গাড়িতে চড়লে বমি হওয়ার সমস্যা বন্ধ করার জন্য
গাড়িতে চড়লে বমি হওয়ার সমস্যাটিতে অনেকেই পড়ে থাকে। এমনকি কেউ কেউ তো গাড়িতে করে কোথাও যাওয়ার কথা শুনলেই ভয় পেয়ে যায় বমি হবে ভেবে। বাস, সিএনজি, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, জাহাজ, লঞ্চ, বিমানের মতো বাহনগুলোয় চলাচল করলে এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু কেন হয় এই সমস্যা? গাড়িতে চড়লে বমি হওয়ার সমস্যা বন্ধ করার জন্য কী করতে হবে? এসবই দেখবেন এলেখায়।
হেড লাইন -
- গাড়িতে চড়লে বমি কেন হয়?
- গাড়িতে চড়লে বমি হওয়া কি খারাপ কিছু?
- গাড়িতে চড়লে বমি হওয়ার সমস্যা বন্ধ করার জন্য কী করতে হবে?
- করণীয়।
- শেষের কথা
গাড়িতে চড়লে বমি কেন হয়?
আমাদের দেহকে স্বাভাবিক ভারসাম্য অবস্থায় রাখতে ভূমিকা থাকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় গুলোর। দেহতে যা কিছু ঘটুক সবকিছুর সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায়। গাড়িতে বমি হওয়ার কারণের পেছনে মস্তিষ্ক, কান ও চোখ কাজ করে। এই তিনটির ভুল বোঝাবুঝিতে যে কারও গাড়িতে বমির ঘটনাটি হয়। সবার এমনটি হয় না। মাথাব্যথার, মাইগ্রেনের, বদ-হজমের, স্মোকিং ও ক্লান্তিজনিত সমস্যা যাদের থাকে গাড়িতে উঠার সময়, তাদেরই বমি হওয়ার সমস্যাটি হয় যখন গাড়ির গতি বাড়ে। গতি ও দেহের ভারসাম্যজনিত কারণে হওয়া এই সমস্যাকে তাই বলা হয় " মোশন-সিকনেস বা গতিজনিত অসুস্থতা "।
বমি হওয়ার পেছনে কারণ
গাড়ি বা কোনো যানবাহন বিশেষ করে যে বাহনগুলো দ্রুতগামী হয়, যানবাহনের গতি যখন বেশি হয় তখন আমাদের কানের মধ্যে থাকা একধরণের তরল নড়াচড়া শুরু করে। এবং তখন কান মস্তিষ্কে সিগনাল দেয় মানুষটি গতিতে আছে অর্থাৎ চলছে।
কিন্তু চোখ দেখে মানুষটি স্থির হয়ে বসে আছে গাড়ির সীটে, সেখানে অন্যান্য সীটের যাত্রীরাও স্থির হয়ে বসে আছে। তখন চোখ মস্তিষ্ককে জানায় মানুষটি গতিহীন বা শান্ত হয়ে বসে আছে। এই যে কান ও চোখ দুইজন দুইরকম সিগনাল মস্তিষ্ককে দিল, এই সিগনালের কারণে মস্তিষ্ক নিশ্চিত বোঝে উঠতে পারে না সে কী করবে। তখন মস্তিষ্কের ভারসাম্যে অস্বাভাবিকতা হয়ে যায়, ফলাফলস্বরূপ বমি হওয়া, বমিভাব সমস্যার শুরু হয়।
চার চাকার যানবাহনে বেশি গতির কারণে, পানিতে চলা বাহনে পানির ঢেউয়ের কারণে, ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতায় চলা বাহনে অক্সিজেন সংকটের কারণে কানের মধ্যাংশের তরল নড়াচড়া শুরু করায় দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ও মস্তিষ্ক ভুল সিগনালের কারণে ভুল ব্যবস্থা নেয়ায় বমি আসে। সবার বমি আসে না, বেশিরভাগের শুধু বমিবমি ভাব হয়।
গাড়িতে চড়লে বমি হওয়া কি খারাপ কিছু?
না, এটা খারাপ কিছু নয়। এটা দেহ ও মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীনতার কারণে হওয়া সাময়িক একটি সমস্যা মাত্র। গাড়ির গতি কমলে, গাড়ি থেকে নেমে পড়লে তখন এই সমস্যা থাকে না বললে চলে। তবে কারও ক্ষেত্রে বমি হওয়ার প্রভাব কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে, তখন সে ক্ষানিকটা দূর্বল থাকে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে যায়। এর জন্য ভয় পাবার কিছু নেই।
খারাপ কিছু হওয়া বলতে বমি বেশি হলে দেহে পানির ঘাটতি হয়ে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হবে। তখন বেশি করে পানি খেলেই পানিশূন্যতার দূর হবে। বমির পর মাথাঘোরানো থাকতে পারে, যার জন্য দাঁড়াতে কষ্ট হয়। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে তা ঠিক হয়ে যাবে। বেশি সমস্যা হলে ডাক্তাররের কাছে যেতে হবে।
গাড়িতে চড়লে বমি হওয়ার সমস্যা বন্ধ করার জন্য কী করতে হবে?
সাময়িক একটি অসুস্থতা এটি। গাড়ির স্পিড কমলে, নেমে গেলেই এটা আর থাকে না। দীর্ঘ ভ্রমণে যারা যায়, তাদের জন্য এটা একটা বিরাট সমস্যা-ই বলা যায়। কারণ এতে গাড়িতে শান্তিতে থাকা সম্ভব হয় না। কিন্তু সবাই তো চায়ই গাড়িতে করে শান্তিতে চলাচল করতে, তা-ই নয় কি?
গাড়িতে করে শান্তিতে কীভাবে যাওয়া যায়, গাড়িতে বমি হবার সমস্যা বন্ধ রাখা যায় তার কিছু কার্যকর ব্যবস্থা দেওয়া হলো:
শেষ পর্যন্ত দেখে যান, এখানের সবগুলো টোটকা-ই যদি জেনে নিন তাহলে তো আপনারই সুবিধা। কারণ, একটাতে কাজ না হলে অন্যটি কাজে লাগাবেন। দেখে নিন নতুন কোন ব্যবস্থাটি আপনি জানতে পারলেন,
সীটে বসা: বমি হবার সমস্যা যাদের আছে, তারা গাড়িতে উঠার সাথে সাথে সামনের দিকের সীট খুঁজুন। সামনের দিকের সীট বলতে প্রথম ৩-৪ সারির মধ্যে। সুবিধামতোই সীটে বসুন, চেষ্টা করুন জানালার পাশের সীটে বসার। যেদিকে গাড়ি যাচ্ছে সেদিকে মুখ করে বসুন, উল্টোদিকে বসবেন না। আগে থেকেই কেউ আপনার সারির জানালার সীটটি দখল করে রাখে, তাহলে যদি উচিত মনে করেন সেই যাত্রীকে বিনয়ের সাথে আপনার সমস্যার কথা বলুন ও জানালার সীটটি সে দিবে কিনা জিজ্ঞেস করুন। জানালার পাশের সীট পান আর না পান, বমি হবার ইতিহাস থাকলে নিচের ব্যবস্থাগুলো নিবেন। কারণ, যেহেতু গতির কারণে সমস্যাটি ঘটে।
বাইরে দৃষ্টি: গাড়িতে বসে গাড়ির মধ্যেই দৃষ্টি রাখবেন না। জানালা দিয়ে অথবা গাড়ির সামনের গ্লাসে তাকিয়ে সামনের বাইরে দৃষ্টি ফেলুন। বাইরের সবুজ প্রকৃতি, দোকানপাট, রাস্তায় চলাচলকারী মানুষজন ইত্যাদি দেখুন। তাতে চোখ আর কান দুইরকম সিগনাল দিবে না সহজে। কারণ, বাইরের গাড়ির বাইরের বস্তু গতিশীল হওয়ায় তখন চোখকও সিগনাল দিবে মানুষটি অর্থাৎ আপনি গতিতে আছেন। কানের দেওয়া সিগনালের মতো। অতএব, গাড়ির বাইরের দৃশ্যগুলো দেখুন। কিন্তু কারও আবার চলন্ত বস্তু দেখার ফলে বমিভাব বাড়তে পারে। তারচেয়ে ভালো হয় চোখ বোজে থাকা।
বই পড়া, মোবাইল ব্যবহার: গাড়িতে বসে যদি আপনি বই পড়েন বা মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে থাকেন, তখন চোখ আর কানের সিগনালে পার্থক্য হবে। এই কাজগুলো না করে বাইরে দৃষ্টি দেন।
চোখ বোজে থাকা: বাইরে দৃষ্টি দিয়ে সুবিধা না হলে, চোখ বোজে থাকুন। একটু আধো-ঘুম নিয়ে নিন৷ তখন ক্লান্তিভাব দূরীভূত হবে ও বমি আসা আটকাবে। চোখ বোজে কানে ইয়ারফোন গুঁজে অল্প সাউন্ডে গান শুনতে পারেন।
পানি, ড্রিংকস: যদি বাংলাদেশের বাসিন্দা হন, তাহলে নিশ্চয়ই জানেন বাংলাদেশের দূরগামী যানবাহনে কী হয়। কী হয়? হয় যে, গাড়ি এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আসলে তখন হকার, পানি, কোল্ড ড্রিংক বিক্রি করতে গাড়িতে দৌড়ে উঠে, এমনি গাড়ির বাইরেও দৌড়ে বিক্রি করে জানালা দিয়ে। আপনি সেই পানি কিংবা ড্রিংকস কিনে নিয়ে খান। অথবা বাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরপর বা বমিভাব জাগলে একটু পানি খান, নইলে ড্রিংকস নেন।
পানি ভেজালমুক্ত উপাদান। এটি দেহের ভারসাম্য রাখতেও কাজ করে। আর ড্রিংকসগুলোতে থাকে কার্বোনেটের উপাদান। যা পেটের গ্যাস, বদ-হজম কাটাতে দারুণ কাজ করে। পেটের গ্যাস আর বদ-হজমের কারণে যদি বমির সমস্যা হয়ে থাকে, তখন এই ড্রিংকসে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
টক, ঝাল খাবার: হকাররা পানি, ড্রিংকসের সাথে আবার বিভিন্ন টক ও ঝালজাতীয় খাবার নিয়ে উঠে বিক্রি করতে। শসা স্লাইস করে কেটে প্যাকেটে করে বিক্রি করে, তেঁতুলও বিক্রি করে, বড়ই, চালতার আচার, আর এগুলোর সাথে দেয় লবণ / বিটলবণ। এগুলো খেলেও পেটের অস্থিরতা, বদ-হজম কাটবে, ক্লান্তিভাব দূর হবে ও আরাম লাগবে।
আদা, এলাচি: যাত্রা শুরু করার পূর্বে বাড়ি থেকে কয়েক টুকরো আদা নিয়ে যান সাথে করে। অথবা এলাচি / লবঙ্গও নিতে পারেন। বদ-হজমের সমস্যা কাটাতে এগুলো ভালো। পেটে অস্বস্তি কমাবে, বদ-হজম কাটাবে ফলে পেটে শান্তি বিরাজ করবে। লেখক ও লেখকের পরিচিতরা আদা ব্যবহার করে শতভাগ উপকার পেয়েছে। অতএব, আদা পরীক্ষিত একটি পদ্ধতি বমি বন্ধ করার। এলাচিগুঁড়া পানিতে সিদ্ধ করে বোতলে করে নিয়ে নিতে পারবেন। যখনই বমিভাব হবে তখনই এলাচিগুঁড়ার পানি খাবেন।
লেবু, দারুচিনি, জিরা: লেবু টুকরা করে সাথে নিন গাড়িতে কোথাও যাওয়ার আগে। একটু লবণও নিবেন যাতে লেবুর সাথে লবণ লাগিয়ে খাওয়া যায়। এতে বমি বা বমিভাব কোনোটাই থাকবে না। বাড়ি থেকে পূর্ব পরিকল্পনা করে দারুচিনি অথবা জিরা গুঁড়া করে সাথে নিন। গাড়ির গতি বাড়ালে, বমিভাব জাগা শুরু করলে সেই গুঁড়া খেয়ে ফেলুন। বমিভাব কমবে ও বমি হওয়া বন্ধ হবে।
মুখের নড়াচড়া: লেখক চুইংগাম, সেন্টারফ্রুট চিবিয়েও উপকার পেয়েছে বলে জানিয়েছে। গাড়িতে চড়ার আগে, গাড়িতে চড়ার পরে চুইংগাম চাবানো শুরু করুন। চুইংগাম তাড়াতাড়িই ফেলে দিবেন না। কয়েক ঘণ্টা চাবানোর চেষ্টা করুন। নাহলে একটি চিবিয়ে ফেলে দিয়ে আরও চুইংগাম চিবান। গন্তব্যের কাছাকাছি যাওয়া পর্যন্ত চিবাতে থাকেন। মুখকে স্থির না রেখে মুখের নড়াচড়ায় মুখ, মস্তিষ্ক দুটোই কাজ করায় তখন বমিভাব জাগে না। চুইংগাম না চিবালেও, যদি আপনার সঙ্গে পরিচিত কোনো যাত্রী থাকে এবং পাশাপাশি সীটে বসেন৷ তাইলে দু'জন কথা বলার মাধ্যমেও বমি আসা বন্ধ রাখতে পারবেন।
পূর্বপ্রস্তুতি: যেদিন কোথাও দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন, তার আগের দিন ভালো করে ঘুমিয়ে নিবেন। ভারসাম্য স্বাভাবিক রাখতে এটি সহায়তা করবে। গাড়িতে চড়ার আগে পেট ভরে খাবেন না। হালকা খেয়ে গাড়িতে উঠার প্রস্তুতি নিবেন। ফার্মেসীতে বমি কমানোর ট্যাব পাওয়া যায়, ট্যাবলেট খেয়ে গাড়িতে চড়বেন। ট্যাবলেট নেওয়ার প্রয়োজন হবে না, যদি উপরের ব্যবস্থা গুলো মানেন।
বিরতি: বেশি দূরত্বের গন্তব্য হলে সচরাচর যানবাহন কিছু সময়ের জন্য বিরতি দিয়ে থাকে। সেই বিরতিতে গাড়ি থেকে নেমে বাইরের বাতাস উপভোগ করুন। হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলে ধুয়ে নিন। তারপর আবার গাড়িতে উঠুন।
করণীয়
- গাড়িতে বসে স্মোকিং করবেন না।
- তামাক যেমন- গুল, জর্দা, জর্দাপাতা মুখে নিবেন না। এগুলোর কারণে বমি আরও বাড়ে।
- জ্বর, উদরাময়রোগ, মাথা ব্যথা নিয়ে গাড়িতে করে কোথাও না যাওয়াই শ্রেয়।
শেষের কথা
গাড়িতে চড়লে বমি হওয়াটা অনেকেরই হয়। এটা নিয়ে ভয় পেয়ে থাকার বা চলাচল বাদ দেওয়ার কিছু নেই। যে ব্যবস্থাগুলো বলা হলো, এগুলো মানার মাধ্যমেই বমি হবার সমস্যাটি বন্ধ করা যায়।