মেয়েদের জন্য মারাত্মক রোগগুলো কী কী?
মেয়েদের শরীরের বাহির ও ভিতরের অবস্থা ছেলেদের তুলনায় ভিন্ন হওয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি মেয়েদের। এখানে মেয়েদের বলতে পুরো নারীজাতি (মানুষ) বুঝানো হয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীজাতির গড় আয়ু বেশি হলেও, বিভিন্ন রোগশোকে ভোগার হারও মেয়েদের বেশি। সকল রোগসমূহের মধ্যে কিছু রোগ আছে যা মেয়েদের জন্য মারাত্মক। কিন্তু কেন মেয়েদের রোগ বেশি? মেয়েদের জন্য মারাত্মক রোগগুলো কী কী?
টাইটেল-
- মেয়েদের রোগ বেশি হয় কেন?
- উল্লেখযোগ্য কিছু রোগ
- মেয়েদের জন্য মারাত্মক রোগগুলো কী কী?
- বয়সভেদে মেয়েদের মারাত্মক রোগগুলোর তালিকা
- উপসংহার
মেয়েদের রোগ বেশি হয় কেন?
উন্নত দেশগুলোর চাইতে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে মেয়েদের রোগ বেশি হয়। এর কারণও আছে। উন্নত দেশের মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও সুযোগসুবিধা নারীরা পায় না তুলনায় গরীব দেশগুলোতে বসবাস করায়। কিন্তু তাই বলে উন্নত দেশের মেয়েরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় না, এমনটা না। সব দেশেই মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় বেশি রোগে ভোগে থাকে। এই হলো ভৌগোলিক কারণ যার কারণে এক দেশের চাইতে অন্য দেশের নারীরা বেশি রোগে ভোগে।
সবচেয়ে বড় যে কারণটি সেটা হলো শারীরিকভাবে গাঠনিক ভিন্নতা। প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষের তুলনায় নারীজাতির শরীরে কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ও প্রক্রিয়ার পার্থক্য আছে। যেমন- গর্ভধারণ, হরমোন, স্তন, পিরিয়ড। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় এই তিনটি বিষয়ের জন্যই মেয়েরা বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে সারাজীবন।
আরেকটি কারণ নারীরা চিকিৎসা নিতে উদাস। পরিবারের আর্থিক কারণের কথা ভেবেই হোক বা লজ্জার কথা ভেবে, নারীরা চিকিৎসা নিতে বেশি আগ্রহ দেখায় না। এই যে চিকিৎসার প্রতি অনীহা, উদাসীনতা, এই কারণে রোগগুলো আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং মারাত্মক হয়ে যায়। আবার সমাজে মেয়েদের পেছনে ফেলে রাখা, পারিবারিক ও সাংসারিক নিগ্রহের শিকার হওয়াও অন্যতম এক কারণ। এসব বিভিন্ন কারণে মেয়েরা সারাজীবন ছেলেদের তুলনায় বেশি ব্যথা ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায়।
উল্লেখযোগ্য কিছু রোগ
অনেক প্রকারের রোগে বিশ্বের অনেক মানুষ ভোগে। তারমধ্যে মেয়েদের রোগগুলো কিছু আলাদা প্রকারের হয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিছু রোগ নিয়ে বললে সেগুলো হলো: ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, পিসিওএস বা PCOS, ভুলে যাওয়া বা আলঝেইমার্স, ডায়াবেটিস, ওজনাধিক্যতা, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি জনিত ও শ্বাসযন্ত্রের রোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মেয়েদের জন্য মারাত্মক রোগগুলো কী কী
উপরেই কিছু উল্লেখযোগ্য রোগের কথা বলেছি। এখন বলবো ক্রমানুসারে কোন রোগগুলো মারাত্মক অর্থাৎ সবচেয়ে ভয়ংকর ও মারাত্মক রোগগুলো নিয়ে। বিশ্বে মারাত্মক ১০ টি রোগের কথা বলা হলো-
১. হৃদরোগ: বিশ্বের সব দেশেই মেয়েদের অর্থাৎ নারীদের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ হলো হৃদরোগ বা হার্টের রোগ। এবং এই রোগটিতে মারা যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এতে মারা যাওয়ার হার ২১.৮%, প্রায় ২২%। হার্ট সম্বন্ধীয় সকল রোগ এই রোগের অন্তর্ভুক্ত। হার্ট অ্যাটাক, করোনারি অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর এটির অন্তর্ভুক্ত।
২. ক্যান্সার: শুধু ক্যান্সার না বলে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তনের ক্যান্সার বললে নির্দিষ্ট করে বুঝানো যায়। দ্বিতীয় মারাত্মক হচ্ছে এই রোগটি। এতে মারা যাওয়ার হার ২০.৭%, প্রায় ২১% এর কাছাকাছি।
৩. স্ট্রোক: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া রক্তস্বল্পতার জন্য এই রোগটি হয়ে থাকে। ঘাতকের তালিকায় এই রোগটি তৃতীয় মারাত্মক। গর্ভধারণ ও উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেহেতু প্রতিটি নারীই গর্ভধারণের উপযোগী, আর স্ট্রোক প্রেগন্যান্সি সম্পর্কিত হওয়া, সেহেতু স্ট্রোকে আক্রান্তের ঘটনা মেয়েদের মধ্যে ঘটে। বিশ্বব্যাপী এই রোগে মৃত্যুর হার ৬.২%।
৪. শ্বাসতন্ত্র: চতুর্থ মারাত্মক হলো শ্বাসতন্ত্রের রোগ। ফুসফুসে শ্বাসকার্যের বাঁধা সৃষ্টি হলে এটি হয়। ওজনাধিক্যতা, স্লিপ এপনিয়া, হৃদরোগ এর কারণে ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের এই রোগটি আরও বাড়ে। এতে মৃত্যুর হার ৬.২%।
৫. আলঝেইমার্স: ডিমেনশিয়াও বলা হয়, বাংলাতে "ভুলে যাওয়া রোগ"। মস্তিষ্কের নিউরনে স্বাস্থ্যকর ব্রেইন কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলে এই রোগ হয়। মস্তিষ্ক মানবদেহের নিয়ন্ত্রক বলা হয়, কারণ এটি সারা দেহে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কাজ করে ও নির্দেশ দেয়। মস্তিষ্কে আলঝেইমার হওয়ায় মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে পড়ে। আর মস্তিষ্ক দূর্বল হয়ে গেলে পুরো শরীরই অচল। ফলে এটি মৃত্যু ঘটায়। ৬.১% হার নিয়ে আলঝেইমার পঞ্চম মারাত্মক।
৬. অনিচ্ছাকৃত রোগ: এটাকে আসলে রোগ বলা যাবে না। সড়ক দূর্ঘটনা, আগুনে পুড়ে, পানিতে পড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা, মারামারি, খুন, ধর্ষণ ও বিভিন্ন এক্সিডেন্ট হলো এটির আওতাধীন। এই ঘটনাগুলো কারও ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটে না, তাই এসব কারণে হওয়া মৃত্যুকে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু বা মৃত্যুর কারণ বলা হয়। সারাবিশ্বে এতে মৃত্যুর ঘটনা ৪.৪% বা তারও কিছু বেশি।
৭. ডায়াবেটিস: নারীদের তুলনায় পুরুষরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এটি মেয়েদের জন্য সপ্তম ভয়ংকর রোগ। এটির কারণে হার্টের রোগও ভয়ংকর হয়ে উঠে। গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিসের কারণে মৃতের ঘটনা ঘটতে পারে ও ঘটেও। এতে মৃতের হার ২.৭, প্রায় ৩%।
৮. নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জা: সর্দিকাশি থেকে হওয়া নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগেও অনেক মেয়েরা মারা যায়। মৃত্যুর হারও ২% এর অধিক।
৯. কিডনি রোগ: পুরুষেরা এটাতে বেশি শিকার হলেও নারীরাও বাদ যায় না। প্রায় ২ এর কাছাকাছি হারে এতে মৃত্যু ঘটে।
১০. রক্তে বিষক্রিয়া: নামেই বোঝা যাচ্ছে এটি রক্ত সম্পর্কিত। রক্ত মানবদেহ সহ সকল প্রাণীকূলের দেহেই অক্সিজেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পাদনের কাজ করে। রক্ত যদি দূষিত হয়ে যায় ও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাহলে শরীরে অক্সিজেন পৌঁছাবে না। আর অক্সিজেন না পেলে মৃত্যু অনিবার্য। এটি হয় যারা আগেই কোনো জটিল রোগে ভুগছে। কিডনিজনিত, ফুসফুসজনিত কারণে রক্তে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এতে মৃত্যুবরণ করে।
১১. যৌন রোগ: জরায়ুর ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। যৌনাঙ্গের বিভিন্ন সংক্রমণ কোনো কোনো মেয়ের জন্য ভয়ংকর হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসার অভাবে সেই রোগও মৃত্যু ঘটায় মেয়েদের।
১২. হাড় ভঙ্গুর হওয়া: এটাকে অস্টিওপরোসিসও বলা হয়। হাড় দূর্বল হয়ে ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়ে যাওয়া এরোগের লক্ষণ। নির্ধারিত বয়সের আগে মেনোপজ, ক্যান্সার, ও কিছু ঔষুধের প্রতিক্রিয়ায় এরোগটি হয়ে থাকে। হাড় দেহকে সুগঠিত রাখে, দেহকে ধরে রাখে। হাড়ই যদি ভেঙে যায়, তাহলে শরীর টিকবে কীভাবে? তখন এরোগে মৃত্যু হয় মেয়েদের।
এগুলো হলো মেয়েদের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ। এগুলোতে নারীদের মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এছাড়াও আরও রোগ আছে যেগুলো ততটা ভয়ংকর না হলেও, সঠিক চিকিৎসা না নিলে ভয়ংকর হতে থাকে।
বয়সভেদে মেয়েদের মারাত্মক রোগগুলোর তালিকা
সব বয়সেই সব রোগ হয় না। কিছু রোগ আছে বাল্যকালে হয়, কিছু আছে যৌবনে, আর কিছু আছে মধ্যবয়সে ও শেষ বয়সে হয়। এমন একটি তালিকা তুলে ধরবো যা দেখে বোঝে নেওয়া যাবে কোন বয়সী মেয়েরা কোন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
বাল্যকাল
(১৯ বছর বয়সী পর্যন্ত)
১. অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু হয় বেশি (বিভিন্ন এক্সিডেন্ট)।
২. ক্যান্সার।
৩. আত্মহত্যা।
৪. খুন, ধর্ষণ।
৫. জন্মগত কোনো ত্রুটির জন্য।
৬. হৃদরোগ।
৭. ঠাণ্ডাজনিত (নিউমোনিয়া)।
৮. স্ট্রোক।
৯. শ্বাসতন্ত্রের রোগ।
১০. হরমোনাল কারণ।
১১. অকালে গর্ভধারণ।
যৌবন - মধ্যবয়স
(২০ বছর থেকে ৪০ বছর)
১. অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু (বিভিন্ন এক্সিডেন্ট)।
২. ক্যান্সার।
৩. হৃদরোগ।
৪. আত্মহত্যা।
৫. খুন, ধর্ষণ।
৬. কিডনি ও লিভার জনিত।
৭. ডায়াবেটিস।
৮. স্ট্রোক।
৯. যৌন ও গর্ভধারণগত কারণে।
১০. রক্তে বিষক্রিয়া।
১১. হরমোনাল।
মধ্যবয়স - শেষ বয়স
(চল্লিশের বেশি বয়সী)
১. ক্যান্সার।
২. হৃদরোগ।
৩. অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু (এক্সিডেন্ট)।
৪. শ্বাসতন্ত্রের রোগ।
৫. আলঝেইমার।
৬. ডায়াবেটিস।
৭. স্ট্রোক।
৮. কিডনি ও লিভার জনিত।
৯. আত্মহত্যা।
১০. রক্তে বিষক্রিয়া।
১১. হরমোনাল ।
তালিকায় কোন বয়সে মেয়েরা কোন রোগের শিকার হয় বেশি, সেভাবে সিরিয়াল করা হয়েছে। তালিকায় দেখা যাচ্ছে আলঝেইমার শুধু শেষ বয়সীদের বেলায়। ঠিক তা-ই। কারণ, ষাটের বেশি বয়সী নারী-রাই কেবল এরোগে বেশি শিকার হয় ও মৃত্যুহারও বেশি।
আরও দেখা যাচ্ছে যে যৌন ও গর্ভধারণগত সমস্যায় মৃত্যু হয় বাল্যকাল থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত। এটার কারণ হচ্ছে পিরিয়ড তো বয়ঃসন্ধিতে ও আর মেনোপজ হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে, তাই এই সময়টাতে পিরিয়ড তথা যৌনরোগজনিত কারণে মারা যায়। গর্ভধারণও তা-ই, সকল মেয়েরাই ১৫ বছর থেকে ৪০ বছরের মধ্যকার সময়ে সন্তান নিয়ে থাকে। তাই মধ্যবয়সের পর আর এই দুই কারণে ( যৌন ও গর্ভধারণগত) মৃত্যু ঘটে না।
উপসংহার
মেয়েদের জন্য মারাত্মক রোগগুলোর যে তালিকা তুলে ধরা হয়েছে তা দেখে রোগের সময়কাল সম্পর্কে একটা মোটামুটি ভালো ধারণা পাওয়া যায়। তাই যে বয়সী-ই মেয়েই হোক, কোনো অস্বাভাবিকতা এবং কোনো লক্ষণ বোঝা ও দেখা গেলে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রোগী ও পরিবার সবার কর্তব্য।