কোন উপায়ে ফাস্টিং করা ভালো? ফাস্টিংয়ের প্রকারভেদ
Fasting |
ফাস্টিং করা, উপোস করা সম্পর্কে আজকাল অনেকেই অবগত। ফাস্টিংয়ের রয়েছে দারুণ সহায়ক উপকারী দিক। কিন্তু, কার জন্য কোন ফাস্টিং সিস্টেম উপযোগী, কোন সময়ে তা করতে হবে এসব বিষয়ে অনেকেই জানে না। জানার জন্য আজকের এই আলোচনা। কোন উপায়ে ফাস্টিং করা ভালো? ফাস্টিংয়ের প্রকারভেদ ব্যাপারে বলবো আপনাদেরকে।
ফাস্টিং এর ইতিহাস
আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার আগে ফাস্টিং মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। প্রাচীনকালে ফসল ঘরে তোলার মৌসুমে খাদ্যের অনেক প্রাপ্তি থাকতো, মানুষকে না খেয়ে কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ বা ফসলের ক্ষতি হলে মানুষকে কয়েকদিন পর্যন্ত খিদে নিয়ে কষ্ট করতে হতো। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে কোনোরকমে অল্প খেয়ে জীবনধারণ করা লাগতো।
যুগের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিক থেকে জানা যায়, মানুষ প্রাচুর্যের সময় মানে যখন খাবারের সংকট না থাকতো, তখন প্রচুর পরিমাণে খেতো। ফলে শরীরে ফ্যাট জমতো। আর অনাহারে, অভাবে মানুষ শরীরের ফ্যাট পুড়িয়ে বেঁচে থাকতো। এই ভিত্তিতে আমাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া তৈরী। নিজেকে প্রশ্ন করুন সর্বশেষ কবে অনাহারে ছিলেন?
তাই সুস্থ থাকতে হলে আমাদের প্রাচীন নিয়মগুলো অনুসরণ করে ফাস্টিং করতে হবে। এই আধুনিক সভ্যতার যুগে প্রচলিত আছে বিভিন্ন রকমের ফাস্টিং পদ্ধতি। যা একটু পরেই জানতে পারবেন।
ফাস্টিং বিষয়টি নতুন কিছু নয়। প্রায় সব ধর্মেই কোনো না কোনোভাবে ফাস্টিং করার নিয়ম আছে। মুসলমানদের রোজা, অন্যান্য ধর্মানুসারীদের ফাস্টিং, উপোস ইত্যাদি নাম রয়েছে।
ফাস্টিংয়ের প্রকারভেদ কয়টি?
বিশেষ কিছু জনপ্রিয় ফাস্টিং পদ্ধতি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করবো যাতে ফাস্টিং সম্পর্কে আরও বোঝে নিতে পারেন এবং উপকৃত হোন।
প্রথমে শুরু করছি ওয়াটার ফাস্টিং দিয়ে
পানির ফাস্টিং (Water fasting)
সারাদিন এই ফাস্টিং করতে পানি ছাড়া আর কিছু খাওয়া যাবে না। গবেষণায থেকে দেখা গিয়েছে - এই ফাস্টিংয়ের প্রথম দিনে ০.৯ কিলোগ্রাম এর মতো ওজন কমতে পারে। যারা প্রথমবার এই ফাস্টিং করতে যাবেন, তারা আগে থেকে কম খাওয়ার অভ্যাস করবেন যাতে ফাস্টিং করতে খারাপ না লাগে। এই ওয়াটার ফাস্টিং করার ফলে আপনি নিজের শারীরিক কিছু পরিবর্তন দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন আপনার ওজন দ্রুত কমেছে। হৃদরোগ, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের সমস্যা কমে এই ফাস্টিং এর মাধ্যমে।
জুসের ফাস্টিং (Juice fasting)
এই ফাস্টিংয়ে শুধুমাত্র ফলমূল, বিভিন্ন রকমের শাক-সবজির ও ভেজষজাতীয় উদ্ভিদের রস পান করা হয়। এই ফাস্টিং শরীরের অবস্থা বুঝে ৩ দিন থেকে ৭ দিন পর্যন্ত করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে - জুস ফাস্টিং চলাকালীন শারীরিক সমস্যার ধরন অনুযায়ী মানে কারও শরীরে কোনো সমস্যা, রোগ থাকলে সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে ফলফলাদি, শাক-সবজি নির্বাচন করতে হবে।
কারণ, সবার শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ অবস্থা একরকম না। অথবা অনেক সময় প্রয়োজনের জন্য বিভিন্ন খাবার নানাভাবে কাজে লাগতে পারে। জুস ফাস্টিং আপনার ইমিউনিটি সিস্টেমকে আরও সচল করে এবং আপনার শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে আরও সতেজ করে তুলবে।
থেরাপিউটিক (Therapeutic fasting)
থেরাপিউটিক ফাস্টিংয়ের মূল কাজ হলো রোগাক্রান্ত, দূর্বল শরীরকে আরোগ্য করে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা। শরীরে থেরাপি দেওয়ার কাজ করে এটি। থেরাপিউটিক ফাস্টিংয়ের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে চিকিৎসাক্ষেত্রে । শরীর থেকে দূষিত বর্জ্য পদার্থ বের করে দেওয়া এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্যই এই ফাস্টিং থেরাপি করা হয়ে থাকে।
শুকনো ফাস্টিং (Dry fasting)
ড্রাই ফাস্টিং হচ্ছে সূর্য উদয়ের আগে থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের শক্ত কিংবা তরল খাবার থেকে বিরত থাকা। মুসলমানদের সিয়াম বা রোজা পালন করার মতো। ১ দিনের ড্রাই ফাস্টিং ৩ দিনের ওয়াটার ফাস্টিং এর সমান কার্যকর।
সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন কিংবা মাসে ১৫ দিন অথবা একমাস বা ৪০ দিন পর্যন্ত ড্রাই ফাস্টিং করা যেতে পারে।
ভালো ফল পেতে থেরাপিউটিক নিয়মে খাবার খাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। খাবারকে ওষুধ হিসেবে খেতে হবে, যাতে খাবার পরিপূর্ণভাবে শরীরে কাজ করতে পারে। রোজার সময় সাহরি ও ইফতারে ভাত, মাছ, মাংস, ভাজাপোড়া এবং বাইরের খোলা খাবার আর প্যাকেটজাত খাবার খেলে উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি।
তাই খাবার নির্বাচনে ড্রাই ফাস্টিং করার জন্য গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো - ভিটামিন, প্রোটিন , উপকারী ফ্যাট, আঁশজাতীয় এবং বিভিন্ন মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। শর্করাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে পারলে বেশি ভালো।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent fasting)
বর্তমান সময়ের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফাস্টিং পদ্ধতি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। এই ফাস্টিং পদ্ধতিতে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় নিজের পছন্দ মতো খেয়ে , বাকি দীর্ঘসময়ে কোনো কিছু না খেয়ে থাকতে হয়। তাতে শরীরের ফ্যাট ঝরে যেতে থাকে আর মেটাবলিজম বা বিপাকক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।
এই পদ্ধতিতে কেউ একদিনের ২৪ ঘন্টাকে ১৬ঃ৮ ভাগে ভাগ করতে পারেন। অর্থাৎ দিনের ১৬ ঘণ্টা খাওয়া ছাড়া থাকা আর বাকি ৮ ঘণ্টায় পরিমাণ মতো খাওয়া।
এই ফাস্টিংয়ের আগের ও পরের দুটি বেলার খাবারই সুষম ও স্বাস্থ্যকর হতে হবে। তবে অবশ্যই কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাত উপাদান কমিয়ে খেতে হবে, যদি দ্রুত ওজন কমাতে চান। প্রচুর ফাইবার বা আঁশযুক্ত, মিনারেলস সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। সাদা আটার জায়গায় লাল আটার রুটি অথবা লাল চালের ভাত, সালাদ, দুধ, ডিম, কলা, টকদই, শুকনো ফল, চিয়া সীডস খেতে পারেন।
যারা কখনো আগে এই ফাস্টিং করেনি, তাদের উচিৎ শুরুর দিকে ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা দিয়ে শুরু করা। এইভাবে আস্তে আস্তে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা, তারপর ১৪, ১৫ আর ১৬ ঘণ্টায় আসবেন। এতে সহজ ও সুবিধা হবে। আর যাদের আগে থেকে এটি করতে অভিজ্ঞতা আছে, তাদের ১৬ ঘণ্টা বা সময় আরও বাড়িয়ে ফাস্টিং প্রক্রিয়াটি করতে পারেন।
ফাস্টিংয়ের সময় কী কী খাওয়া যেতে পারে
- পানি। পানি তো খেতে হবেই। পানি ছাড়া তো থাকা যাবে না।
- ব্ল্যাক কফি বা ডার্ক কফি, তবে চিনিমুক্ত।
- গ্রীন টি।
- হার্বাল ও বিভিন্ন ভেষজ গুণসম্পন্ন চা
- ব্ল্যাক টি বা লিকার চা। চিনি ছাড়া খেতে হবে।
- লেবুর রস।
- অ্যাপল সাইডার ভিনেগার।
এই গেল কোন উপায়ে ফাস্টিং করা যায় আর ফাস্টিংয়ের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা।
সর্বশেষ
আপনার নিজের বয়স, স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থা ব্যাপারে সচেতন হয়েই তবে আপনার জন্য সঠিক ফাস্টিং পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন।