কোন বয়সে বিয়ে করা উচিত? বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের কোন গুণগুলো থাকা দরকার?
বিয়ে করা প্রতিটি নরনারীর অন্যতম একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিয়ে করার সঠিক বয়স, কোন বয়সে বিয়ে করা উচিত তার চিন্তায় থাকে অনেকেই। চিন্তার কারণও আছে। বিয়ে মানে একজন মানুষের সাথে সারাজীবনের বন্ধন। তাই সারাজীবন ভালোভাবে, সুখে-শান্তিতে থাকতে হলে নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। বিয়ে করতে চাচ্ছেন? কিন্তু এটা কি জানেন কোন বয়সে বিয়ে করা উচিত? বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের কোন গুণগুলো থাকা দরকার? জেনে নিন এ বিষয়।
বিয়ে করা
আমি শুরুতেই বলেছি বিয়ে করা একটি মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য যা প্রতিটি নরনারীর জন্য। বিয়ে একটি সম্পর্কের সামাজিক ও ধার্মিক বৈধ স্বীকৃতি। বিয়ের মানে হলো দুইজন বিপরীত লিঙ্গের তথা একজন পুরুষ ও একজন নারীর সম্মতির ভিত্তিতে হওয়া আত্মিক বন্ধন যা একটি পবিত্র সম্পর্ক। দু'জন মানুষ সারাজীবনের জন্য একজন আরেকজনের সম্পত্তি ও অধিকার হয়ে যায়। বোঝাপড়া, ভালোবাসা, পরিশ্রম, সমর্থন, ত্যাগ, অধিকার, সবকিছুই দু'জনের উপর এক মহান দায়িত্বে বর্তায়।
সম্পর্ক ভালো না চললে বিচ্ছেদ, ডিভোর্সের মতো ঘটনা ঘটে। বর্তমান যুগে ডিভোর্স হওয়ার হার ক্রমশই বাড়ছে। সঠিক বয়সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলো বড় একটি কারণ। তাই সঠিক বয়সে কিছু গুণাবলি নিজের মধ্যে রেখে তবেই বিয়ে করা উচিত।
আপনি মুসলিম অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের হলে, আপনার জানা উচিত কখন আপনার জন্য বিয়ে ফরজ।
কখন বিয়ে করা ফরজ
বিয়ে করা হলে একটি সুন্নাত রীতি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ে করা ফরজ, ওয়াজিব, মুস্তাহাব বলেও বিবেচিত হয়।
যখন জিনা, ব্যভিচার, যৌন চাহিদা ও চরিত্র দোষে গুনাহ করার অবস্থা দেখা দিবে তখন নিজের চরিত্র রক্ষা করতে এবং পবিত্র থাকতে বিয়ে করে নেওয়া ফরজ অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। কারণ, ইসলাম ধর্ম বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, যৌনতা সমর্থন করে না।
যার নিজের এবং সঙ্গীর সাথে চলার মতো ভরণপোষণের পর্যাপ্ত সামর্থ্য ও সম্পদ রয়েছে, তার জন্যও বিয়ে করা ফরজ। এতে চরিত্র হিফাজত রাখা যাবে।
বিয়ের বয়সে পার্থক্য
বিভিন্ন ধর্মমতে বিয়ে করা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত বা আদেশ নিষেধ প্রচলিত। কিন্তু সকল ধর্মেই বিবাহ একটি বৈধ ও পবিত্র সম্পর্ক বলেই স্বীকৃত। প্রায় সকল ধর্মেই ছেলে-মেয়ের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হলেই বিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে।
ইসলাম ধর্মে এই বিধানটি সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। তবে বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের মতামতের ব্যাপারেও ইসলামে বলা আছে। যখনই বিয়ের উপযুক্ত মনে হবে তখনই বিয়ে করতে বলা হয়েছে ইসলাম ধর্মে। অন্যান্য ধর্মেও এই বিধান অনেকটা লক্ষ্য করা যায়।
প্রাচীনকালে মেয়েদের পিরিয়ড তথা ঋতুস্রাব শুরু হলেই বিয়ে দেওয়া হতো, আর ছেলেদের মাঝে দাঁড়ি গোঁফ এর রেখা হওয়া ও গোপনাঙ্গের চুল হওয়াকে বিয়ের উপযুক্ত বলে মানা হতো।
এ হিসেবে বিয়ের বয়স হতো ১০-১৮ বছরের মধ্যে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ, আইন ও ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিয়ের বয়স নিয়ে পার্থক্য রয়েছে। প্রায় সব দেশেই মেয়েদের বিয়ের আদর্শ বয়স ধরা হয় ১৬ বছর, আর ছেলেদের ধরা হয় ১৮ বছর। বাংলাদেশের আইনে মেয়েদের বিবাহ উপযুক্ত বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর, এবং ছেলেদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ বছর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্যই ২১ বছর বয়সকে নির্ধারণ করা হয়েছে সম্প্রতি।
এগুলো হলো ধর্ম, রীতি, দেশ, আইন অনুযায়ী ছেলেমেয়েদের বিবাহ যোগ্য বয়স। এবার আসি সঠিক বয়সের আলোচনায়।
বিয়ে করার সঠিক বয়স
বিয়ে শারীরিক ও মানসিক বিষয়ক। শারীরিক ও আর্থিক উপযুক্ততার পাশাপাশি মানসিক দিকটাও তাই বিয়ে করতে দরকার। কারণ সকল সিদ্ধান্ত তো মানসিক থেকেই নেওয়া হয়।
ধর্ম, দেশ, আইন একটা বয়সকে নির্ধারিত করে দিয়েছে যে সেটা হলো বিবাহ উপযুক্ত বয়স। কিন্তু কোন বয়সে বিয়ে করা কেমন প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে মানুষের মনোবিজ্ঞান অর্থাৎ সাইকোলজি বিস্তারিত বলে থাকে। সাইকোলজির মতেও বলা হয় যখন বিয়ের উপযুক্ত মনে হবে তখনই বিয়ে করতে। কিন্তু কিছু বাস্তব ও মানসিক কন্ডিশন বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সাইকোলজি বেশি জোর দেয়।
সাইকোলজি অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধিতে অর্থাৎ ২০ বছরের আগে বিয়ে করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কেননা এ বয়সে মানুষের আবেগ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিলে তা উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ার ঘটনাই বেশি।
যারা ২০ এর আগে বিয়ে করে তারা মানসিকভাবে একজন আরেকজনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। এজন্য সংসারে ভুল বোঝাবুঝি ও তিক্ততার সৃষ্টি হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, আর্থিক নিশ্চয়তা শক্ত না থাকা, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হওয়া হলো এই বয়সে বিয়ে করার ক্ষতিকর দিক। এসব কারণে তাই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বিয়ের সম্পর্ক বেশিদিন টিকিয়ে রাখা কঠিন। যারা এই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারতে সক্ষম, তারাই অল্প বয়সে বিয়ে করেও সুখে-শান্তিতে থাকে।
আবার যদি মাঝ বয়স বা শেষ বয়সের দিকে বিয়ে করে, তখন সেটা শুধু বিয়ে আর সংসারের দায়িত্ব পালন করতেই ব্যস্ত থাকতে হয়। দু'জন দু'জনকে বোঝা, সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। তখন সংসারের ভার বয়েই কাটাতে হয়, ভালোবাসার সুযোগ ও সময় পাওয়া যায় না বললেই চলে, দু'জনের বিভিন্ন চাহিদা মেটানোও সম্ভব হয় না। এমন বিয়েকে তাহলে কী বলবেন? নামমাত্র বিয়ে আর দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা বলা হবে সেটাকে।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩৫ এর পর হওয়া বিয়েতে ডিভোর্স হওয়ার হার বাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। আর সবচেয়ে বেশি ডিভোর্স লক্ষ্য করা গিয়েছে অল্প বয়সে হওয়া বিয়েতে।
তাহলে কখন বিয়ে করবেন?
বিয়ে করুন তখনই যখন আপনার মধ্যে সঙ্গীকে বোঝা, ভালোবাসা, সময় দেওয়া, আর্থিক সামর্থ্য, আবেগ নিয়ন্ত্রণ রাখার মতো বিষয়গুলো থাকবে। এই বিষয়গুলো পাওয়া যায় ২০ বছর থেকে ৩৫ বছরের মাঝামাঝি। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এটাই কি বিয়ের সঠিক বয়স?
হ্যাঁ, এটাই বিয়ের সঠিক বয়স। সাইকোলজি এই বয়স টাকেই বিবাহ উপযুক্ত বয়স হিসেবে মতামত দেয়। তবে ২৫ থেকে ৩২ বছরের মাঝামাঝি সময়কে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হিসেবে বলা হয়। কারণ, এই বয়সে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামর্থ্যবান হয়ে যায় বেশির ভাগ মানুষ। আর এই বয়সে চাকরি, ব্যবসা কিছু না কিছু করে আর্থিক দিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় মানুষ।
সঠিক বয়সে বিয়ে করার সুবিধা
গবেষণা বলে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে হওয়া বিয়ে মজবুত হয় বেশি, স্থায়ীও হয় অনেক।
অন্য একটি গবেষণা বলেছে, ২৫ বছর বয়সের আশেপাশে সময়ে বিয় করলে পুরুষদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়। এই বয়সে বিয়ে করলে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সকল চাহিদা সঠিকভাবে পালন করা ও বজায় রাখা যায়।
বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের কোন গুণগুলো থাকা দরকার?
ইসলাম ধর্ম চারিত্রিক পবিত্রতা ও ধার্মিক হওয়াকে বিয়ের জন্য ছেলে ও মেয়ের গুণ হিসেবে বলেছে।
আসলেও ঠিক তাই। সঠিক সঙ্গী না হলে সঠিক বয়সে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে থাকা কঠিন। আপনি সঠিক বয়সে বিয়ে করবেন, ভালো কথা। আপবার সঙ্গী যদি সঠিক এবং উপযুক্ত না হয়, তাহলে সেই সঙ্গী নিয়ে থাকতে পারবেন?
সঙ্গী নির্বাচনে এই ভুলটাই করে থাকে অনেকে, যার জন্য সংসারে অশান্তি ও বিচ্ছেদ হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। বিয়ে করলে শুধু সঠিক বয়স আর সামর্থ্য দেখেই নয়, মানুষটার চরিত্র ও ধার্মিক দিকও দেখা উচিত। সঙ্গীকে ভালোবাসবে, মান্য করবে, সম্মান করবে, সংসার সামলাবে, বোঝাপড়া ভালো হবে এমন সঙ্গীই তো সবাই চায়।
শেষ কথা
বিয়ে করার সঠিক বয়স নিয়ে চিন্তা না করে নিজেকে কখন বিবাহ উপযুক্ত ও সামর্থ্যবান মনে হবে তখনই বিয়ে করে নেওয়া উচিত। বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের গুণগুলো দেখে সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।