কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়? ঘুমের সমস্যার প্রতিকার

কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়?
proper sleep.

প্রযুক্তির যুগে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম করার হার যেমন কমে যাচ্ছে, সেই সাথে ঘুমের মধ্যেও এসেছে পার্থক্য। ঘুমের ঘাটতিতে ভুগছে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু কেন ঘুমের ঘাটতি বা ঘুমের পরিমাণে পরিবর্তন হচ্ছে? ঘুম না আসার কারণ : কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়, ঘুমের সমস্যার প্রতিকার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিন এই আর্টিকেল পড়ে।


যে বিষয়গুলো জানবেন
  • ঘুম না আসার কারণ কী? 
  • অভাবে যে সমস্যাগুলো হয়।
  • বয়স অনুযায়ী কার কত ঘণ্টা ঘুম দরকার। 
  • কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়? 
  • তাড়াতাড়ি ঘুম পাওয়ার কিছু কৌশল (Tricks)।

ঘুম না আসার কারণ 

কারও ঘুম না আসার ও পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। বয়স, আবহাওয়া, পরিবেশ, খাবার, পরিশ্রম, রোগ, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি কারণে মানুষের ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।


ঘুমের অভাবে যে সমস্যাগুলো হয়

ঘুমের অভাবে ইনসমনিয়ার (Insomnia) মতো ভয়ংকর সমস্যা দেখা দিতে পারে। যা পরবর্তীতে কারও মানসিকতার উপর হিংস্র মনোভাবের সৃষ্টি করে। ঘুমের ঘাটতি হলে সচরাচর যে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে-
  • মনোযোগের ঘাটতির সৃষ্টি হয়। কোনো কিছু তে পূর্ণ মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়।
  • স্মরণশক্তি কমতে থাকে। কোনো কিছু মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। 
  • মানসিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। মেজাজ হারিয়ে ফেলে। 
  • সহ্যশক্তি কমে যায়। 
  • পরিবার ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্কে অবনতির সৃষ্টি হয়। 
  • শরীরে শক্তি কমে যেতে থাকে। 
  • ওজন বাড়িয়ে তুলে। ওজন নিয়ন্ত্রিত রাখা যায় না।
  • কোনো কিছু থেকে বা কারও কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভের আগ্রহ কমে যায়। ফলে জীবনে এগিয়ে চলার পথে পূর্ণ মানসিক জোর থাকে না।
  • চোখের নিচে কালো দাগ বা ডার্ক সার্কেল হয়।
  • চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব, মলিনতা দেখা যায়।
  • অরুচি, ক্ষুধামন্দা।
  • হার্টের বিভিন্ন রোগ, ডায়াবেটিস এর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 
  • শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় খারাপ প্রভাব ফেলে। 
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়া।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে উক্ত সমস্যাগুলো দেখা দেয়। ব্যক্তিভেদে সমস্যার ধরণ ও মাত্রার পার্থক্য হয়ে থাকে।

 

বয়স অনুযায়ী ঘুমের পরিমাণ 

শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সী মানুষের জন্য উপযুক্ত ও সঠিক ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পরিপূর্ণ ঘুমের পরিমাণ বলা হয় ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। কিন্তু বয়সভেদে পরিমাণে পার্থক্য হতে পারে। নিচে বিভিন্ন বয়সীদের ঘুমের পরিমাণ দেওয়া হলো-

সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে ৩ মাস বয়স পর্যন্ত - ১৪-১৭ ঘন্টা। 
৪-১১ মাস বয়স পর্যন্ত  ১২-১৫ ঘণ্টা। 
১-২ বছর বয়স পর্যন্ত  ১১-১৪ ঘণ্টা। 
৩-৫ বছর বয়স পর্যন্ত  ১০-১৩ ঘণ্টা। 
৬-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত  ৯-১১ ঘণ্টা। 
১৪-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত  ৮-১০ ঘণ্টা। 
১৮-৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত  ৭-৯ ঘণ্টা। 
৬৫ এর উর্ধ্বে বয়সীদের  ৬-৮ ঘণ্টা।

এর কম হলে তা পরিপূর্ণ ঘুম না। চেষ্টা করতে হবে বয়স অনুযায়ী উপরের স্কেল লক্ষ্য করে পর্যাপ্ত ঘুমানোর। সময় ভাগ করে নিয়ে ঘুমিয়েও ঘুমের ঘাটতি পূরণ করা যায়। যেমন- কেউ যদি রাতে ৬ ঘণ্টা ঘুমায়, তাহলে দিনের বেলা বাকি ২/৩ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। 


কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়?
proper sleep. 

কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায়? 

ভালো ঘুম পেতে হলে জীবনযাপনের কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ঘুম না আসার যে কারণগুলো বলা হয়েছে, সেই কারণগুলো জীবনযাপনের ধরণ পরিবর্তনের মাধ্যমেই সমাধান করা যায় এবং পর্যাপ্ত ঘুম পাওয়া যায়।
ভালো ঘুম পাবার কিছু কার্যকর উপায় সম্পর্কে বলা হলো-

১. ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক আবহাওয়াঃ খুব গরম, আবার খুব শীত কোনো আবহাওয়া ভালো ঘুম হতে দেয় না। তাই ভালো ঘুম পেতে হলে ঘরের তাপমাত্রা অর্থাৎ আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ অথবা আরামদায়ক রাখতে হবে। গরমে ফ্যান ও এসি ব্যবহার করে আবহাওয়া ঠিক রাখা যায়, শীতে গরম কাপড় গায়ে দিয়ে উষ্ণ আরামদায়ক থাকা যায়। যা ভালো ঘুম পেতে সাহায্য করে। 

২. ঘুমানোর পরিবেশঃ পরিবেশ বেশি আলোকময় হলে তা ঘুমাতে সমস্যা করে। লাইটের আলো, সূর্যের আলোর কারণে চোখে ঘুম তৈরি করতে বাঁধা সৃষ্টি করে। আবার বেশি অন্ধকারে অনেকেই ভয় পায়। ভালো ঘুম পেতে হলে তাই ঘরের পরিবেশ এমন করে নিতে হবে যাতে চোখে বিরক্তি তৈরি না করে এবং ভয়মুক্ত থাকা যায়। এজন্য ঘরে ডিম লাইট ব্যবহার করে আবছা আলোর পরিবেশ বানাতে পারেন। ভালো ঘুম পেতে অনেকেই এই ব্যবস্থা করে থাকে। অথবা অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে পারেন। কোলাহল নেই, হৈচৈ নেই, যানবাহনের শব্দ নেই এমন কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নির্বাচন করতে পারলে ভালো।

৩. খাবারঃ খালি পেট অথবা ভরাপেট উভয়ই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এর জন্য ঘুম আসতে দেরি হয়। ঘুমানোর কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেয়ে নিন। ঘুমানোর ২ ঘণ্টা আগে খাবার খেলে তা ঘুম আসার উপর প্রভাব ফেলে এবং ঘুমের মধ্যে বিপাক কার্য ভালোভাবে সম্পন্ন হতে পারে। আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার চেষ্টা করা ভালো।

৪. চা, কফিঃ সন্ধ্যার পর ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার চা, কফি যত সম্ভব না খেতে চেষ্টা করুন। এসব খাবার ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দেহকে জাগিয়ে রাখতে অর্থাৎ ঘুম ও ক্লান্তি আসা থেকে বিরত রাখে। ঘুমানোর অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা আগে থেকে চা, কফি পান করা  বিরত রাখুন।

৫. ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ব্যবহারঃ স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টিভি, ভিডিও গেইম ইত্যাদি ইলেকট্রনিকস ডিভাইস গুলো থেকে ক্ষতিকর নীল আলো চোখের বিশ্রাম নেওয়া কমিয়ে দেয় ফলে অনিদ্রা দেখা যায়। ঘুমানোর ২-৩ ঘণ্টা আগে থেকে এসব ডিভাইস ব্যবহার করা বাদ দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকুন। নীল আলো থেকে চোখকে সুরক্ষিত রাখতে "ব্লু লাইট ফিল্টার " ও অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ভালো হয়।

৬. শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামঃ পরিশ্রম ও ব্যায়াম শুধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করতেই কাজ করে না, ভালো ঘুম হওয়াতেও কাজ করে। দৈনন্দিন শারীরিক পরিশ্রম করা না হলে দিনে কমপক্ষে ৩০-৬০ মিনিট ব্যায়াম করতে চেষ্টা করুন। যোগব্যায়াম (Yoga) করলে মস্তিষ্ক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়। তবে অবশ্যই ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যায়াম করবেন না। দিনের শুরুতে বা সন্ধ্যার দিকে করতে পারেন।

৭. দিনের আলোঃ দিনের আলো বলতে বাইরের আলো-বাতাস পূর্ণ পরিবেশে সময় কাটানো। এটি করলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ভালো ঘুম পেতেও সাহায্য করে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টা বাইরের আবহাওয়ায় কাটান, প্রকৃতি উপভোগ করুন।

৮. দিনের বেলা ঘুমঃ রাতে ভালো ঘুম পেতে চাইলে দিনের বেলা ঘুমানো থেকে বিরত থাকুন। কাজের ক্লান্তিতে যদি একটু ঘুমাতে চান, শরীরকে তন্দ্রাভাব কাটিয়ে চাঙা করতে চান তাহলে খেয়াল রাখুন ৩০-৪০ মিনিটের বেশি যেন ঘুম না হয় দিনের বেলায়।

৯. সময়ানুবর্তিতাঃ প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে চেষ্টা করুন। রাত ১১ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত ঘুমের রুটিন থাকা সবচেয়ে ভালো। 

১০. মানসিক স্বাস্থ্যঃ কাজের চাপ, হতাশা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, মন ভালো না থাকা ইত্যাদি কারণে ঘুমে তৃপ্তি পাওয়া যায় না, ঘুম আসতে চায় না। তাই চেষ্টা করুন মানসিকভাবে ভালো থাকতে

১১. ঘুমজনিত কোনো সমস্যাঃ ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, নাকডাকা, গলায় শব্দ হওয়া, ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট এগুলো স্লিপ অ্যাপনিয়ার ( Sleep apnea) মতো জটিল সমস্যার লক্ষ্যণ। আপনার এরকম কোনো সমস্যা থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।


তাড়াতাড়ি ঘুম পাওয়ার কিছু কৌশল 

  • হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিতে পারলে শরীরে আরাম অনুভব হবে ও ঘুম পাবে।
  • ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বই পড়তে চেষ্টা করুন, এতে চোখ ও মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য চোখে ঘুম ভর করবে।
  • শুয়ে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো উল্টো করে গুণতে পারেন। ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭... এভাবে গুণতে থাকুন। এতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে যেতে চাইবে আর চোখে ঘুমের অনুভূতি জাগাবে।
  • ৪-৭-৮ মেথড অনুসরণ করতে পারেন। মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে ধীরেধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে চালাতে ১,২,৩,৪ গণনা করুন। তারপর ৭ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন বা বন্ধ করুন। তারপর মুখ খুলে শ্বাস-প্রশ্বাস চালনা করতে করতে ১,২,৩....৮ পর্যন্ত গণনা করুন।
  • পা মালিশ করুন ঘুমানোর আগে। কারণ পায়ে অস্বস্তির জন্য অনেকের ঘুমাতে দেরি হয়। শরীরের অনেক স্নায়ু পায়ের তলার সাথে সংযুক্ত। পায়ের তলার অংশে সঠিকভাবে রক্ত চলাচল না হলে অস্বস্তি হতে পারে। তাই পা বিশেষ করে পায়ের গোড়ালির নিচের অংশ, পায়ের তলা মালিশ করুন। এতে মস্তিষ্ক ও শরীরে আরাম অনুভব হবে।

ঘুমানোর দোয়া 

আপনি মুসলমান হলে ঘুমানোর আগে কিছু আমল করতে পারেন যা হাদিসে বলা হয়েছে। জিকির, দরুদ, সূরা তিলাওয়াত এগুলো করুন। ঘুমানোর জন্য যে দোয়া আছে, সেটি পাঠ করুন। দোয়াটি হচ্ছে- 
اللَّهُمَّ بِاسْـمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
বাংলা উচ্চারণ- আল্লাহুমা বিসমিকা আমুউতু ওয়া আহ'ইয়া।


উপসংহার

ভালো ঘুম সবাই চায়। ঘুমে তৃপ্তি পেতে সবাই চায়। কিন্তু জীবনযাপনে অনিয়ম থাকায় ঘুমের ঘাটতি হয়ে যায় এবং ঘুমের তৃপ্তি কমে যায়। 
উপরে ঘুম না আসার কারণ, কীভাবে ভালো ঘুম পাওয়া যায় ও ঘুমের সমস্যার প্রতিকার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে। এগুলো অবলম্বন করার মাধ্যমে আপনার ভালো ঘুম পেতে উপকার হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url