দাঁতের ব্যথা সহজেই দূর করতে ব্যবস্থা
দাঁতের ব্যথায় যারা ভোগেন, তারা জানে এই ব্যথা কত ভয়ংকর আর কষ্টকর। কেউ কেউ বলেই ফেলে, সব ব্যথা সহ্য হলেও দাঁতের ব্যথা সহ্য হয় না। সহ্য না হবারই বিষয়, কারণ দাঁত তো মানুষের মুখের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অমূল্য সম্পদ। দাঁত খাবারকে সহজ ও নরম করে খেতে সাহায্য করে ফলে হজমক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে না। কেন হয় দাঁতের ব্যথা? দাঁতের ব্যথা সহজেই দূর করতে কী করতে হবে এই নিয়ে অনেকেই জানে না। সঠিক কারণ না জানায়, সঠিক ব্যবস্থাও নিতে পারে না। আমি সঠিক কারণ, ব্যবস্থা বিষয়ক তথ্য নিয়েই আপনাদের উদ্দেশ্যে লিখছি আর্টিকেলটি।
কেন হয় দাঁতের ব্যথা?
মুখে খাবার দিলে তা তো দাঁতের সংস্পর্শে আসবেই। তাই নয় কি? আর ময়লা জমলে তো অনেককিছুই নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, আগের শক্তি ও সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। দাঁতও পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে নিজের শক্তি ও সৌন্দর্য হারায়। তাহলে দাঁতে ব্যথা কেন হয়ে থাকে তা অনুমান করতে পারছেন তো? হ্যা, খাবারদাবারের ধরণ ও যত্নের অভাবেই হয় দাঁতের ব্যথা।
প্রতিদিনের খাওয়া বিভিন্ন খাবারের উপাদানের অবশিষ্ট অংশ বা খাদ্যকণা মুখে আঁটকে থাকলে তা মুখের ভেতরে থাকা অজস্র ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। সেই ব্যাকটেরিয়া গুলো আঁটকে থাকা খাবারের জায়গায় আক্রমণ করে ও নিজেদের খাবার সংগ্রহ করে। এটা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না খাবার কোথায় আঁটকে। জানেনই দাঁতের ফাঁকে, কোণায় আঁটকে যায়। সব খাবারই আঁটকে না। মিষ্টির খাবার, কাই ( আঠালো) জাতীয় খাবার বেশি আঁটকে যায় দাঁতের বিভিন্ন অংশে।
দাঁতের ফাঁকে বা কোণায় জমে থাকা খাবার কিছুদিনের মধ্যে পচিয়ে ফেলে মুখে থাকা ব্যাকটেরিয়া গুলো। তা পচে গিয়ে "ল্যাকটিক এসিড" নামক এসিড উৎপন্ন করে। এর কারণে মুখে আস্তে আস্তে দাঁতের বিভিন্ন অংশ যেমন- এনামেল যেটাকে দাঁতের আবরণ বলা হয় সেটা, ডেন্টিন ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। পরে ক্যাভিটি, দাঁত শিরশিরে হওয়ার মতো সমস্যা হয়। পরে যা রুপ নেয় দাঁতের ব্যথায়। আয়রনের অভাব, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্সের অভাব, বাহ্যিক আঘাতে দাঁতের ক্ষয়ের কারণেও এটি হতে পারে।
পরবর্তীতে ঠাণ্ডা, মিষ্টি, ব্রাশ না করা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকের কারণে ব্যথা আরও তীব্রতর হয়ে যেতে পারে।
দাঁতের ব্যথায় কারা বেশি ভোগে?
আসলে নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই কারও দাঁতের ব্যথায় ভোগার। বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ যেকেউ ভুগতে পারে। দাঁতের যত্ন না নিলে, খাবারের নির্বাচনে যত্নশীল না হলে যেকেউই আক্রান্ত হয়।
দাঁতের ব্যথা সহজেই দূর করতে কী ব্যবস্থা নিতে হবে?
ব্যথা যাতে না হয় তার জন্য রয়েছে দু'টি ব্যবস্থা। প্রথমটি হলো দাঁতের পর্যাপ্ত যত্ন, দ্বিতীয়টি খাবারে সচেতন হওয়া। আর ব্যথা যদি হয়েই যায়, তখন তাড়াতাড়ি কীভাবে ব্যথা দূর করা যায় তার চিন্তা থাকে। চিন্তা করবেন না। সহজেই দাঁতের ব্যথা দূর করুন নিচে বলা ব্যবস্থাগুলোর সাহায্যে।
লবণ: লবণ ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করার অনেক কার্যকরী একটি বস্তু। দাঁতে যখন ব্যথা হবে তখন একটু লবণ দাঁতের ব্যথার জায়গায় লাগিয়ে দিন। অথবা হালকা গরম পানির সাথে লবণ গুলিয়ে সেই পানি দিয়ে কয়েকবার করে কুলি করলে ব্যথা থেকে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যায়। আবার লবণের সাথে লেবুররস, সরিষার তেল মিশিয়ে একসাথে করার পর দাঁতের ঐ জায়গাতে মাড়ির উপর মালিশ করুন। কয়েকমিনিট করার পর কুলি করে নিন।
লবণের সাথে গোল মরিচের পেস্ট বানিয়েও তা ব্যথার জায়গায় লাগান, পরে কুলি করে নিন। এই ব্যবস্থাগুলো ব্যথা কমে গেলেও কয়েকদিন চালিয়ে যান।
আদা: আদাতেও থাকে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান। ব্যথার সময় আদা একটু বড় করে কুচি কেটে চিবুতে থাকুন। চিবাতে ঝাল লাগতে পারে। না চাইলে আদা থেঁতলে নিন, তারপর থেঁতলে হওয়া ছোবড়াসহ রস ব্যথার জায়গার উপর কয়েক মিনিট চেপে ধরুন। আদা ৫ মিনিটেও ব্যথা কমিয়ে দিতে পারে।
রসুন: আদার মতো রসুনও একইরকম উপাদান। রসুনও ব্যবহার করতে পারেন আদার মতো করে। তবে রসুনের ছোবড়ার সাথে একটু লবণও নিলে বেশি ভালো হবে। ব্যথার অংশে রসুন চেপে ধরে রাখুন কয়েক মিনিট।
এলাচ বা লবঙ্গ: খুবই ভালো একটি বস্তু এটি ব্যথা দূর করার। ময়লা প্রতিরোধ করে এমন কিছু উপাদান রয়েছে এলাচের মধ্যে। ব্যথার অংশে একটি এলাচ মুখে নিন, কয়েক সেকেন্ড পরপর সেটা চিবান আর কয়েক সেকেন্ড সেখানে চাপ দিয়ে ধরুন। এলাচ চিবাতে না চাইলে এটার আলাদা তেল বের করে জলপাইয় তেলের সাথে করে একসাথে একটা তোলার বা পরিষ্কার কাপড়ের ছোট বল বানিয়ে এই বলের মধ্যে সেই তেলের মিশ্রণ দিন। তারপর বলটি ব্যথার অংশে লাগান। সরাসরি শুধু এলাচের তেল ব্যবহার করবেন না, এই তেলের সাথে জলপাইও দিতে হবে। কারণ, শুধু এলাচের তেল ব্যথা বাড়াতেও পারে।
ব্যাকিং পাউডার: আধা গ্লাস পানিতে এক চামচের মতো পরিমাণ ব্যাকিং পাউডাড গুলিয়ে সেটা দিয়ে কয়েকবার কুলকুচা করে ব্যথা লাঘব করা যায়।
পেয়ারার পাতা: গাছ থেকে কয়েকটা পাতা এনে ধুয়ে পরিষ্কার করে তারপর পেয়ারার পাতা কিছু সময় চিবান। আর চিবিয়ে ছোবড়াসহ রস ব্যথার অংশতে চাপ দিয়ে ধরে রাখেন কয়েক সেকেন্ড।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড: ব্যথা ও ফোলা কমাতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড খুবই কার্যকরী। সমপরিমাণ পানি ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মিশানোর পর তা দিয়ে কুলি করলে ব্যথা দূর হয়ে যাবে। এটি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে, ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত বন্ধ করতেও কাজ করে।
ঘাস: যদিও ঘাস সব জায়গায় পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও তা দূষণের মধ্যে থাকে। পরিষ্কার দূর্বাঘাসের সাহায্যে ব্যথা দূর করা সম্ভব ৫ মিনিটেই। একমুঠ দূর্বাঘাস ধুয়ে পরিষ্কার করে মুখে নিয়ে চিবাতে হবে কয়েক মিনিট। এটাও ছোবড়া আর রস আক্রান্ত স্থানে চেপেও রাখবেন কয়েক সেকেন্ড হলেও।
বরফ: কখনোই বরফ বা ঠাণ্ডা কিছু খাওয়া যাবে না দাঁতের ব্যথায়। বরফ কাপড়ে পেঁচিয়ে অথবা পকেট সিস্টেমে প্যাক করে সেটা মুখের যেপাশে ব্যথা হয়, সেপাশে চেপে রাখুন। বরফের এই ব্যবহারে ব্যথা ও মাড়ির ফোলাও কমবে।
মেডিসিন: এসপিরিনের মতো ব্যথা-নাশক সেবনেও দাঁতের ব্যথা কমানো যায়।
৫ মিনিটেই কীভাবে দাঁতের ব্যথা দূর করতে পারা যায়?
উপরে যেগুলো বলেছি এগুলো দিয়েই ব্যথা কমবে। আর যদি খুবই তাড়াতাড়ি ৫ মিনিটে ব্যথা মুক্তিরির উপায় চাইলে তাহলে দেখুন এটি,
প্রথমে লবণ আর হালকা গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করবেন, অথবা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড দিয়ে মুখ পরিষ্কার করবেন উপরে বলা বর্ণনানুয়ায়ী। অথবা দূর্বাঘাস চিবিয়ে নিবেন। এই তিনটির যেকোনো একটি করবেন। তারপর এলাচ নিয়ে চিবাবেন, নইলে আদার ছোবড়াসহ রস লাগিয়ে ধরে রাখবেন। এসময় বরফের ছেঁকাও নিতে পারলে আরও ভালো। এভাবে দেখবেন দ্রুতই ব্যথা বিদায় নিবে।
দাঁতের যত্ন নিতে যে কাজ করতে হবে
১. রুটি, চকলেট, ক্যান্ডি, অ্যালকোহল, ঠাণ্ডা খাবার, কোমলপানীয়, শুকনো ফল যেমন- খেজুর এগুলো খাওয়া যাবে না যদি দাঁতে সমস্যা থাকে। যদি খেয়েই ফেলে, তাহলে খাওয়াশেষে সাথেসাথে দাঁত পরিষ্কার করে নিতে হবে।
২. দিনে দুইবার, একবার সকালে আর একবার রাতে ব্রাশ করতে হবে। প্রাপ্তবয়সীদের জন্য ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেষ্ট ব্যবহার করলে ভালো।
৩. তামাক, ধুমপান বিরত রাখতে হবে।
৪. দাঁতের ফাঁকে কোনো কিছু আঁটকে গেলে সরু কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে তা বের করে ফেলা উচিত যতদ্রুত পারা যায়। কাঠি দিয়ে না চাইলে অন্য কোনো পদ্ধতি যেমন- সুতো দাঁতে পেঁচিয়ে, সাবধানের সাথে প্রয়োগ করে দাঁতের ফাঁক পরিষ্কার রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন মাড়িতে কোনো আঘাত বা গুঁতো না লাগে, রক্তপাত না হয়।
৫. প্রতিবছরই চেষ্টা করতে হবে অন্তত যেন দুইবার দাঁত চেক-আপে যাওয়া যায়, যাদের সমস্যা আছে।
যখন ডেন্টিস্ট এর কাছে যেতে হবে
অল্প থেকে মাঝারি পর্যায়ের ব্যথা হলে আগেই ডেন্টিস্টের কাছে না গিয়ে এখানে বলা পদ্ধতির প্রয়োগ করবেন। তারপরও ব্যথা না কমলে, ব্যথা আরও বাড়তে থাকলে তখন ডেন্টিস্টের কাছে যান। কারণ, দাঁত ভেঙে গিয়ে ব্যথা, অতিরিক্ত ক্যাভিটির কারণে ব্যথা, দাঁতের আবরণ নষ্ট হয়ে ব্যথা হলে তা ডেন্টিস্টই ভালোভাবে পরিচর্যা করতে পারবে।
সর্বশেষ কথা
দাঁত প্রতিটি মানুষের অমূল্য সম্পদ। সবারই উচিত দাঁতের পরিপূর্ণ যত্ন নেয়া। কেন হয় দাঁতের ব্যথা তা জানলে ব্যথা হওয়া থামানো যায়। দাঁতের ব্যথা সহজেই দূর করতে উপরি ব্যবস্থা গুলো নিয়ে ভালো থাকুন।