কোন বয়সী শিশুকে কী খাওয়াবেন? শিশুর খাবারে সতর্ক হোন।

কোন বয়সী শিশুকে কী খাওয়াবেন?


অনেক নিউজে দেখা যায় যে, শিশু খেতে না চাওয়ায় জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এমন ঘটনা ঘটার পেছনে কারণ হচ্ছে শিশুর বয়স অনুযায়ী সঠিক খাবার সম্পর্কে মা-বাবা ও পরিবারের সচেতন না থাকা। এই আর্টিকেলে জন্মের পর নবজাতক শিশু থেকে ৩ বছর পর্যন্ত কোন বয়সী শিশুকে কী খাওয়াবেন? শিশুর খাবারে সতর্ক হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। 


যা থাকছে-
  • শিশুর বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত খাবার। 
  • শিশুকে খাওয়াতে যা যা করণীয়। 
  • সতর্কতা

সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর খাদ্য তালিকায় পুষ্টিকর খাবার বাড়াতে হবে। শিশুর মুখ্য অর্থাৎ মূল খাবার হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। বুকের দুধ শিশুকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়াতে হবে। শিশুর ৪ মাসের পর বিশেষ করে ৬ মাস পর থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে উন্নতির জন্য পরিপূরক হিসেবে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। 

শিশুর সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য এমন কিছু সতর্কতা অবলম্বন করুন যাতে শিশুর ক্ষতির কারণ না হয়। কিছু সতর্কতা সম্পর্কে শেষের দিকে বলা হয়েছে। পড়তে থাকুন।


Foods for baby.


শিশুর বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত খাবার 

জন্মের পর থেকে ৬ মাস 


মায়ের বুকের দুধ এর চেয়ে উন্নত খাবার আর হয় না শিশুর জন্য। তাই জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ, মায়ের বুকের দুধে শিশুর বেড়ে ওঠার সকল খাদ্য উপাদানই পাওয়া যায়। তাই শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ান। শিশুর বয়স ১ বছর হওয়ার আগে গরুর দুধ খাওয়ানো উচিত নয়। 

৬ মাস থেকে ১ বছর

৬ মাস হলে শিশু চিবানো শিখে। দাঁত কিড়মিড় করা, মুখে আঙুল দিলে চিবানো এগুলো শিশুর সদ্য চিবাতে শেখার লক্ষ্যণ। তাই এ সময় শিশুকে নরম, কোমল খাবার খাওয়ানো যায়। ভাত, ডিম, খিচুড়ি, কলিজা, নরম ফল ( যেমন- কলা, স্ট্রবেরি), ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। 

ভাত ও খিচুড়ি খাওয়াতে নরম করে খাওয়াতে হবে। বেশি পরিমাণ খাবার মুখে দিবেন না। ভাত খাওয়ানোর সময় ভাতে কিছুটা পানি মিশিয়ে নরম করে নিয়ে খাওয়াবেন। খিচুড়িতে বেশি মশলা দিবেন না। খিচুড়িতে ডাল, সবজি মিশিয়ে রান্না করলে সবচেয়ে ভালো। 

কলা, স্ট্রবেরি খাওয়াতে হলে তা চটকে গলিয়ে নিতে হবে। ভর্তার মতো নরম করে তারপর শিশুকে খাওয়াতে। তবে হাত দিয়ে ধরে না খাইয়ে, চামচে গলানো ফল নিয়ে শিশুর মুখের সামনে ধরুন। শিশু খেতে চাইলে খাওয়ান। জোর করে খাওয়াতে যাবেন না।

আপেল, অ্যাভোকাডো, আঙুর এর মতো পুষ্টি সমৃদ্ধ ফলগুলো খাওয়াতে এগুলো পিষে বা ব্লেন্ড করে রস করে নিন। চামচে করে নিয়ে ফলের রস শিশুর মুখের কাছে ধরুন। ১ বছরের আগে শুকনো ফল যেমন- খেজুর না খাওয়ানোই ভালো। কারণ শুকনো ফল গলায় আঁটকে যেতে পারে, জিভ ও তালুর ছাল তুলে দিতে পারে। যদি খেতে দিন তাহলে নরম করে নিন। 

দই খাওয়াতে পারেন। তবে মিষ্টি ও গরুর দুধ দিয়ে তৈরি দই মোটেই খাওয়ানো যাবে না। ১ বছর বয়সের পর গরুর দুধ দেওয়া উচিত। 

মাছ, মাংস খাওয়াতে পারেন, এগুলো ৭-৮ মাস পর থেকে খাওয়ানো ভালো। মাছ তো নরমভাবেই থাকে, দলা থাকে না। মুখে দিলে অনায়াসে গিলেও খেতে পারবে শিশু। কিন্তু মাংস খেতে দিলে আগে মাংস নরম করে নিতে হবে যাতে শক্ত না থাকে। শক্ত ও দলা বাঁধা থাকলে তা শিশুর গলায় আঁটকে গিয়ে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ঝুঁকি নিতে না চাইলে শিশুর দাঁত গজানোর আগে মাংস না খাওয়ানোই ভালো। ১ বছর হলে মাংস দিন।

চামচে করে নিয়ে একটু একটু করে পানি খাওয়ান শিশুকে। পানিশূন্যতা থেকে মুক্ত রাখতে শিশুকে কয়েক চামচ পানি খাওয়ান।

এই খাবারগুলো ৬-৮ মাস বয়সী শিশুকে দিনে ২ বার অল্প অল্প করে ( ২-৩ চা-চামচ পরিমাণ করে) খাওয়াতে হবে সাবধানতার সাথে। আর ৮ মাস থেকে ১ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। দিনে ৩-৪ বার ১ কাপ অথবা ২ কাপ পরিমাণ খাওয়ানো যাবে। 

১ বছর বয়স হলে শিশুকে দৈনিক ১০০০ ক্যালরির খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করুন। সেই ক্যালরিতে যেন ভিটামিন-ডি, ক্যালসিয়াম ও আয়রন থাকে। কারণ শিশুর হাড়ের গঠনের জন্য এই খাদ্য উপাদানগুলো খুব দরকারী। 

১ বছর থেকে ৩ বছর বয়স 

এই সময়ে শিশুরা পরিবারের সবার মতো করে সবকিছু খাওয়া শিখে। এবং নিজের হাতে খেতে শিখে। তাই এই সময়ে শিশুকে পরিবারের সদস্যরা যে খাবারগুলো খায়, সেগুলো শিশুকে একটু একটু করে খেতে দিতে পারেন। বিভিন্ন খাবারগুলো থেকে বিভিন্ন পুষ্টি পাওয়ায় শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন বাড়তে থাকবে।

২ বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। আস্তে আস্তে বুকের দুধ খাওয়ানো কমাতে হবে। ১ বছরের পর থেকে গরুর দুধ খেতে দিতে পারা যাবে। তখন থেকে শিশু মধুও খেতে পারবে। 

ফলমূল, শাক-সবজি, ডালজাতীয় খাবার, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো শিশুর খাদ্য তালিকায় যোগ করুন এবং পরিমাণ বাড়ান। দিনে ৪-৫ বার খেতে দিন শিশুকে।
২ বছর হয়ে গেলে বুকের দুধ খাওয়ানো বাদ দিতে পারেন। তখন থেকে শিশুকে সঠিক ও উপযুক্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন। ২ বছরের পরও বুকের দুধ খেতে চাইলে কৌশলে তা করা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে চেষ্টা করুন।

৩ বছরের পর থেকে শিশুর খাওয়ার উপর স্বাধীনতা দিন। সে যা খেতে চায় খেতে দিন। তবে অবশ্যই কোনো ক্ষতিকর খাবার খেতে দেওয়া যাবে না। 

যা যা করণীয়

  • শিশুর কখন খিদে লাগে ও খাওয়ার সময় হয় তা খেয়াল রাখুন। খিদে পেলে শিশুরা মুখে আঙুল দিয়ে খাওয়ার জন্য সংকেত দিয়ে থাকে। তখন শিশুকে খেতে দিন।
  • ১ বছর হয়ে গেলে শিশু নিজের হাতে খেতে শিখবে। তখন শিশুকে একটি বাটিতে দরকারী পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার খেতে দিন। সে নিজে নিজে যতটুকু পারে বাটি থেকে নিয়ে খাবে। যদি নিজ হাতে খেতে সমস্যা হয়, তাহলে শিশুকে খাবার কীভাবে তুলে খেতে হয় তা শিখান। 
  • শিশু যখন খাবে তখন শিশুর পিঠে হাত বুলিয়ে ও নরমভাবে কথা বলে খাওয়াতে আগ্রহী করুন। খেতে শুরু করলে খাওয়া শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং শিশুর খাওয়ার প্রশংসা করুন।
  • শিশুকে ঠাণ্ডা খাবার খেতে দিবেন না। খাবার ফ্রিজে রেখে দিলে খাওয়ানোর সময় খাবার গরম করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে খেতে দিন।
  • ক্ষতিকর কোনো খাবার, অতিরিক্ত লবণ ও মশলাযুক্ত খাবার, ঠাণ্ডা পানীয় বা কোল্ড ড্রিংকস খেতে চাইলে কৌশলে তা খাওয়া থেকে বিরত রাখুন। তসর বদলে শিশুর পছন্দের পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন। 
  • শিশুর পছন্দের খাবারগুলো খেতে দিন। কোনো পুষ্টিকর খাবার যদি সে পছন্দ না করে, তাহলে পছন্দের খাবারের সাথে অপছন্দের খাবার মিশিয়ে খেতে দিন। 

Cautions for baby
Cautions


সতর্কতা

  • কখনোই জোর করে খাওয়াতে যাবেন না।
  • খেতে না চাইলে খাবার রেখে দিন, আর কিছুক্ষণ পর আবার শিশুকে খাওয়ার জন্য বলুন। তবুও না খেতে চাইলে জোর করবেন না। কিছুক্ষণ পরপর খাবার খেতে বলুন।
  • অতিরিক্ত খাবার খাওয়াবেন না। শিশুর জন্য যতটুকু দরকার, সেই পরিমাণ খাওয়া হয়ে গেলে শিশু আর না খাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তখন আর বাড়তি খাওয়াতে যাবেন না।
  • ৯-১০ মাস বয়সের আগে শিশুকে টকজাতীয় ফল না খাওয়ানোই ভালো। 
  • ১ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত গরুর ও অন্যান্য প্রাণীর দুধ খাওয়াবেন না।
  • ফিডারে করে দুধ খাওয়ালে ফিডারের ফুটো এমনভাবে রাখুন যেন একসাথে বেশি দুধ বের না হয়। ফুটো দিয়ে বেশি দুধ বের হলে শিশুর গলায় আঁটকে গিয়ে অথবা নাকমুখ দিয়ে দুধ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে যেতে পারে। 
  • গলায় আঁটকে যায় এমনভাবে খাওয়াবেন না ও এমন কোনো খাবার দিবেন না। সহজপাচ্য খাবার দিন।
  • শিশুকে ধুমপানরত ব্যক্তি অর্থাৎ ধুমপান এর আশেপাশে থেকে দূরে রাখবেন।
  • তামাক, অ্যালকোহলের সংস্পর্শে আসতে দিবেন না।
  • অতিরিক্ত ঝাল, মশলাযুক্ত খাবার, কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন।
  • চকোলেট ও অন্যান্য বেশি চিনিযুক্ত খাবার খেতে দিবেন না। খেতে চাইলে কৌশল অবলম্বন করুন। যদি খেতেই চায় খুব করে তাহলে অল্প খেতে দিন ও এসব খাবারের ক্ষতি সম্পর্কে বলুন।
  • হাবিজাবি খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন। শিশুর দরকার পর্যাপ্ত পুষ্টি। সঠিক খাবার নির্বাচন করে শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবেন।
  • বাসি, পঁচা খাবার কোনোমতেই খাওয়ানো যাবে না। এসব খাবার থেকে বিষক্রিয়া হয়ে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি শিশুর মৃত্যুর কারণও হয়ে যেতে পারে। 
  • শিশু একদমই কোনো খাবার খেতে না চাইলে, খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে, শিশুর স্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেলে সতর্ক হোন এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

সবশেষে 

বয়স অনুযায়ী শিশুর খাবার তালিকা তৈরিতে সচেতন হতে হবে। শিশুর যেন কোনো ক্ষতি না হয় এমনভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url