চুল পড়া বন্ধ করার উপায় কী? চুল পড়া বন্ধ করার খাবার ও মেডিসিন।

চুল পড়া বন্ধ করার উপায় কী?
stop hair fall

মানুষের জীবনের মতো চুলেরও জীবনচক্র আছে। বড় হওয়া, বিশ্রাম নেওয়া ও তারপর ঝরে পড়া- এ নিয়েই চুলের জীবন। অন্যান্য কিছু কারণেও চুল পড়া একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক এই যুগে মানুষের মধ্যে চুল পড়া এক বিরাট আকারের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুল পড়ার সমস্যা থেকে প্রতিকার পেতে অনেকেই অনেককিছু করে থাকে। এই আর্টিকেলে চুল পড়া বন্ধ করার উপায় কী? চুল পড়া বন্ধ করার খাবার ও মেডিসিন সম্পর্কে জানতে পারবেন।


যা যা জানবেন এই আর্টিকেলে -
  • কেন চুল পড়ে? চুল পড়ার কারণ। 
  • চুল পড়া বন্ধ করার কার্যকর উপায় কী? নারী-পুরুষ সবার জন্য। 
  • চুল পড়া বন্ধ করতে চিকিৎসা। 
  • চুল পড়া বন্ধ করার খাবার ও মেডিসিন। 
  • সচেতনতা ও করণীয়গুলো।

কেন চুল পড়ে? চুল পড়ার কারণ। 

শুরুতেই বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবনের মতো চুলেরও জীবনচক্র রয়েছে। মানুষের মাথার চুলের জীবনচক্র ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে চুল ছোট থেকে বড় হয়, বিশ্রাম নেয়, ঝরে যায়। পরে আবার নতুন চুল সেই ঝরে যাওয়া চুলের জায়গা পূরণ করে। যখন চুলের এই জীবনচক্রে বাঁধার সৃষ্টি হয়, তখনই চুল তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকে ও ঝরে পড়তে থাকে। একজন মানুষের দিনে ১০০ টির আশেপাশে চুল পড়া স্বাভাবিক। এর বেশি চুল পড়লে সেটাকে অস্বাভাবিক বলা হয়। 

কথা হচ্ছে- চুল কেন পড়ে? চুল পড়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি দায়ী সেটি হচ্ছে বংশগতির প্রভাব। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বংশগত কারণে বেশিরভাগ মানুষের চুল পড়ে। 

দ্বিতীয় যে কারণটি বেশি কাজ করে সেটি হচ্ছে চুলের জীবনচক্রের বিশ্রাম নেওয়ার দশা। এই দশায় চুল পড়ার সমস্যা দেখা যায় যেটাকে Telogen Effluvium বলা হয়। এই অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো- মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, গর্ভধারণকাল বা প্রেগন্যান্সির সময়, বিভিন্ন মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও শরীরে কোনো রোগ।
আরও যেসকল কারণে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো হচ্ছে - পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, খাবারে পুষ্টির অভাব, চুলের যত্ন না নেওয়া, মাথার ত্বকে কোনো চর্মরোগ, নারীদের পিরিয়ড জনিত সমস্যা, কেমোথেরাপি, সিফিলিস, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি কারণে চুল পড়ার সমস্যা হতে পারে। 

চুল পড়া বন্ধ করা সম্ভব জীবনযাপনের কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করার মাধ্যমে। তবে বংশগত কারণে, থাইরয়েডের সমস্যার কারণে চুল পড়লে তা বন্ধ করা কঠিন। তবুও কিছু মেডিসিনের মাধ্যমে ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবণা থাকে। সে সম্পর্কে শেষের দিকে জানতে পারবেন।


চুল পড়া বন্ধ করার উপায় কী?


চুল পড়া বন্ধ করার কার্যকর উপায়

অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করার ফলে ত্বক তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। তাই রাসায়নিক বা কেমিক্যাল পণ্য যত সম্ভব পরিহার করতে পারলেই ভালো। 
চুল পড়া বন্ধ করতে যে কার্যকর ঘরোয়া উপায়গুলো অবলম্বন করে ফলাফল পাওয়া যায় বলে প্রমাণিত হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে এখন আপনাদের বলা হবে।

১. খাবার : আপনি প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় কী রাখছেন আর কী খাচ্ছেন তা আপনার চুলে প্রভাব ফেলে। কী কী খাবার চুল পড়া প্রতিরোধে কাজ করে তা পরে বলা হয়েছে, পড়তে থাকুন। 

২. মাথা ও মাথার ত্বক মালিশ করা : মাথা ম্যাসেজ বা মালিশ করে শুধু আরাম পাওয়া যায় না,  এতে চুলের জন্যও উপকার করে। কারণ, মালিশের ফলে চুলের গোঁড়ায় রক্ত চলাচল বাড়ে যা চুলের সুস্থ স্বাস্থ্যের জন্য দরকারী। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩-৪ মিনিট মাথা ও মাথার ত্বক মালিশ করার চেষ্টা করুন।

৩. রাসায়নিক ব্যবহার : চুলের  গোড়াতে কেরাটিন (Keratin) নামক একধরণের প্রোটিন কণা রয়েছে। চুলে অতিরিক্ত রাসায়নিক বা কেমিক্যাল পণ্য ব্যবহার করলে সেই প্রোটিন কণাগুলো উঠে গিয়ে চুল পড়ার সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই চুলে বিভিন্ন কেমিক্যাল যেমন- জেল, পারঅক্সাইড ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করা কমাতে হবে। ব্যবহার না করাই বেশি ভালো। 

৪. হেয়ার ড্রায়ার ও শ্যাম্পু : এগুলো চুলে ব্যবহারের কারণে চুলের স্বাভাবিক মসৃণতা হারায়। শ্যাম্পুতে একাধিক রাসায়নিক উপাদান থাকে যা চুলের জন্য ক্ষতিকর হয়। শ্যাম্পু ব্যবহারে সচেতন হতে হবে, নিজের চুলের সুবিধা অনুযায়ী শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। সপ্তাহে ২ বার শ্যাম্পু করলেই যথেষ্ট। ঘরোয়া উপায়ে তৈরি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান সমৃদ্ধ ভেষজ শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

৫. ভেষজ প্রাকৃতিক তেল : ভেষজ উপাদানযুক্ত উদ্ভিদ থেকে তৈরি করা তেল ব্যবহার করা চুলের জন্য উপকারী। কারণ এসব তেলে ভেজাল থাকে না, এগুলো ভেষজ প্রাকৃতিক গুণাগুণ সম্পন্ন। চা গাছ থেকে তৈরি তেল, ল্যাভেন্ডার অয়েল, আমলকীর তেল ও আরও সুগন্ধিযুক্ত যে ভেষজ তেল আছে তা ব্যবহার করা চুলের জন্য ভালো।

৬. নারিকেল তেল ও অলিভ অয়েল : সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো উপাদান নারিকেল তেলে আছে যা চুল পড়া প্রতিরোধে কাজ করে। নারিকেল তেলে পাওয়া লরিক অ্যাসিড (Lauric acid) চুলের পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করে। জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল চুলকে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। এই তেলগুলো চুলে ব্যবহার করুন।

৭. পেঁয়াজের রস : চুল পড়া বন্ধ করতে ও নতুন চুল গজাতে পেঁয়াজের রস ৮৭% পর্যন্ত কার্যকর। পেঁয়াজের এত কার্যকারিতার গুণটির জন্য যেটির অবদান বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সেটি হচ্ছে " সালফার"। পেঁয়াজ একটি সালফারযুক্ত উপাদান। গোসলের আগে মাথার ত্বকে পেঁয়াজের রস লাগিয়ে তা গোসলের সময় শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কিছুদিন ব্যবহার করতে থাকলে ফলাফল আপনি নিজেই দেখতে পারবেন।

৮. ডিমের কুসুম : প্রোটিনযুক্ত একটি উপাদান ডিম। চুলে ডিমের কুসুম ব্যবহারের মাধ্যমে চুল পড়া প্রতিরোধের সমাধান পেয়েছে বলেই অনেকে মতামত দিয়েছে। 

৯. ভিটামিন ও খনিজ উপাদান : চুলের বৃদ্ধি ও চুলের উন্নতির জন্য বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদান এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই উপাদানগুলো সবগুলো একসাথে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না বলে এর পরিপূরক হিসেবে কিছু উপাদান ব্যবহার করা যায়। ভিটামিন-ই, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, আয়রন, জিংক, বায়োটিন এই উপাদান গুলো মেডিসিন হিসেবে গ্রহণ করা যায় পরিপূরক উপাদান হিসেবে। 


চুল পড়া বন্ধ করতে চিকিৎসা

লেজার ও প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে চুলের ঘনত্ব বাড়িয়ে চুল পড়া প্রতিরোধ করা যায়। বর্তমান যুগে চুল প্রতিস্থাপন (Hair Transplant) পদ্ধতি বেশি নিয়ে থাকে মানুষ চুল পড়ার সমস্যার সমাধান করতে।


চুল পড়া বন্ধ করার খাবার


চুল পড়া বন্ধ করার খাবার ও মেডিসিন

প্রোটিন ও বায়োটিন 
:
ডিম একটি পরিপূর্ণ খাদ্য। ডিমে রয়েছে প্রোটিন ও বায়োটিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দু'টি উপাদান। চুলের গোঁড়ার কোষে থাকে প্রোটিন আর প্রোটিনের একটি অংশ হলো কেরাটিন। চুলের সুস্বাস্থ্যের জন্য তাই প্রোটিন ও বায়োটিন সমানভাবে প্রয়োজন। ডিম তেমনই একটি খাবার যা একসাথে এই দু'টি খাদ্য উপাদান জোগান দেয়। বিভিন্ন মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ যেমন- স্যালমন, টুনা ইত্যাদি মাছে প্রোটিন ও ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আছে। অন্যান্য মাছগুলো ও মুরগির মাংস, গরুর মাংস প্রোটিনের উৎস। এগুলো খেলে চুলে পুষ্টি জোগাবে ও চুল পড়া প্রতিরোধে কাজ করবে।
আঁশযুক্ত খাবার :

বিভিন্ন শাক-সবজি, ফলমূলে আঁশ বা ফাইবার রয়েছে। পরিপাক ক্রিয়া ভালো রাখতে আঁশযুক্ত খাবার ভূমিকা পালন করে। পরিপাক ক্রিয়া ভালো হলে তা চুলের পুষ্টিতেও অবদান রাখবে। 

নির্দিষ্ট করে বললে যে খাবারগুলো খাওয়া চুলের জন্য ভালো সেগুলো হচ্ছে- ডিম, মাছ, মাংস, গাজর, পালংশাক, মিষ্টি আলু, মটরশুঁটি, অ্যাভোকাডো, কাজুবাদাম, চিনাবাদাম, আখরোট, জাম, স্ট্রবেরি, আঙুর, ওটস, মসুরের ডাল। এই খাবারগুলো ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-ই, আয়োডিন, বায়োটিন, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অন্যান্য আরও খনিজ উপাদানে ভরপুর। 


মেডিসিন

কার কোন সমস্যা আছে তা শুধু ডাক্তারের কাছে গেলেই জানা সম্ভব। তাই চুলের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক মেডিসিন নেওয়া ভালো হবে। আমরা কোনো কোম্পানি বা পণ্যের প্রচার করি না, তাই নির্দিষ্ট কোনো মেডিসিনের কথা উল্লেখ করছি না। কোন মেডিসিন কার উপর কেমন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া করবে তা ভেবেই এখানে নির্দিষ্ট কোনো মেডিসিনের কথা উল্লেখ করা হয় নি।

সচেতনতা ও করণীয়গুলো

  • কেমিক্যাল সামগ্রী ব্যবহার কমাতে হবে। নিয়মিত চুল শ্যাম্পু ব্যবহার করে পরিষ্কার না করে সপ্তাহে ২ বার শ্যাম্পু ব্যবহার করা ভালো।
  • ভুলভাবে ও ভুল স্টাইলে চুল রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভেজা চুল আঁচড়ানো যাবে না। 
  • চিন্তামুক্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে। 
  • মাথার ত্বক তৈলাক্ত ও ঘর্মাক্ত রাখা উচিত নয়।
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন নিতে হবে। 
  • ধুমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • আলো-বাতাস পূর্ণ পরিবেশে থাকা উচিত। বসতবাড়িতে আলো-বাতাস ব্যবস্থা ভালো না থাকলে বাইরে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে হবে। 
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে। দৈনিক কমপক্ষে ৮-১২ গ্লাস।
  • পর্যাপ্ত ঘুম হতে হবে। ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ঘুম ভালো পেতে চাইলে
  • শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত করতে কাজ করে। প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করা শরীরের জন্য উপকারী। ব্যায়াম করেও শারীরিক পরিশ্রম করা যায়।

সবশেষে

এই আলোচনায় আপনাদেরকে চুল পড়া বন্ধ করার উপায় কী? চুল পড়া বন্ধ করার খাবার ও মেডিসিন সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। উপরিউক্ত উপায়গুলো অবলম্বন করে বেশিরভাগ মানুষ সুফল পেয়েছে এবং গবেষকদের কাছে উপযোগী প্রমাণিত হয়েছে বলে এই উপায়গুলো আপনাদের কাছে বলা যাতে আপনারা উপকৃত হোন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url