দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে যে কাজগুলো

পৃথিবী ও জীবন-যাপন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসায় বাড়ছে মানুষের মনোদৈহিক বিভিন্ন সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ হলো সাম্প্রতিককালে মানুষের মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে একটি। বয়স বাড়ায়, খাদ্যাভ্যাসের ধরন, শরীর খাটানোর অপর্যাপ্ততা, কিছু বদভ্যাস উচ্চ রক্তচাপ ঘটিয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়েই আজকের লেখাটিতে থাকবে দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে যে কাজগুলো করবেন।

দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে
উচ্চ রক্তচাপ


  • উচ্চ রক্তচাপ 
  • উচ্চ রক্তচাপ কেন ঘটে?
  • রক্তচাপ টেস্ট করা।
  • দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে যে কাজগুলো।
  • উপসংহার । 

উচ্চ রক্তচাপ 

হাই ব্লাড প্রেশার, বাংলায় যাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে। চিকিৎসাশাস্ত্রে "হাইপারটেনশন" ও বলে থাকে। রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধলে নালি দিয়ে রক্তের প্রবাহে বাঁধাগ্রস্ত হয়, রক্ত চলাচলের এররকম অবস্থা-ই উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে।

জীবনযাত্রাতে কিছু অভ্যাসই আসলে উচ্চ রক্তচাপ এর মতো ভয়ানক অবস্থাটির ঘটনা ঘটায়। সেরকম কোনো লক্ষণের উপস্থিতি না থাকায় রোগটির উপস্থিতি সম্পর্কে সহজেই কেউ ধরতে পারে না পরীক্ষা করা ছাড়া। লক্ষণের উপস্থিতি না বুঝতে পারায়, অনেকে বিনাচিকিৎসায় ভোগে মারা যায়। এজন্য এটাকে "নীরব ঘাতক" রোগও বলে। কারণ, এরজন্য হৃদরোগে ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে, যা মৃত্যুও ঘটায়।
আমাদের হৃদপিণ্ড অর্থাৎ হার্টের  রক্ত প্রবাহের কাজ করার দুটো অবস্থা বিরাজমান।
 
অবস্থাদ্বয় হলো একটি সিস্টোলিক রক্তচাপ, আরেকটি ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ। যখন হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করে ও সারাদেহে রক্তের প্রবাহ করে, সেটাকে সিস্টোলিক চাপ বলা হয়। সিস্টোলিক চাপ বোঝা যায় হৃদপিণ্ড অর্থাৎ হার্টের উপর হাত রেখে হৃদপিণ্ডের কাঁপা অনুভব করে। আর যখন হৃদপিণ্ড রক্ত পাম্প করার ফাঁকেফাঁকে রেস্ট নেয়, তখন সেই অবস্থাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে। বুকে হাত দিয়ে যখন অনুভব করবেন হৃদপিণ্ড কাঁপার সময় মাঝেমধ্যে থামে, ঐ থামা-ই হলো ডায়াস্টোলিক চাপ।
  
আবার মানের কমবেশি নির্ণয়ের জন্যও দুইটি ভাগ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার), নিম্ন রক্তচাপ (লো ব্লাড প্রেশার)। 
প্রতি মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপের মান হলো ৯০/৬০ মিলিমিটার থেকে ১২০/৮০ মিলিমিটার। যদি ১২০/৮০ মিলিমিটারের বেশি কারও রক্তেরচাপ হয়, তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ। আর ৯০/৬০ মিলিমিটারের কম হলে সেটি নিম্ন রক্তচাপ।

আমাদের আজকে আলোচনার বিষয় হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। এটি কেন ঘটে, এটি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সেটিই বলা হবে।


উচ্চ রক্তচাপ কেন ঘটে? 

এটি ঘটার পেছনে মানুষ-ই দায়ী। অস্বাস্থ্যকরভাবে প্রতিদিনের জীবনকর্ম করা, খাদ্যাভ্যাসের ধরন, মনোদৈহিক অবস্থা,  ধুমপানকারী, মদপানকারী, বার্ধক্য, দূরারোগ্য কোনো রোগে অনেকদিন ধরে ভোগান্তিতে থাকা, অধিকতর ফ্যাটযুক্ত, অতিস্থুলকায় ( অতি মোটা) ধরনের মানুষদের রক্তচাপের এই ধরণটিতে আক্রান্তের ঘটনা বেশি ঘটে।  স্বাভাবিক রক্তচাপ একজন মানুষের সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থা নির্দেশ করে। এই কাজগুলোর জন্যে হৃদপিণ্ড তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় ও বাঁধা পায়। রক্তচাপ হওয়ার কারণসমূহের ধারণা থাকলে, এর প্রতিরোধ করার জন্য সাবধানতার সাথে চলা যায়।


রক্তচাপ টেস্ট
রক্তচাপ টেস্ট করা


রক্তচাপ টেস্ট

স্বাস্থ্যকর্মী স্টেথোস্কোপ যন্ত্র দিয়ে তা রোগীর হাতের বাহুর কাছের ধমনীর উপর যন্ত্রটি রেখে রক্তের প্রবাহ লক্ষ্য করে রক্তচাপ কেমন আছে তা টেস্ট করে। ব্যথাহীন সহজ টেস্ট।
১৮ বছর ও এর উর্ধ্ব বয়সী যাদের রক্তচাপ হবার কারণ রয়েছে তাদের ৩ অথবা ৫ বছরে একবার রক্তচাপ টেস্ট করা উচিত। ৪০ ও এর উর্ধ্ব বয়সী যাদের রক্তচাপ বাড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তাদের প্রতি বছরে একবার টেস্ট করা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো দীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসছে তাদের এক মাস পরপর টেস্ট করা উচিত।


দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে যে কাজগুলো করবেন 

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, জীবন-যাপনের অভ্যাসগুলো সঠিকতার সাথে করার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করা যায় ৭০ ভাগ পর্যন্ত। সুতরাং, আপনার প্রতিদিনের জীবনকর্মে কিছু পরিবর্তন আনা ও তা সঠিকতার সাথে মানলে রক্তচাপের এরূপ প্রতিরোধ করতে পারা যাবে। যে কাজগুলো করা উচিত:

মনের সুস্থতা: আগে নিজের মনের যত্ন নিতে হবে। মন ভালো না থাকা, মানসিকচাপ, হতাশাগ্রস্ততা, রেগে যাওয়া,  রক্তচাপকে প্রভাবিত করে দেয়। মানসিকচাপের কারণে রক্তেরচাপ ও হৃদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যায়। ক্রমেই যদি এরূপ অবস্থা চলতে থাকে হৃদপিণ্ডের উপর, তাহলে একসময় হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ঠিক ভাবে করতে পারে না। সুতরাং, মানসিকদিক থেকে ভালো থাকতে পারলে হৃদপিণ্ডও ভালো থাকবে।

খাদ্যাভ্যাস: লবণ ও চিনি যত পারা যাবে না খেতেই চেষ্টা করতে হবে। লবণ কম খেলে দুই ডোজের মতো ঔষধ নেওয়ার সমান উপকার হয়। শুধু লবণই নয়, লবণাক্ত খাবারেও সতর্ক থাকতে হবে। সোডিয়াম বেশি না নিয়ে, পটাশিয়ামযুক্ত খাদ্যগ্রহণে মনোযোগ দেন। দুধ, কলা, দই, মাছ, তেঁতুল থেকে পটা শিয়াম পাবেন। আমিষজাতীয় খাদ্যে নজর দিন, কম ক্যালরি আছে এমন খাদ্যে অভ্যস্ত হন। পানি বেশি করে খান।

শারীরিকক্রিয়া: ডেইলি কমপক্ষেও ২৫ মিনিট শারীরিকক্রিয়া অর্থাৎ ব্যায়াম করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাজেস্ট করে। ২৫ মিনিটের শারীরিকক্রিয়া হৃদপিণ্ডের কাজ, রক্ত পাম্প করা ও মাংসপেশির মুভমেন্ট উন্নত করে এবং বিভিন্ন রোগবালাই থেকে সুরক্ষাও দেয়। লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ির ব্যবহার করুন, গাড়িতে চলাচল না করে হাঁটার মাধ্যমে নিকট গন্তব্যে যান, দলবেঁধে খেলা হয় এমন খেলাগুলো খেলুন। ভারী-ভারী করতে হবে না, সহজকিছু ব্যায়াম-ই করুন। একেবারে অলস না থেকে, সামান্য পরিশ্রমটুকু করলেও তা হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখার কাজ করে। কম করেও  ৩০ মিনিট হাঁটার  চেষ্টা করতে হবে।

নিয়ন্ত্রিত ওজনের মধ্যে থাকা: অতিস্থুলকায়, অতি মোটা মানুষকে রক্তচাপ এর ধকলের মধ্যে যেতে হয়। ধকল সামলানোর জন্য নিয়ন্ত্রিত ওজনের মধ্যে নিজের থাকা তাই গুরুত্বের কাজ। বডির হাইট (উচ্চতার) এর সাথে ওয়েইটের বিএম আই বজায় রাখলে রক্তচাপের ঝুঁকি প্রতিহত করা সম্ভব।

করুন ফাস্টিং: হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ওজনাধিক্যতা, উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে ফাস্টিংয়ের ভূমিকা দারুণ। ফাস্টিংয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়, তার দরুন রক্তে গ্লুকোজ-এর, কোলেস্টেরল-এর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় যা ডায়াবেটিস-এর ঝুঁকি কমায়। ফাস্টিংয়ের কারণে ওজনেরও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, হৃদপিণ্ডের রক্ত পাম্প করাও ঠিক হয়ে থাকে।

ধুমপানে ও মদপানে সীমাবদ্ধতা: নিজের ভালো চাইলে অবশ্যই এই দুই অভ্যাস ও কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। মদপান রক্তনালির উপর চাপ ও তা সংকোচিত করে হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাতকারী বস্তু। মদ অতিরিক্তই ক্যালোরি বহন করে যা রক্তচাপে ও ওজনাধিক্যতায় প্রভাবকের কাজ করে।  ধুমপানেও রক্তনালির সংকোচন হয়। 

এছাড়া ধুমপানে ফুসফুসের সমস্যা, হৃদরোগ, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। শুধু এ-ই নয়, এই দুই বদভ্যাস আর ও অনেক শরীরস্থ জটিলতা তৈরি করে। হয় এই দুই বস্তু গ্রহণে সীমাবদ্ধ হন, না হয় বন্ধ করে দিন। তাতে আপনারই ভালো।

ক্যাফেইনে সীমাবদ্ধতা: কফি, কোল্ড ড্রিংকসের বিভিন্ন পানীয়, চা এগুলোও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে থাকে। এগুলো গ্রহণ করা সীমিত করুন। 

স্লিপ: শরীরস্থ বিভিন্ন কার্যাদি সুষ্ঠুতার সাথে সম্পাদনের জন্য নিশ্চয়ই সঠিক ও সময়মতো ঘুমানোর প্রয়োজন। বয়সে যারা প্রাপ্ত, তাদের ডেইলি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার ঘুম দরকার।

করোনারি ও হার্ট অ্যাটাকের, ডায়াবেটিসের, স্ট্রোকের, কিডনিসমস্যার মতো মরণঘাতী রোগীগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ আরও সুযোগ করে দিয়ে থাকে ভয়ানক হবার। ভয়ানক এসব রোগকে প্রতিরোধ করার জন্য রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে হবে। আর তা করতে পারবেন আপনার নিত্যদিনের অভ্যাসের চেঞ্জ করে।


উপসংহার

উচ্চ রক্তচাপ মারাত্মক একটি রোগ। দ্রুত এর প্রতিরোধ করা কঠিন হবে যদি আপনি অভ্যাসের চেঞ্জ না করেন। দ্রুত উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে যে কাজগুলো নিয়ে বললাম, এগুলো মানতে পারলে আপনার ৭০ ভাগ হেল্প হবে প্রতিরোধ করার। আর বাকি ভাগটুকু ওষুধপথ্যের।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url