুপ নেয়। এবং কেউ কেউ তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথে যায়। তাই উচিত আগে এসব চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। দিনের কাজ সময়মতো করে রাখা যাতে পরে তা চাপ হয়ে না যায়। জীবন আর সম্পদ নিয়ে দুশ্চিন্তা কমাতে হবে। অল্পতে তৃপ্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে, ভালো থাকতে হবে মানসিকভাবে ।
২. নিজের লক্ষ্য ঠিক করা : জীবনের কোনো লক্ষ্য ঠিক না করতে পারায় তাই বেশিরভাগ মানুষ জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা আর হতাশায় ভোগে। তাই নিজের কিছু ছোটখাটো লক্ষ্য ঠিক করুন যে আপনি সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণ করতে চেষ্টা করে যাবেন। এতে করে আপনার ব্যস্ততা বাড়বে। আর ব্যস্ততা বাড়লে মনে কোনো হতাশা বাসা বাঁধতে পারবে না। প্রতিদিন নিজের কাজের রুটিন অনুযায়ী লক্ষ্য ঠিক করুন, সেই রুটিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে চেষ্টা করুন।
৩. নিজের মতো বৈশিষ্ট্যের মানুষের সান্নিধ্য : ডিপ্রেশনে থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে নিজের মনের কথা, চাপা কষ্টের কথা কারও সাথে শেয়ার করতে না পারা। নিজের আশেপাশে নিজের মনের কথা খুলে বলে একটু মানসিক শান্তি পাওয়ার মতো মানুষের আজকাল অভাব। তাই দেখুন আপনার আশেপাশে আপনার ভালো লাগে আর আপনার নিজের বৈশিষ্ট্য আছে এমন কাউকে পান কি-না। যদি কিছু বৈশিষ্ট্যও থাকে কারও মধ্যে তার সাথে সময় কাটান। এতে নিজে হালকা হতে পারবেন। ভুল মানুষের সাথে না থাকায় ভালো। কারণ, A negative mind never give you a positive life.
৪. পরিবার ও কাছের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ : একটি মানুষের পেছনে সবচেয়ে বড় সাপোর্ট আর অবদান যার থাকে তা হচ্ছে নিজের পরিবার। দিনশেষে নিজের পরিবারই আপনাকে সকল বিপদে পাশে থাকে। আর একজন ভালো বন্ধু একটা লাইব্রেরির সমান। দিনদিন মানুষ পরিবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের ও বন্ধুদের কারও ভুল, দোষ পেলে সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি না করে তা বুঝিয়ে সংশোাধন করে পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখুন।
৫. প্রকৃতির সান্নিধ্য : প্রকৃতি মন ভালো করার এক দারুণ ঔষধ। নতুনকে জানা যায়, নতুন কিছু শেখা যায় বাইরে ঘুরতে যাওয়ার মাধ্যমে। তাতে মন ও মস্তিষ্ক ফ্রেশ হয়ে যায়। অতএব, চেষ্টা করুন ব্যস্ততার ফাঁকে একটু সময় বের করে অন্তত কাছের কোথাও ঘুরতে বের হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার।
৬. ডিপ্রেশনের বিপরীত কাজ করা : নিজের মধ্যে পজিটিভ মাইন্ডসেট বজায় রাখতে হবে। যখন মনে ও মাথায় কোনো দুশ্চিন্তা, হতাশা, বিষন্নতা ভর করবে তখন সেসব চিন্তাভাবনার বিপরীতে কাজ করতে চেষ্টা করুন। যেমন- যদি দুশ্চিন্তা হয় যে আমার দ্বারা কিছু হবে না বা আমি কিছু করতে পারবো না, তখন এর বিপরীতে চিন্তা করে কাজ করবেন যে " আমি অবশ্যই এটি করবো, আমার দ্বারা এটি সম্ভব"।
৭. শারীরিক পরিশ্রম : শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা শরীরের শক্তি সরবরাহ বাড়াতে সাহায্য করে এবং হরমোনের নিঃসরণে প্রভাব ফেলে। শারীরিক পরিশ্রমের ফলে মস্তিষ্ক ও শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়ে, যা ডিপ্রেশন দূর করতে সাহায্য করে। কঠিন কোনো পরিশ্রম না করলেও অন্তত সহজ কিছু খালি হাতের ব্যায়াম করতে চেষ্টা করুন। সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যায়াম করতে চেষ্টা করুন।
৮. স্বাস্থ্যকর খাবার : আপনার মানসিক অবস্থার উপর অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা। অতিরিক্ত জিংক উপাদান সমৃদ্ধ খাবার অবসাদ, রাগ সৃষ্টি করে। চেষ্টা করুন ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার। এবং সাথে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন।
৯. নতুন কিছু করা : প্রতিদিন নতুন কিছু শিখতে চেষ্টা করুন, নতুন কিছু করতে চেষ্টা করুন। আপনার স্কিল/দক্ষতা বাড়াতে থাকুন। নিজের পছন্দের কাজগুলো করুন, বই পড়ুন।
১০. ঘুম : ঘুম অবশ্যই সুস্থ থাকার এক মাধ্যম। ডিপ্রেশনে পড়লে ঘুমের ঘাটতি দেখা দেয়, ঘুমের অভাবে ডিপ্রেশন আরও বাড়তে থাকে। ভালো ঘুম হতে হবে। ১৮-৬৫ বছর বয়সী সবার উচিত কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো। ঘুমের মাধ্যমে দেহ পূর্ণ বিশ্রাম পায় ও নতুনভাবে কাজ করার উপযোগী হয়।
১১. ধৈর্য্য : কোনো কিছুর দ্রুত ফলাফল পাওয়ার আশায় ধৈর্য্য ধরে না থাকাও ডিপ্রেশন বাড়ায়। অল্পতে তৃপ্ত না থাকা, কাজে ধৈর্য্য না ধরা - এই কারণগুলো মানুষের হতাশা, লোভ বাড়িয়ে দেয়। "সবুরে মেওয়া ফলে"- কথাটা শুনেছেন নিশ্চয়। ধৈর্য্য রাখলে অবশ্যই ফল পাওয়া যায়। চেষ্টা করুন ধৈর্য্যশক্তি বাড়ানোর ও অল্পতে তৃপ্ত থাকার।
১২. নিজেকে ভালোবাসা : নিজেকে ভালোবাসতে না পারলে কখনোই ভালো থাকা আর তৃপ্ত থাকা যায় না। অন্যকে ভালোবাসার আগে অবশ্যই নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজেকে মূল্যায়ন করতে হবে, নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে হবে, নিজের মধ্যে পজিটিভ মাইন্ডসেট রাখতে হবে। কেউ একজন বলেছেন- "Once you know how to enjoy your own company, then no one's absence will hurt you."
ডিপ্রেশন মুক্তির ধর্মীয় যে উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারেন
আপনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলে কুরআন তিলাওয়াত করুন, তিলাওয়াত শুনুন, নামাজ পড়ুন। এই কাজগুলো মন ভালো করার বুস্টার হিসেবে কাজ করে।
অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা যার যার ধর্মীয় কাজকর্ম ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার মাধ্যমে মানসিক অবস্থা ভালো করতে পারেন।
সকল ধর্মেই মানুষের সেবা করার কথা ও মানুষকে মাফ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারও প্রতি রাগ, অভিমান, ক্ষোভ, হিংসা, প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা থেকেও ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হয়। মাফ করার মাধ্যমে এই অবস্থা দূর করা যায়। ক্ষমা একটি মহৎ গুণ।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত থাকার মেডিসিন ও চিকিৎসা
এটি জটিল কোনো রোগ নয়, উপরের উপায়গুলো অবলম্বন করার মাধ্যমেই মানসিক এই অবস্থা দূর করা যায়। কোনো মেডিসিন নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে যদি ডিপ্রেশনের মাত্রা বেশি হয় এবং কয়েক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়, তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। সাইকিয়াট্রিস্টরা কাউন্সেলিং করার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বিরূপ অবস্থা থেকে বের করার চেষ্টা করেন।
সবশেষে
ডিপ্রেশন কতটা ভয়ানক, তা শুধু ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিই জানেন। কারও ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থাকে হালকাভাবে না নেওয়াই ভালো মানসিকতার প্রকাশ।
এতক্ষণ আপনাদেরকে কীভাবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত থাকবেন ও হতাশা মুক্ত থাকার উপকারী পদক্ষেপ, ধর্মীয় ও সামাজিক উপায় গুলো সম্পর্কে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। উপরের উপায়গুলো মেনে চললে নিজের মানসিক সেই দূর্দশা থেকে বের হয়ে আসুন। নিজেকে ভালোবাসুন। দিনশেষে আপনিই আপনার জন্য। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন।