রমজানে গর্ভবতী নারীদের করণীয় কী? গর্ভবতীদের জন্য খাবার তালিকা ও সতর্কতা।

 

গর্ভবতীদের জন্য খাবার তালিকা ও সতর্কতা।


রমজান মাসে বিশ্বের বেশিরভাগ ইসলাম ধর্মাম্বলীরা রোজা রেখে থাকে বা সিয়াম সাধনা করে থাকে। অনেক অসুস্থ মানুষও রমজানের রোজা রাখে। রোজা একটি শারীরিক ইবাদাত। রোজা সবার জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য নয়। কুরআন ও হাদিসে রোজা রাখা নিয়ে অনেক বলা আছে। রোজার সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও প্রাণনাশের আশংকা থাকলে সেসকল মানুষের জন্য রোজা না রাখার নির্দেশ রয়েছে। সেই সকল মানুষের মধ্যে একপ্রকার হচ্ছে গর্ভবতী মহিলারা। রমজানে গর্ভবতী নারীদের করণীয় কী? গর্ভবতীদের জন্য খাবার তালিকা ও সতর্কতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো।


যা যা জানবেন এখানে-

- গর্ভবতী নারীদের সমস্যাগুলো।

- গর্ভবতীদের খাবার তালিকা।

- রমজান মাসে গর্ভবতীদের সতর্কতা। 

আরও পড়ুন-

রমজানে রোজা পালন করলে গর্ভবতীদের মধ্যে তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। তবে গর্ভধারণকালের প্রথম ৩ মাস এবং শেষ ৩ মাসে তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে। এই সময়ে অর্থাৎ প্রথম ৩ মাস চলাকালীন এবং শেষ ৩ মাস চলাকালীন সময়ে রোজা রাখার ফলে সন্তানের ওজন কম হওয়া সহ আরও কিছু সমস্যার দেখা দিতে পারে। সন্তানের ওজন কম হওয়া, খর্বাকার হওয়া ও অন্যান্য যেসকল সমস্যার কথা বলা হয়ে থাকে সেগুলোর পরিমাণ খুবই কম হয়। অর্থাৎ রোজা রাখার কারণে সন্তানদের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। তবে সতর্ক থাকা লাগবে। 


রমজানে গর্ভবতী নারীদের যেসকল সমস্যা হতে পারে

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে, ওজন কমে যায়।
  • পানির পিপাসা বেড়ে যায় ও অনেক তৃষ্ণা জাগে। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এসবের ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা ও মূত্রনালীর সংক্রমণ হতে পারে। 
  • মাথা ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে, জ্বরও হতে পারে। 
  • বমি করা।
  • গর্ভে শিশুর চলাচল ( Movement) পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আগের তুলনায় গর্ভে শিশুর নড়াচড়া ও লাথি মারার পরিমাণে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। 
  • ব্যথা বেড়ে যেতে পারে, এবং অকাল গর্ভপাত অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গর্ভপাত হতে পারে। যেটাকে Premature labour বলা হয়।
  • চোখে ঝাপসা দেখা, দূর্বলতা, ক্লান্তি, হতাশা দেখা দেয়। এমনকি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার পরও দূর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভূত হওয়া।
  • শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্য সম্পাদন ও রাসায়নিক ব্যবস্থা সম্পাদনে পরিবর্তন হওয়া।
  •  মানসিক স্বাস্থ্য পরিবর্তন হতে পারে। মুড সুইং সমস্যা বাড়তে পারে। মানসিক অবস্থা ভালো রাখা তাই একটি কর্তব্য।

এগুলোই গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর সাধারণ সমস্যা হয়ে থাকে। রমজানে রোজা রাখার ফলে এসবের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সমস্যার বেড়ে গেলে সেই মুহুর্তে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।  তাই বিশেষজ্ঞরা রমজানের সময় গর্ভবতীদেরকে রোজা পালনে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। বিভিন্ন আলেম-ওলামারাও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। 

গর্ভবতী নারীরা ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নারীরা যদি রোজা রাখতে নিজের এবং সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভয় পান তাহলে রোজা না রাখার নির্দেশ রয়েছে। তারা রমজানের পর এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রোজা পালন করে নিতে পারবেন। তবে যদি রোজা রাখতে খুব আগ্রহী হোন এবং নিজেকে রোজা রাখার যোগ্য সামর্থ্যবান হিসেবে ভাবেন তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাবার তালিকা, বিধিনিষেধ মেনে সতর্কতা অবলম্বন করে রোজা রাখতে পারেন। রমজানে নিজে ও নিজের সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। 

গর্ভবতীদের জন্য খাবার তালিকা

গর্ভবতীদের জন্য খাবার

Diet chart for pregnant-

সাহরি

ক্যালরির পরিমাণ আগের মতোই থাকবে শুধু খাবার ও খাওয়ার সময়ের পরিবর্তন হয়ে যাবে রমজান মাসে। 

সাহরিতে যা যা খাবেন-

  • ভাত, রুটি, আলু এই শর্করাজাতীয় ও ক্যালরিযুক্ত খাবারগুলো খাবেন। গর্ভকালীন সময়ে ভালো মানের ক্যালরি আছে এমন শক্তি সঞ্চয়কারী খাবার খেতে হয়।
  • শাক-সবজি ও আঁশযুক্ত খাবারগুলো হজমশক্তি উন্নত করে এবং খিদে কম অনুভব করতে সাহায্য করে। তাই শাক-সবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খান। যেমন- যেকোনো রঙিন ও সবুজ শাক-সবজি, মটরশুঁটি, ডাল, শিম। 
  • প্রোটিন খেতে হবে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম এসব খাবার প্রোটিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এগুলোতে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন থাকে, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। 
  • ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। আম, আপেল, কলা, অ্যাভোকাডো এই ফলগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানে ভরপুর। খেজুর খেতে পারেন, এতে আঁশ ও অন্যান্য অনেক দরকারী খাদ্য উপাদান আছে। ফলের জুস খাওয়াও ভালো।
  • দুধ পান করবেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ১ গ্লাস দুধ খাবেন। সাথে দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ভালো। দই, লাচ্ছি এসব খাবেন, পেট ভালো রাখে এই খাবারগুলো। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার রক্তশূন্যতা ( Anemia) প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। 
  • বাদামজাতীয় খাবার খাবেন। চিনাবাদাম,  কাজুবাদাম, আখরোট ও বাদাম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার খাওয়া ভালো। 

সাহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে হবে। না খেয়ে বা কম খেয়ে রোজা রাখা নিরাপদ না। কিন্তু আবার বেশি করে খেলে অস্বস্তি হওয়া সহ কারও কারও বমিও হতে পারে। তাই বেশি পরিমাণে না খেয়ে কীভাবে এবং কোন খাবার খেলে বেশি পুষ্টি পাওয়া যাবে সেভাবে খেতে হবে। পুষ্টি ও গুণাগুণ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। 


ইফতার

  • খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত। খেজুর খাবেন।
  • আপেল, কলা, অ্যাভোকাডো, পেঁপে খাবেন। ফলমূল বেশি করে খাবেন।
  • স্যুপ ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া ভালো। ভাজাপোড়া কম খেতে হবে। বেগুনি, তেহারি, পিঁয়াজু, সমুচা, শিঙ্গাড়া এসব তেলে ভাজা খাবার কম খাওয়া উচিত। 
  • প্রোটিন, আঁশজাতীয় খাবার( Fiber), ফলমূল, ফলের জুস, সালাদ ও তরল খাবার ইফতারে খাওয়া উচিত। 
  • দুধ, দই দিয়ে চিড়া একসাথে মেখে খেতে পারেন। 

ইফতারে একসাথে সব খাবার খাবেন না। প্রথমে খেজুর, পানি, স্যুপ দিয়ে ইফতার করে ১০-১৫ মিনিট অন্যান্য খাবার খান।সেটা পেটের জন্য ও শরীরের জন্য ভালো। ইফতারে বেশি করে খেলে অস্বস্তি, দূর্বল, অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। 


রাতে যা খাবেন

যেহেতু গর্ভবতী নারী ও সন্তানের পর্যাপ্ত পুষ্টি ও শক্তি সরবরাহ দরকার, সেহেতু রোজা ছাড়ার পর চেষ্টা করতে হবে পর্যাপ্ত ক্যালরি গ্রহণ করার। ইফতার করার ২ ঘণ্টা পরপর খেলে সারাদিনের ক্যালরি ও পুষ্টির চাহিদা মেটানো যাবে সহজে।

রাতে ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, ফলমূল, সালাদ, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া যায়। তবে সাহরির কথা মাথায় রেখে রাতে কম খাওয়া উচিত। রাতের খাবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর একটু হাঁটাহাটি করতে পারলে ভালো হয়।


উপরে শুধু খাবার নিয়ে বলা হয়েছে। খাবারগুলোর চেয়ে যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি সেটা হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা। ইফতারের পর থেকে সাহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে, কমপক্ষে ২-৩ লিটার বা ৮-১২ গ্লাস। পানি, ফলমূল, তরল খাবার বেশি করে খেলে পানিশূন্যতা থেকে মুক্ত থাকা যাবে এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সচল থাকবে। 

একসাথে বেশি খাবার না খেয়ে বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।

গর্ভবতীদের জন্য সতর্কতা
cautions for pregnant

সতর্কতা

Cautions

গর্ভকালীন সময়টা প্রতিটি নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে সর্বোচ্চ সচেতন ও সতর্ক থাকা তাই খুবই জরুরি। যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি -

  • আপনি এবং আপনার শরীর রোজা রাখার উপযোগী কি-না তা আগে নিশ্চিত হোন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখা, রোজায় খাবার তালিকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিন।
  • আপনার ওজন নিয়মিত পরীক্ষা করুন। স্বাভাবিকভাবেই রমজানে মানুষের ওজন কমে কিছুটা হলেও। ওজন অতিরিক্ত কমে গেলে তা আপনার জন্য ও সন্তানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ওজন কমে গেলে বা কমতে থাকলে রোজা বাদ দিয়ে দিবেন। সন্তান জন্ম হওয়ার পর রোজা পালন করতে পারবেন। অথবা " ফিদায়াহ" ব্যবস্থা আছে রোজা রাখতে না পারলে। এই ব্যবস্থায় গরীব, অসহায়, এতিম, মিসকিনদের খাওয়ানোর মাধ্যমে রোজার কাফফারা আদায় করা যায়। 
  • খুব পিপাসা পায় কি-না খেয়াল রাখুন। পানিশূন্যতা দেখা দিলে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবণা থাকে। এমতাবস্থায় রোজা ছেড়ে দেওয়া উচিত, যাতে নিজের ও সন্তানের ক্ষতি না হয়। এ ব্যাপারে ধর্মেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 
  • প্রচণ্ড মাথা ব্যথা থাকলে ও একাধিকবার বমি হলে এমতাবস্থায় রোজা না রাখাই উত্তম। 
  • গর্ভবতী নারীর আগে থেকেই ডায়াবেটিস (Diabetes), রক্তশূন্যতা (Anemia) ও এরকম কোনো থাকলে তার রোজা না রাখা ভালো। আর যদি গর্ভবতী হওয়ার পরও ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা ও এরকম রোগগুলি দেখা দেয় তাহলে নিজের ও সন্তানের ভালোর জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। 
  • অ্যালকোহল ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য তো একদমই গ্রহণ করা যাবে না।
  • ধুমপান ও তামাক গ্রহণ করা যাবে না। এবং গর্ভবতীর আশেপাশেও যেন কেউ ধুমপান ও তামাক ব্যবহার না করে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। 
  • ক্যাফেইনজাতীয় পণ্য যত কম করা যায় তত ভালো। চা, কফি ইত্যাদি পানীয় পানিশূন্যতার সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। 
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। ভারী ও কষ্টকর কোনো কাজ করা যাবে না। 
  • অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, জাঙ্কফুড, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া কমাতে হবে, গর্ভকালীন সময়ে এসব না খাওয়া ভালো।
  • অবশ্যই পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে ৭-৮ ঘণ্টা। 
  • পানি এবং পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খেতে হবে। 


সবশেষে

রমজান মাস বরকতময় ও রহমতের মাস। সকল সুস্থ, সবল ও উপযুক্ত মুসলমানের জন্য রোজা রাখা ফরজ। কঠিন অসুস্থতা, দীর্ঘকালীন অসুস্থতা, অতি দূর্বল,  গর্ভবতী এসব অবস্থার মানুষদের জন্য আল্লাহ্ ও রাসূল ( সাঃ) রোজা না রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। 

তাই রমজানে গর্ভবতী নারীদের করণীয় কী? গর্ভবতীদের খাবার তালিকা ও সতর্কতা সম্পর্কে অবগত হয়েই তারপর কোনো গর্ভবতী রোজা রাখতে পারেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url