হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয় কী? হার্ট অ্যাটাকের কারণ, লক্ষ্যণ

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয়
prevention of heart attack

বর্তমান বিশ্বের মানুষদের ভয়ংকর ও মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে হার্টের রোগ এর অবস্থান শীর্ষ  তালিকায় আছে। হার্টের রোগের একাধিক ধরণ আছে। যেমন- হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এই আর্টিকেলে আপনারা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয় কী? হার্ট অ্যাটাকের কারণ, লক্ষ্যণ ও সতর্কতা সম্পর্কে জানবেন।
What to do to prevent the risk of a heart attack?


হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) এর আরেক নাম Myocardial infarction. 
হৃদপিণ্ডের (Heart) কোনো রক্তনালির বা শিরার মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল করতে বাঁধার সৃষ্টি হলে তখন হার্ট অ্যাটাক হয়। যে কোনো বয়সের মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এই যুগে কমবয়সীদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলেও হার্ট অ্যাটাক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলেই মরণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

হার্ট অ্যাটাকের কারণ ও ঝুঁকি

অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, বয়স, মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure), উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল  ইত্যাদি কারণে যে কারও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। একটা বয়স পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব, কিন্তু সেই বয়সের পর হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যায়। 

৪৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং ৫৫ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি প্রতিরোধ করা কঠিন। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি। কারণ, এস্ট্রোজেন (Estrogen) হরমোন নারীদেরকে হার্ট অ্যাটাক নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে, যা পুরুষদের মধ্যে কম। আর যদি কারও বংশগতভাবে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ইতিহাস অর্থাৎ পরিবারের কারও হার্ট অ্যাটাক- এর সমস্যা থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে যায়, সেক্ষেত্রেও এটি প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যায়।


কীভাবে বুঝবেন হার্ট অ্যাটাকের সমস্যা আছে কি-না, লক্ষ্যণগুলো-
  • হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় ও যে লক্ষ্যণটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেটি হচ্ছে বুকে চাপ লাগা। বুকে চাপ অনুভব হওয়া, বুকে ব্যথা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের মূল লক্ষ্যণ। 
  • শরীরের পেছনের অংশ যেমন- ঘাড়, পিঠে ব্যথা ও অস্বস্তি। শরীরের বাহুগুলোতেও ব্যথা ও অস্বস্তি হতে পারে। 
  • চোয়ালে ব্যথা। 
  • হার্টবিট অস্বাভাবিক হওয়া। শ্বাসকার্য ছোট হওয়া।
  • অবসাদ, বিষন্নতা, বুক ধড়ফড় করা।
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ও ঘামের ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। 
  • চোখে ঝাপসা দেখা।
  • শরীরের উপরের অংশের অন্যান্য অঙ্গেও ব্যথা হতে পারে। 
  • পেটের সমস্যা যেমন- পেটে ব্যথা, জ্বালাপোড়া, পাতলা পায়খানা হতে পারে। বমিও হতে পারে। 
বয়স ও লিঙ্গভেদে লক্ষ্যণসমূহের তারতম্য হয়ে থাকে। নারীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষ্যণগুলো বেশি অস্বাভাবিক হয়।


হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয়

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা যায়। আপনার  জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমেই ঘাতক এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।

স্বাস্থ্যকর খাবার-
  • বেশি পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার (Fiber) খাবার খেলে কোলেস্টেরলের মান নিয়ন্ত্রণে থাকে ফলে হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি কমানো যায়। আঁশযুক্ত খাবারে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে কাজ করে। ডালজাতীয় ও বীজজাতীয় খাবারগুলোতে উচ্চ আঁশ বা ফাইবার থাকে। বিভিন্ন ডাল, মটরশুঁটি, শিম, আলু, খেজুর, বাদাম, বিভিন্ন ফলমূল, শাক-সবজি ( বিশেষ করে সবুজ শাক-সবজি) বেশি করে খেতে হবে। ভাত ও রুটিও খেতে পারেন কিন্তু বেশি পরিমাণে খাবেন না। 
  • যেসব মাংসে চর্বি কম এবং চর্বি নেই, সেই মাংস খেতে হবে। যেমন- মুরগির মাংস। গরুর, ছাগলের, মহিষের মাংসে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে বাঁধা সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণ এসব লাল মাংসে সম্পৃক্ত বা জমাটবদ্ধ চর্বি থাকে যা কোলেস্টেরলের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই গরু, মহিষ, ছাগলের মাংস খেতে হলে চর্বিমুক্ত করে খেতে হবে। 
  • তেলযুক্ত মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ খাওয়া ভালো। কারণ এসবে থাকে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা মানবদেহের জন্য দরকারী খাদ্য উপাদান। 
  • স্বাস্থ্যকর চর্বি বা ফ্যাট রয়েছে এমন খাবারগুলো খাওয়া যায়। তবে কোনোভাবেই অতিরিক্ত চর্বি ও তৈলাক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। 
  • অলিভ অয়েল খাবেন, এই তেল দিয়ে তরকারি রান্না করে খেতে পারেন। 
  • দুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে দুধের চর্বির আস্তরণ সরিয়ে খেতে হবে। দুধে চিনি দিয়ে খাওয়া যাবে না একদমই। 
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে। 

শারীরিক পরিশ্রম

সুস্থ থাকতে যেমন শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনি হার্ট ভালো রাখতেও এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা শারীরিক পরিশ্রম করতে চেষ্টা করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হার্টের অন্যান্য রোগ থেকে মুক্ত থাকতে শারীরিক পরিশ্রম গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ওজন নিয়ন্ত্রণ করতেও পরিশ্রমের ভূমিকা আছে। 
ঘরের সাধারণ কাজগুলো করবেন এতে শারীরিক পরিশ্রম হবে। এছাড়া সহজ কিছু ব্যায়াম করা যায়, যেমন- হাঁটা, জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, স্ট্রেচিং করা।

মানসিক স্বাস্থ্য

মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ, বিষন্নতা, রাগ, কাজের চাপ এসব কমাতে হবে। সবসময় চাপমুক্ত থাকতে হবে। জেনে নিন-  মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়

রক্তচাপ

রক্তচাপ (Blood pressure) নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপের সাধারণত তেমন কোনো লক্ষ্যণ নেই। তাই উচ্চ রক্তচাপ আছে কি-না তা পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিয়ে সচেতন হতে হবে। ১৮-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। প্রতি ২ বছরে অন্তত ১ বার হলেও রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত সবার। 

কোলেস্টেরল

কোলেস্টেরল এর মাত্রা ২০০ এর বেশি হলে ও ৪০ এর কম হলে তা হার্ট অ্যাটাকের ক্ষতি বাড়িয়ে তুলে। কোলেস্টেরলের মাত্রা কেমন তা ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর উপায়ে জীবনযাপন করতে হবে। ২০ বছর বয়স থেকে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রায় প্রভাব পড়তে শুরু করে। তাই ৪ অথবা ৬ বছরে ১ বার রক্তে কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা উচিত। 

ওজন নিয়ন্ত্রণ

অতিরিক্ত ওজন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কেমন হওয়া স্বাভাবিক তা জেনে নিতে হবে। বিএমআই মান নির্ণয় করে নিজের জন্য সঠিক ও স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখতে হবে। BMI মান ২৫ এর বেশি হলে ওজন কমিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। আর শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট থাকলেও তা কমিয়ে আনতে হবে। কোমরের মাপ দেখে বোঝা যায় কেমন ফ্যাট আছে। 

পুরুষদের কোমরের মাপ ৪০ ইঞ্চির বেশি হলে ও মহিলাদের কোমরের মাপ ৩৫ ইঞ্চির বেশি হলে যথা সম্ভব তা কমাতে হবে। নইলে তা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবণা বাড়াতে পারে।
জেনে নিন- 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

পারিবারিকভাবে কারও ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে ও পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে অবশ্যই উপযুক্ত চিকিৎসা নিয়ে ডায়াবেটিস মুক্ত থাকতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। অতিরিক্ত ওজন ও পরিবারের কারও ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে অবশ্যই নিজের ডায়াবেটিস আছে কি-না তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।

ঘুম

সুস্থ থাকতে চাইলে ও হার্টের সুস্থতা বজায় রাখতে হলে অবশ্যই পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম হতে হবে।


সতর্কতা


যে খাবারগুলো খাবেন না ও খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করবেন-
  • চর্বি জমাট বাঁধে এমন খাবার খাওয়া কমাতে হবে। খাওয়া বাদ দিলে বেশি ভালো। চর্বি জমাট বাঁধে বা উপরে চর্বি জমা হয় এমন খাবারগুলো হলো- গরুর মাংস, মহিষের মাংস, বিস্কুট, কেক, ক্রিম, ঘি, মাখন ইত্যাদি। এগুলোকে Satured fat খাবার বলা হয়। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে হলে এসব খাওয়া বাদ দিতে চেষ্টা করতে হবে। 
  • অতিরিক্ত চিনি ও লবণ খাওয়া উচিত নয়। দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম ( হিসেবে ১ চা চামচ) লবণ খাওয়া যেতে পারে। তবে চেষ্টা করতে হবে কম খাওয়ার। চিনিযুক্ত খাবারও খাওয়া বাদ দিতে হবে। 
  • কার্বোহাইড্রেট খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বেশি খাওয়া যাবে না। যেমন- ভাত, রুটি।
আরও সতর্কতা
  • অ্যালকোহল ও তামাক গ্রহণ করা যাবে না। ক্ষতিকর এসব উপাদানযুক্ত ড্রিংকস, সিগারেট, বিড়ি, ও ধুমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। 
  • অতিরিক্ত ওজন ও মেদ কমাতে হবে। এর জন্য শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করতে হবে। 
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার তালিকা তৈরি করে নিয়ে সেভাবে খেতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো মেডিসিন নেওয়া যাবে না। 
এই কাজগুলো করার মাধ্যমে যেকোনো বয়সে হার্ট অ্যাটাক ও হার্টের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

শেষকথা

ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এই বিষয়গুলোকে অবহেলা না করে পরীক্ষার মাধ্যমে তা জেনে নেওয়া এবং সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বন করে জীবনযাপন করা উচিত। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয় অবলম্বন করে রোগীর জীবন বাঁচাতে সতর্ক হওয়া রোগী ও রোগীর পরিবার সবারই উচিত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url