বাত জ্বর কী? বাত জ্বরের কারণ, লক্ষ্যণ, ও চিকিৎসা।

বাত জ্বরের কারণ ও চিকিৎসা।
Rheumatic fever 

বাত জ্বর (Rheumatic fever) কমবয়সীদের জন্য ভয়াবহ এক অবস্থার নাম। এটি এক ধরণের প্রদাহজনিত রোগ। বাত জ্বর কী? বাত জ্বরের কারণ, লক্ষ্যণ, চিকিৎসা - এ সম্পর্কে জানতে লিখাটি পড়ে নিন।
Rheumatic fever: causes and symptoms.

যা যা আছে-
  • বাত জ্বর কী? কেন হয়?
  • কারা এই রোগে আক্রান্ত হয়?
  • এটার কারণ কী কী? 
  • এর লক্ষ্যণ কী কী? 
  • চিকিৎসা ও সচেতনতা। 

বাত জ্বর কী? কেন হয়?

স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus) নামক ব্যাকটেরিয়া এই রোগের কারণ। এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গলায় সংক্রমণ এবং লোহিত/লাল জ্বর হয়। আর তা পরবর্তীতে বাত জ্বর সৃষ্টি করতে পারে। লোহিত জ্বর (Scarlet fever) হচ্ছে এই জ্বর হলে শরীরে লাল রঙের ফুসকুড়ি সহ সংক্রমণ হয় বিধায় একে লোহিত/লাল জ্বর বলা হয়। যদিও গলায় সংক্রমণ হলে লোহিত জ্বরের নিশ্চয়তা সবার ক্ষেত্রে সবসময় নেই, বাত জ্বর হওয়ার ক্ষেত্রে লোহিত জ্বর থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। 

মূলত স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া প্রথমে গলায় আক্রমণ করে। গলায় আক্রমণের ২-৪ সপ্তাহ পর তা পরবর্তী দশা বাত জ্বর প্রকাশ পেতে থাকে।  গলায় সংক্রমণের পরবর্তী দশায় বাত জ্বর এর মতো ভয়াবহ জ্বরের সৃষ্টি করে থাকে কমবয়সীদের মধ্যে। 

কারা এই রোগে আক্রান্ত হয়? 

শিশু থেকে বৃদ্ধ যেকোনো বয়সী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কমবয়সী ছেলেমেয়েদের বিশেষ করে ৩ বছর থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে বাত জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ৩ বছরের কম এবং পূর্ণ বয়স্কদের মধ্যে বাত জ্বর এর ঘটনা বিরল।


এটার কারণ কী কী? 

এই রোগের মূল কারণ হচ্ছে স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া। ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, একসাথে গাদাগাদি করে একই জায়গায় অনেক মানুষের বসবাস করার কারণে ব্যাকটেরিয়াটি বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে গলায় সংক্রমণ এবং লোহিত জ্বর সৃষ্টি করে। ৩-১৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা স্কুল, দিবারাত্রি বা ডে-নাইট কেয়ার মানে যেখানে বিভিন্ন পরিবারের বাচ্চাদের একসাথে দেখাশোনা করা হয়, ও অন্যান্য ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ থেকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে এই রোগ এখন নাই বললেই চলে। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগ দেখা যায়। 


বাত জ্বরের কারণ ও চিকিৎসা।
temperature meter


বাত জ্বর এর লক্ষ্যণ কী কী?

একবার বাত জ্বর হয়ে থাকলে এর লক্ষ্যণ অনেকদিন থেকে যায়। জ্বর, ব্যথা হচ্ছে বাত জ্বরের সাধারণ লক্ষ্যণ। যে সমস্ত লক্ষ্যণগুলো দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে-
  • জ্বর
  • অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ায়(Joint) ব্যথা, জয়েন্ট নরম ও ভঙ্গুর। এই অবস্থাকে আর্থ্রাইটিস (Arthritis) বলা হয়। বাহু, কনুই, হাঁটু, পায়ের গোড়ালিতে এই অবস্থা বেশি হয়ে থাকে।
  • জয়েন্টে ব্যথা এক জয়েন্ট থেকে আরেক জয়েন্টে যায়।
  • হৃদপিণ্ডের আকার পরিবর্তন হওয়া, হৃদপিণ্ড প্রদাহ বা ফোলে যাওয়া। 
  • বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা। 
  • ত্বকে এবং ত্বকের নিচে ছোট ছোট গুটি হওয়া, গুটিগুলো তে ব্যথা থাকতেও পারে আবার না-ও পারে। 
  • পাকস্থলীতে ব্যথা।
  • নাক দিয়ে রক্ত পড়া। 
  • বমি করা।
  • অবসাদগ্রস্থতা।
  • হাত, পা, ও মুখের নড়াচড়া করা যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানে নিজের অনিচ্ছায় নড়াচড়া করতে থাকে। 
  • শরীরে কোথাও কোথাও ফুসকুড়ি হওয়া। 
  • মনোযোগে ঘাটতি।
  • অস্বাভাবিক হার্টবিট, হার্টবিট ছোট বা সংক্ষিপ্ত। 
  • অস্বাভাবিক হাসি-কান্না। 

শিশুদের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে-
  • সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে ৬ মাস বয়সী শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা ১০০° ফারেনহাইট এর বেশি হলে।
  • ৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়সীদের জ্বর ৩ দিনের বেশি সময় ধরে থাকলে।
  • টনসিল ফোলে যাওয়া, লালবর্ণ হওয়া।
  • টনসিলে পুঁজের মতো হওয়া। টনসিল এর চিকিৎসা

কারা বেশি ঝুঁকিতে?
  • পারিবারিক কারও বাত জ্বর হওয়ার ইতিহাস থাকলে ছেলেমেয়েদের মধ্যেও তা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • গলায় স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করার পর ব্যাকটেরিয়ার কোন জাত বা ধরণের ফলে আক্রান্ত হয়েছে সেটার অনুযায়ী ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করে। 
  • যারা ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করে তাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি থাকে।

কীভাবে রোগ নির্ণয় করে?

যেহেতু বাত জ্বর হলে গলায় সংক্রমণ, অস্থিসন্ধিতে আক্রমণ, জ্বর দেখা দেয়।সেহেতু উপরিউক্ত লক্ষ্যণগুলো দেখা দিলে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই ডাক্তার রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করবে। রোগীর গলা, অস্থিসন্ধি, ত্বক বা চামড়া, হার্টবিট ইত্যাদি পরীক্ষা করার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।


চিকিৎসা

একবার বাত জ্বর হয়ে থাকলে তা একাধিকবার হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। তাই এর প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন উপযুক্ত চিকিৎসা। 
বাত জ্বর হলে যে চিকিৎসাগুলো দেওয়া হয়-
  • এন্টিবায়োটিক (Antibiotics) ব্যবহার। পুনরায় যেন এই রোগটি আর ফিরে না আসে তার জন্য ডাক্তার রা রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা দিয়ে থাকে। 
  • প্রদাহ প্রতিরোধী বা শরীরের ফোলা নিরাময়ের জন্য মেডিসিন নেওয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে এসপিরিন বা এরকম আরও কিছু মেডিসিন গ্রহণ করার জন্য ডাক্তাররা নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
  • বিশ্রাম নেওয়া। রোগ ধরা পড়লে রোগীকে অবশ্যই পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। পুষ্টিকর খাবার এবং ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে। 

এই রোগের ক্ষতি কেমন?

এই রোগে হার্ট বা হৃদপিণ্ড সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা বয়স এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। রোগের সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা না নিলে হার্টের বড় ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি রোগী মারা পর্যন্ত যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হলে এই রোগের মারাত্মক ক্ষতি এড়ানো কঠিন। তাই যথাযথ উপায়ে চিকিৎসা নিতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে। 


সচেতনতা-
  • হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা।
  • সাবান দিয়ে হাত ধোয়া।
  • শারীরিকভাবে অসুস্থ লোকদের জিনিসপত্র ব্যবহার না করা।
  • নিজের ব্যক্তিগত দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র শুধু নিজে ব্যবহার করা,  কারও সাথে শেয়ার না করা।
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। 
  • গলা ব্যথা হলে সাবধান হওয়া। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করলে গলা ব্যথা কমানো সম্ভব।  ব্যথা জটিল আকার ধারণ করলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। 
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা। 
  • ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলা।

সবশেষে

উপরের আলোচনায় বাত জ্বর কী? বাত জ্বরের কারণ, লক্ষ্যণ, চিকিৎসা ও সচেতনতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ বলা হয়েছে। 
নিজে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে। বাত জ্বর কারও কারও ক্ষেত্রে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাই সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা নিয়ে এই রোগ প্রতিরোধ করতে সতর্ক থাকতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url