কান্না করলে কী হয়? চোখের পানির উপকারিতা ও ক্ষতি।
What happens when you cry? |
"কান্না করুন, ভালো থাকুন" - কী? অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কান্না করা নিয়ে এভাবে বলার কী আছে? আপনি হয়তো জানেন না যে, আমাদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় চোখের পানির কতটা উপকারিতা রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কান্না করা কী হয়? চোখের পানির উপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে।
যা জানবেন-
- কান্না ও চোখের পানি কী?
- চোখের পানির প্রকারভেদ।
- কান্না ও চোখের পানির উপকারিতা ও ক্ষতি।
- কান্না না করলে কী হয়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনের শুরু হয় কান্না করার মাধ্যমে, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থাকা অবস্থায়। এরপর থেকে জীবনের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে মানুষের কান্না করতে হয়, কান্না করার মুহুর্তের তৈরি হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন কান্না করলে কী হয়? আর কান্না না করলে কী? কান্না করলে চোখের পানির উপকারিতা কতটা তা অনেক মানুষই জানে না।
চোখের পানি কী?
চোখের পানিতে থাকে পানি, তেল, চোখকে জীবাণুর হাত থেকে সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন এন্টিবডি (antibodies), একধরণের তরল পিচ্ছিল উপাদান যেটাকে মিউকাস (Mucus) বলা হয়। এই উপাদানগুলোর মিশ্রণেই চোখের পানি গঠিত। অক্ষিগোলকের উপরের অংশে " Lacrimal gland" নামক বাদাম আকৃতির একটি অংশ রয়েছে, যেখানে চোখের পানি অবস্থান করে। এই ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। মস্তিষ্ক যখন কোনো কারণে কান্না করার সংকেত পাঠায় তখন এই অংশ থেকে তরল পানি গড়িয়ে চোখ বেয়ে বের হয়ে আসে।
কান্না করা একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ সুখে, দুঃখে, আবেগে যেকোনো মুহুর্তে কান্না করতে পারে।
চোখের পানির প্রকারভেদ-
বিজ্ঞানীরা চোখের পানিকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে। যথাঃ
১. প্রতিবিম্ব গঠনকারী পানি (Reflex tears): কোনো বস্তু স্পষ্ট দেখতে স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব তৈরি করতে সাহায্য করে এটি। চোখে ধুলাবালি, ধোঁয়া ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ দূর করতে এটি কাজ করে। চোখের দিকে তাকালে দেখবেন সকল প্রাণীর চোখেই পানির মতো দেখা যায়, সেটি হচ্ছে চোখের স্বাভাবিক অবস্থা। চোখকে শুষ্কতার হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাকৃতিকভাবে এই পানি সবার চোখে সবসময় থাকে।
২. একনাগাড়ে কান্নার চোখের পানি ( Continuous tears): এটি হচ্ছে চোখে কোনো আঘাত ও শারীরিক, মানসিকভাবে কোনো বড় আঘাতের কারণে একনাগাড়ে চোখ দিয়ে পানি পড়ার অবস্থা। চোখকে পরিষ্কার করে চোখকে বিভিন্ন রোগ, সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে এই পানি কাজ করে। চোখের এই পানির ৯৮%-ই হচ্ছে সাধারণ পানির মতোই।
৩. আবেগজনিত চোখের পানি (Emotional tears): এটিও অনেকটা একনাগাড়ে পানি পড়ার মতোই। কিন্তু এতে একনাগাড়ে পানি পড়ে না। দেখবেন যে, মানুষ খুশিতে বা কষ্টে চোখে পানি ছলছল করে পানি বের হয়ে আসার অবস্থা হয়ে যায়। এটিই হচ্ছে আবেগজনিত বা ইমোশনাল চোখের পানি। চোখ ও মনকে পরিষ্কার করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, ইমোশন বুস্টার হিসেবে কাজ করে।
Advantages and disadvantages of Tears. |
কান্না ও চোখের পানির উপকারিতা গুলো হচ্ছে
- চোখকে ক্ষতিকর বিভিন্ন অবস্থা থেকে সুরক্ষা দেয় চোখের পানি। বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে চোখের পানির মধ্যে। চোখের পানিতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা চোখে কোনো ক্ষতিকর জীবাণু প্রবেশ করলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা জীবাণুকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
- দেখবেন কান্না করার পর আপনার মন ভালো হয়ে গেছে, মন শান্ত হয়ে গেছে। কারণ হচ্ছে চোখের পানির মাধ্যমে স্ট্রেস হরমোন (Stress hormones) নির্গত হয়ে আপনার স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- বিজ্ঞানীরা খোঁজে বের করেছেন যে, কান্না করার ফলে মানুষের স্নায়ুগুলিতে একধরণের সিস্টেম চালু হয় যেটাকে প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (Parasympathetic nervous system) বলা হয়। এই প্রক্রিয়াটি চালু হওয়ায় দেহে বিপাকীয় কাজে সহায়তা হয় এবং দেহ বিশ্রাম পেয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করার আরও শক্তি সঞ্চয় করে।
- দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করার ফলে অক্সিটোসিন (Oxytocin) ও এন্ডোর্ফিন (Endorphins) হরমোন নিঃসরণ হয়। অক্সিটোসিন ও এন্ডোর্ফিন নিঃসরণের ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বস্তি বিরাজ করে। এ দুটি নিঃসরণের কারণে মানসিক চাপ ও দুঃখ-কষ্ট প্রশমিত হয়।
- ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করলে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস চালনা করতে হয়। এভাবে কান্না করলে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ বাতাসে বেশি বেশি শ্বাসকার্য চলে যা মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের তাপমাত্রা কমে মস্তিষ্কের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে। মস্তিষ্ক শান্তিতে থাকলে তা শরীর ও মনের জন্যও অনেক সুখকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
- কান্না করার পর আবেগ নিয়ন্ত্রণে ভারসাম্য আসে। শরীরের মধ্যে ম্যাঙ্গানিজ ( Manganese) বাড়ার কারণে মানসিক চাপ ও আবেগ যেমন- রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, অবসাদ, অস্বস্তিও বাড়তে থাকে। কিন্তু কান্না করার পর ম্যাঙ্গানিজ প্রশমিত হয়ে মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে ও আবেগের ভারসাম্য আসে, আবেগের উন্নতিসাধন হয়।
- বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কান্না করলে তাতে কোনো শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় না বরং আরও উপকার হয়।
- কান্না করার আরও সবচেয়ে বড় একটি উপকারিতা হচ্ছে- আপনি যদি নামাজে ও অন্যান্য ধর্মকর্মে আল্লাহ'র ভয়ে নিজের পাপের কারণে কান্না করেন, তাহলে কান্না করার সেই চোখের পানি স্রষ্টার কাছে কতটা পছন্দের আর পরকালে আপনার জন্য কতটা উপকারী হবে তা নিজেও কল্পনা করতে পারবেন না।
এই হলো কান্না করার কিছু উপকারিতা। এখন বুঝতে পারছেন- কান্না করা কি ভালো নাকি খারাপ? কান্না করলে কী হয়?
কান্না না করলে কী হয়?
কান্না না করার অনেক কারণ থাকতে পারে। কেউ অত্যন্ত কঠিন মনের মানুষ হলে সে তার আবেগকে প্রকাশ করতে পারে না, তার মধ্যে আবেগ কম বা আবেগ নেই। তাই কেউ কান্না না-ও করতে পারে। এটা যার যার মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে।
আবার কান্না করলেও চোখে পানি আসে না কারও কারও। পানি না আসার কারণ হতে পারে সে কান্না লুকিয়ে রাখতে চাইছে অথবা তার চোখে পানির ঘাটতি রয়েছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও অনেকে কান্না করলে পানি বের হয়ে আসে না। এটি একটি খারাপ দিক। কারণ, চোখের পানি শুকিয়ে গেলে তা চোখের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কেন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা উপরে চোখের পানির উপকারিতা পড়ে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। চোখের পানি শুকিয়ে গেলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে ও চিকিৎসা নিতে হবে।
উপসংহার টানছি
কান্না করার এত এত উপকারিতা থাকতে তাহলে নিজের যখন কান্না করার মুহুর্ত চলে আসে তখন কান্না দমিয়ে না রেখে কান্না করাই ভালো। কান্না করার কোনো কারণ না পেলে এমনি এমনি কিছুক্ষণ কান্না করুন, তাতে আপনার জন্যই ভালো। আপনার ইমোশন বুস্ট করতে পারা যাবে কান্না করলে। তাই " কান্না করুন, ভালো থাকুন।" কারণ আপনি এখন জানেন কান্না করলে কী হয়, চোখের পানির উপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে।