না খেয়ে থাকার উপকারিতা সম্পর্কে জানুন
না খেয়ে থাকার উপকারিতা |
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে না খেয়ে থাকে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের না খেয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে খাবার না পাওয়া অর্থাৎ খাবারের অভাবে অন্যান্য প্রাণীরা না খেয়ে থাকে। আর মানুষ হচ্ছে উন্নত প্রাণী, তাই মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে রয়েছে বিভিন্ন নিয়মকানুন, রুটিন।
মানুষের মধ্যে এক শ্রেণি আছে যারা খাদ্যের সংকটে না খেয়ে থাকে। আরেক শ্রেণিকে বলা যায় অভিজাত শ্রেণি কারণ এই শ্রেণির মানুষ খাবার খায় না রাগ ও অভিমান করে, আবার এই শ্রেণির বেশিরভাগই বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসেবে খিদে সহ্য করে। আপনিও যদি কিছু সময় পর্যন্ত না খাওয়ার অভ্যাস রাখুন, তাহলে সেটা আপনার জন্য হতে পারে উত্তম একটি অভ্যাস। কারণ, খিদে সহ্য করে খালি পেটে থাকার উপকারিতা অনেক।
তার আগে চলুন একটু খোঁজ নিয়ে দেখি চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলছে।
বিশ্বে অনেক ধর্মের মানুষ রয়েছে। ধর্মের ভিন্নতার কারণে একেক ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় রীতিনীতিও ভিন্ন। প্রায় সব ধর্মেই না খেয়ে থাকার একটা রীতি আছে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রতিবছরের আরবি রামাদান মাসকে "সিয়াম সাধনার" মাস হিসেবে পালন করে। সেই মাসে মুসলিমরা সারাদিন না খেয়ে রোজা রাখে। আরবি ভাষায় যেটাকে বলা হয় "সিয়াম সাধনা" করা। আর খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা না খেয়ে থাকাকে পালন করে "ফাস্ট করা বা ফাস্টিং" হিসেবে। হিন্দুরাও মেনে চলে না খেয়ে থাকার এই রীতি, যেটাকে "উপোস থাকা" বলা হয়।
এভাবে ধর্ম অনুযায়ী বিষয়টির নাম আলাদা। সকল ধর্ম অনুযায়ী নাম আলাদা হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় না খেয়ে থাকাকে "অটোফেজি (Autophagy)" বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান না খেয়ে থাকার এই রীতিকে প্রমাণ করেছে উপকারী একটি প্রক্রিয়া হিসেবে।
না খেয়ে থাকা অর্থাৎ অটোফেজি
অটোফেজি দুইটি শব্দের সন্ধিতে গঠিত। একটি হলো "অটো" যার অর্থ নিজে বা স্বয়ং, আরেকটি হলো "ফেজি বা ফ্যাজেইন" যার অর্থ হচ্ছে খাওয়া অথবা খেয়ে ফেলা। পুরো শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় "নিজেকে খেয়ে ফেলা" । এই খেয়ে ফেলা মানে নিজেকে চিবিয়ে, কামড়ে, গিলে খাওয়া নয়। এটা বস্তুত শরীরের অভ্যন্তরীণ একটি কার্যপদ্ধতি, যা শরীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্ষতিকর ও দূর্বল কোষগুলোকে সরিয়ে সবল কোষ সৃষ্টি করে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিষ্কার করে। এই পদ্ধতিকেই খেয়ে ফেলা বলা হয়। এটা শরীরের জন্য বয়ে আনে অনেক উপকার।
অটোফেজি শুরু হওয়ার সময়কাল
১২ থেকে ১৬/১৭ ঘণ্টার উপবাস করার চেয়ে ১৮ ঘণ্টার উপবাস অধিক কার্যকর। কেননা উপবাসের ১৮তম ঘণ্টা থেকেই অটোফেজির কাজ চালু হতে থাকে। তখন কোষের আবর্জনা ও ক্ষয়ে যাওয়া মৃত কোষ পরিবর্তন, পরিমার্জন, প্রতিস্থাপন হয়ে নতুন কোষ তৈরি করে শক্তি উৎপাদন করে যা মানবদেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে দরকার।
আপনি যখন লম্বা সময়ের জন্য খাওয়া বন্ধ রাখেন, তখন দেহের কোষগুলো বাইরে থেকে খাবার পায় না। ফলে বাইরে থেকে খাবার না পেয়ে কোষগুলো নিজেরা অভ্যন্তরস্থ রোগজীবাণু সৃষ্টিকারী কোষ ও আবর্জনা খেতে শুরু করে, এবং পরবর্তীতে নতুন কোষ সৃষ্টি করে। মৃত কোষ সরে সেখানে জন্ম হয় নতুন নতুন সবল কোষের।
শরীরকে অটোফেজি পর্যায়ে নিতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হবে। যত সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকবেন, ততই লাভবান হবেন। কারণ, অটোফেজির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া আপনার ভিতরে শুরু হতে যাচ্ছে।
অটোফেজি ও না খেয়ে থাকার উপকারিতা
১৯৬০ সাল থেকে গবেষণা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে। বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখতে পান যে, শরীরের ভেতরে কোষগুলো নিজেদের মধ্যে এক বড় ঝিল্লির মতো অংশ গঠন করে সেটির ভিতরে কোষগুলোর জন্য ক্ষতিকর ও দূর্বল মৃত কোষগুলোকে বন্দী করে ফেলে। এটা দেখার পর থেকেই মানবদেহে আরও জোরেশোরে গবেষণা চলতে থাকে, যেটাকে "অটোফেজি" নামে পরিচিত করে বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা এতদিনের গবেষণা থেকে অটোফেজি ও না খেয়ে থাকা সম্পর্কে যে যে অবস্থা জানতে সক্ষম হয়েছেন, সেগুলো উল্লেখ করা হলো -
- কেউ যখন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা না খেয়ে থাকে, তখন তার রক্তে শর্করা ও সুগার লেভেল কমে আসে। তখন ইনসুলিনের নিয়ন্ত্রণ রাখা সহজ হয়ে যায়।
- ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলে কিটোসিস (Ketosis) নামক মেটাবলিক ধাপে প্রবেশ করবেন, যেখানে আপনার শরীরের চর্বি আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে শুরু হবে এবং গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ বাড়তে শুরু করে। যার ফলে মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি, বিপাকক্রিয়া, পেশির গঠন, ওজন কমার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটতে থাকে।
- ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা অব্দি থাকলে আরও বেশি চর্বি বা ফ্যাট ক্ষয় হবে এবং রক্তে কিটোনের পরিমাণ বাড়বে। সাথে বিপাকের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে, তাতে ওজন কমতে সাহায্য করবে এবং জমা হওয়া চর্বি গলতে শুরু করবে। এই সময়টাতেই অর্থাৎ ১৮ ঘণ্টা পার হলেই অটোফেজি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়।
- ২৪ ঘণ্টা অভুক্ত থাকলে শরীরের পুরনো অকেজো কোষগুলো ভাঙতে শুরু করবে। তারপর অপ্রয়োজনীয় ও মৃত কোষ ক্ষয় হয়ে নতুন কোষ তৈরি হতে থাকবে। এই সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকার পর্যায়ে এসে শরীরে অটোফেজি পুরোদমে শুরু হবে।
- ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে অটোফেজির কার্যকারিতার মাত্রা ৩০০ গুণ সক্রিয় হয়। তখন দূর্বল, ক্ষতিকর পদার্থ গুলো সরিয়ে দিয়ে শক্তিশালী কোষ গঠিত হবে।
- ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ফাস্টিং করলে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণের হার ৫০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করবে। ফলে আপনার শরীরের মাংসপেশিগুলো আরও সবল ও মজবুত হবে।
- ৫৪ ঘণ্টার পর দেহের ইনসুলিনের মাত্রা একেবারে নিচে নেমে আসবে। ডায়বেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারি দিক এটা।
- একটানা ৭২ ঘণ্টা বা টানা ৩ দিন না খাওয়া অবস্থায় থাকার ফলে আপনার বৃদ্ধ, পুরনো কোষগুলো ক্ষয় হয়ে গিয়ে নতুন কোষ উৎপন্ন হবে।
৩ দিন মানে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এর বেশি ফাস্টিং করতে, না খেয়ে থাকবেন না। তা করা ঠিক হবে না। তাতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। উল্লেখযোগ্য ক্ষতিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শরীরের মাংসপেশির গঠন দূর্বল হয়ে যাওয়া।
আরও কিছু উপকারিতা-
- মস্তিষ্কের গঠন উন্নত ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ভালো প্রভাব ফেলে। জানুন মানসিকভাবে ভালো থাকার উপায়।
- হার্টের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করা। রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নতি।
- শরীরকে বিভিন্ন প্রদাহজনিত রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া।
- ক্যান্সারের চিকিৎসায় সহায়তা করে।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে ও সুস্থতা বজায় রাখতে কাজ করে।
- চেহারায় তারুণ্যভাব ধরে রাখে। চেহারায় বয়সের ছাপ বুঝতে দেয় না।
- একটি গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, আয়ুকাল বাড়াতেও অটোফেজি ও না খেয়ে থাকার অবদান আছে।
তাহলে এখন তো জানতে পারলেন উপকার কী কী হয়। সুস্থ থাকার জন্য হলেও সপ্তাহে একদিন অথবা অন্তত মাসে একদিন না খেয়ে থাকার অভ্যাস করা ভালো। তবে সবার জন্য যেমন রোজা রাখা ঠিক নয়, ফাস্টিং বা না খেয়ে থাকার বেলায়ও তা-ই। ডায়াবেটিস রোগী, কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী, গর্ভবতী, খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত কারও এমনটা করা ঠিক হবে না। সে ব্যাপারে সাবধান থাকবেন।