চোখে মায়োপিয়া কেন হয়? কীভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে?
ক্ষীণদৃষ্টি, হ্রস্বদৃষ্টি, কাছের দৃষ্টি, অদূরদৃষ্টি যা-ই বলা হোক কেন সবগুলোর এক সাংকেতিক নাম হচ্ছে মায়োপিয়া (Myopia)। বর্তমান যুগে কমন একটি সমস্যা হয়ে গেছে মায়োপিয়া। চোখে মায়োপিয়া কেন হয়? কীভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে? মায়োপিয়ার চিকিৎসা ও সতর্কতা সম্পর্কে জেনে নিতে এই আর্টিকেল পড়তে থাকুন শেষ পর্যন্ত।
যা যা জানবেন এই আর্টিকেলে -
- মায়োপিয়া কী? মায়োপিয়া কেন হয়?
- মায়োপিয়ার লক্ষ্যণ।
- কীভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে আপনার?
- মায়োপিয়ার চিকিৎসা।
- ক্ষতিকর অবস্থা।
- করণীয় কী?
- চোখের সুস্থতার জন্য খাবার।
- সতর্কতা।
মায়োপিয়া কী? What is Myopia?
চোখের দৃষ্টি দূরের কোনো জিনিস দেখতে সমস্যা হওয়া, ঝাপসা দেখা যাওয়া হচ্ছে মায়োপিয়া। এটি এই যুগে বিশ্বের সব দেশেই যেকোনো বয়সী মানুষের মধ্যে হতে পারে এবং হচ্ছেও। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জনের চোখের এই সমস্যা রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এমনটা বলা যায় সারা বিশ্বেই মানুষের মধ্যে এই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
৬ বছর বয়স থেকে বা আরও আরও আগে থেকে শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। শুধু কম বয়সী নয়, যেকোনো বয়সী মানুষের মধ্যে এটি দেখা দিতে পারে। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী বিশ্বের আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন মানুষ ( মোট জনসংখ্যার ২২%) মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। ১৯৫০ সালের পর থেকে বিশ্বে চোখের এই সমস্যার মানুষ বাড়তেই আছে।
অনেকে চোখের এই সমস্যাটিকে রোগ বলে থাকে। মায়োপিয়া কোনো রোগ নয়, এটি একটি চোখের ত্রুটি যা উপযুক্ত চিকিৎসা নিলেই ত্রুটি দূর করা যায়।
মায়োপিয়া কেন হয়? Why does Myopia happen?
মায়োপিয়া হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে বংশগত ও পরিবেশগত কারণ।
চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে রেটিনা (Retina)। কোনো বস্তুর দিকে তাকালে সেই বস্তুর দিক থেকে আসা আলো রেটিনার সামনে পড়ায় তখন বস্তুটি স্পষ্ট দেখতে সমস্যা হয়। অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ বেড়ে যাওয়াও মায়োপিয়ার কারণ। অক্ষিগোলকের ব্যাসার্ধ বেড়ে গেলেও আলো সরাসরি রেটিনার সামনের অংশে পড়ায় বস্তুর ঠিকঠাক প্রতিবিম্ব গঠন হয় না, ফলে দূরের কোনো বস্তু দেখতে সমস্যা হয় এবং ঝাপসা লাগে।
দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কিছু চোখের একদম কাছে রেখে দেখতে দেখতে সমস্যাটি হতে থাকে।
এছাড়াও স্বল্প আলোতে পড়াশোনা ও দৈনন্দিন কাজ করার কারণেও মায়োপিয়া দেখা দেয়। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো যেমন- মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি, ভিডিও গেমিং ইত্যাদি দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার করার কারণে মায়োপিয়ার সৃষ্টি হয়।
কোনো কিছু খুব কাছ থেকে বেশিক্ষণ ধরে করলে চোখের পেশিতে চাপ পড়ে এবং তাতে চোখ শুধু কাছের জিনিস স্পষ্ট দেখার প্রতিই সীমাবদ্ধ হয়ে আসে।
পর্যাপ্ত শারীরিক কাজকর্মের ঘাটতি অর্থাৎ অলস জীবনযাপনও মায়োপিয়া হওয়ার কারণ হয়ে থাকে।
পরিবারের কারও এই সমস্যা থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও এটি হয়ে থাকে যেটা সবচেয়ে বড় এবং অনিয়ন্ত্রিত কারণ।
মায়োপিয়ার ধরণ (Types of Myopia)
মায়োপিয়ার মূলত দু'টি ধরণ আছে, সেগুলো হলো-
- প্যাথলজিক্যাল (Pathological) ও
- নন-প্যাথলজিক্যাল (Non-pathological)।
তবে পরীক্ষা ও সমস্যার মাত্রা অনুযায়ী আরও বিভিন্ন ধরণও রয়েছে।
-০.০০ থেকে শুরু করে -৬.০০ ডায়াপ্টার (Diopters) এর মধ্যবর্তী মাত্রা হচ্ছে প্যাথলজিক্যাল মায়োপিয়া। -৪.০০ বা -৬.০০ ডায়াপ্টারের নিচের ধরণকে স্বাভাবিক এবং সহজ মায়োপিয়া হিসেবে ধরা হয় যা কমন একটি ধরণ, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে এই মাত্রার মায়োপিয়া দেখা যায়।
আর -৬.০০ ডায়াপ্টারের বেশি মায়োপিয়া হচ্ছে উচ্চ মাত্রার মায়োপিয়া যা নন-প্যাথলজিক্যাল মায়োপিয়া।
মায়োপিয়ার লক্ষ্যণ ( Symptoms of Myopia)
কীভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে-
- দূরের বস্তু ও দূরের কোনো জিনিস ঝাপসা দেখা। বিশেষ করে দূরের কোনো লেখা, চিহ্ন। এরকমটা বেশি হয় প্রখর সূর্যের আলোয়।
- কাছের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাওয়া।
- মাথা ব্যথা।
- চোখ অলস হয়ে পড়া। অলস চোখের একটি লক্ষ্যণ হচ্ছে চোখের পলক ফেলতে অনীহা বা চোখের পলক ফেলার পরিমাণ কমে যাওয়া।
- চোখে টান অনুভব হওয়া।
- কোনো কিছু ভালোভাবে দেখতে তীর্যকভাবে তাকানো।
- টিভি, কম্পিউটার ও অন্যান্য স্ক্রিনে কোনো কিছু স্পষ্ট দেখতে কাছে গিয়ে দেখা।
- ক্লাসে বা অফিসের বোর্ডের লেখা একটু দূর থেকে দেখতে সমস্যা হওয়া।
এগুলোই মায়োপিয়ার সাধারণ লক্ষ্যণ যা শিশু, ছোট-বড় সবার মধ্যে দেখা যায়।
treatment of myopia |
মায়োপিয়ার চিকিৎসা (Treatments of Myopia)
মায়োপিয়া চোখের একটি ত্রুটি। এটি দূর করা সম্ভব যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া যায়। চশমা ও লেন্স ব্যবহার করার মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে করা হয়।
মায়োপিয়ার যে চিকিৎসা গুলো রয়েছে সেগুলো হচ্ছে -
- চশমা ও কনটাক্ট লেন্স ব্যবহার করা। উপরে উল্লিখিত মায়োপিয়ার লক্ষ্যণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ পরীক্ষা করে সঠিক পাওয়ারের ( ডায়াপ্টার) চশমা ব্যবহার করে মায়োপিয়ার সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই দূরের বস্তু দেখতে পারা যায়। অনেকে চশমা বাহ্যিক জিনিস হওয়ায় বিরক্তি লাগায় চশমার বদলে কনটাক্ট লেন্স ব্যবহার করে, যা চোখের মধ্যে বসাতে হয়।
- মেডিসিন।
- ফটোরিফ্রেক্টিভ কেরাটেক্টোমি (Photorefractive keratectomy)
- ল্যাসিক (Lasik) ও ল্যাসেক (Lasek)
- অর্থোকেরাটোলজি (Orthokeratology) বা Ortho-K
- ইন্ট্রাঅকোলার লেন্স ইমপ্ল্যান্ট (Intraocular lens implant)
- ভিশন থেরাপি।
- আর্টিফিশিয়াল লেন্স।
এই চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলো মায়োপিয়ার ধরণ অনুযায়ী আক্রান্তদের দেওয়া হয়।
ক্ষতিকর অবস্থা (Risk factors)
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে যে ক্ষতিকর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে মায়োপিয়া থেকে -
- চোখ বাঁকা করে বা তীর্যকভাবে দেখতে দেখতে চোখের পেশির গঠন পরিবর্তন হয়ে দূর্বল হয়ে যেতে পারে।
- মাথা ব্যথার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
- চোখ ফোলা ও পানি পড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
- রেটিনার এরিয়া আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যেতে থাকে। গ্লুকোমা, ক্যাটারাক্ট, রেটিনার কেন্দ্রে ক্ষতি হওয়ার মতো বড় ধরণের সমস্যা হতে পারে।
তাই উচিত মায়োপিয়া দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া।
eye vision test |
করণীয় কী? (To do things)
নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা। প্রতি ২ বছরে ১ বার করে চোখ পরীক্ষা করা উচিত সবার জন্য যাদের চোখে সমস্যা আছে। এছাড়া যাদের চোখে সমস্যা নাই তাদের উচিত,
- শিশুর বয়স ৩ বছর হয়ে গেলে এবং স্কুলে ভর্তি করানোর আগে ১ বার চোখ পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।
- ২০-৩০ বছর বয়সীদের উচিত ৫ বছরে ১ বার করে চোখ পরীক্ষা করা।
- ৩০-৫০ বছর বয়সীদের উচিত ২-৪ বছরে ১ বার পরীক্ষা করা।
- ৫০-৭০ বছর বয়সীদের উচিত ১-৩ বছরে ১ বার পরীক্ষা করা।
মায়োপিয়া ধরা পড়লে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী চললে এই সমস্যা দূর করা যায়।
চোখের সুস্থতার জন্য খাবার (Foods to keep eyes healthy)
শরীরের সুস্থতার জন্য যেমন পুষ্টিকর খাবার দরকার, তেমনি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের একটি চোখের সুস্থতার জন্যও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
যে খাবারগুলো খাওয়া ভালো-
- ভিটামিন-এ রয়েছে এমন খাবারগুলো চোখের জন্য বেশি উপকারী। সবুজ ও রঙিন শাক-সবজি, গাজর, ব্রকোলি, কলিজা, ছোট মাছ, তৈলাক্ত মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খাবারে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়।
- ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডও চোখের জন্য ভালো। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, বাদামজাতীয় খাবার গুলোতে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আছে।
- ভিটামিন-সি খাওয়াও চোখের জন্য ভালো। ফলমূল, শাক-সবজি, বীজজাতীয় খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি রয়েছে।
- লুটিন খাদ্য উপাদানটি চোখকে ক্ষতিকর নীল আলো থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। শাক-সবজি তে লুটিন বেশি পাওয়া যায়। তাই বেশি বেশি শাক-সবজি খেতে হবে।
সতর্কতা (Cautions)
- নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা।
- ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার কমাতে হবে।
- ডিভাইস ব্যবহারের ফাঁকে চোখকে বিশ্রাম দিতে হবে। এক্ষেত্রে ২০-২০-২০ ফর্মূলা মেনে চলা যায়। এই ফর্মূলার অর্থ হচ্ছে ২০ মিনিট ডিভাইস ব্যবহার করার পর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরে তাকিয়ে থাকা।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৯০ মিনিট বাইরের আলো-বাতাসে সময় কাটানো।
- বেশি কাছ থেকে বই পড়া, মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি ও অন্যান্য স্ক্রিন ডিভাইস ব্যবহার করা এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। চোখ থেকে কমপক্ষে ২৫-৩০ সেন্টিমিটার দূরে রেখে এসব করতে হবে।
- প্রখর সূর্যের আলোয় বাইরে বের হলে সানগ্লাস ব্যবহার করা।
- ধুমপান পরিহার করা।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন নেওয়া, চশমা ও লেন্স পরা এবং চিকিৎসা নেওয়া।
উপসংহারে
আধুনিক যুগে মানুষ দিনদিন যন্ত্রমুখী হয়ে যাচ্ছে, বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। যা তাদের চোখের উপর প্রভাব ফেলছে। এই আর্টিকেলে মায়োপিয়া কী? চোখে মায়োপিয়া কেন হয়? কীভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে? মায়োপিয়ার চিকিৎসা ও সতর্কতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করা হয়েছে। কারও মায়োপিয়া দেখা গেলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিয়ে মায়োপিয়া প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।