ব্রেইনের ক্ষতি করছেন জেনেশুনে যে ৮ টি কারণে (Brain Damage)

ব্রেইনের ক্ষতি


ব্রেইন মানবদেহে চালকের কাজ করে। শুধু মানবদেহ-ই নয়, প্রতিটি প্রাণীদেহেরই চালক হলো ব্রেইন। ব্রেইন ছাড়া প্রাণীদেহ চলতে অক্ষম। সারাদেহের সমস্ত সিগন্যাল, নির্দেশনা গ্রহণ করে তা প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রদান করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চলাচল, নড়াচড়া, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইন অর্থাৎ মস্তিষ্ক। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অমূল্য নিয়ামতের/ উপহারের ক্ষতি ডেকে আনে সৃষ্টির সেরা জীব  মানুষ নিজেরাই। কীভাবে ব্রেইনের ক্ষতি করছেন জেনেশুনে বা অজান্তে, তা জানেন কি? 


ব্রেইন বা মস্তিষ্ক 

অসংখ্য নিউরন, স্নায়ুকোষ, স্নায়ুর সমাহারে গঠিত। কথা বলা ও শোনা, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেওয়া, পড়তে পারা, দেহের কোথার ব্যথার অনুভূতি, অঙ্গের নড়াচড়া, কোনো কাজে অঙ্গকে পরিচালনা করা, আবেগ, অনুভূতি, অভ্যাস, অভিজ্ঞতা, এরকম গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ব্রেইনের। ব্রেইনের কোনো ফাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই কাজগুলো সঠিকভাবে করা যায় না। ব্রেইনের ক্ষতি মানে ব্রেইনের কোনো স্নায়ুকোষের ক্ষতি। 

অন্যান্য প্রাণীরা অবুঝ হলেও জেনেশুনে বা অজান্তে কখনও নিজের ক্ষতি ডেকে আনে না। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ জেনেশুনে এবং অজান্তে নিজের ও অন্যের ক্ষতি করে বিভিন্নভাবে।

মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা, আঘাত, অসুস্থতা, নিত্যকার জীবনচর্চার কিছু কাজের জন্য মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

ব্রেইন ড্যামেজ ( ব্রেইনের ক্ষতি) 

মানবশিশু জন্মের আগে মায়ের গর্ভাশয়ে থাকা অবস্থায়ও ব্রেইনের ক্ষতির শিকার হতে পারে। তার জন্য দায়ী পরিবার ও পরিবেশ। আর জন্মের  পর মানুষ দুই ধরণের ব্রেইন ড্যামেজ বা ব্রেইনের ক্ষতির শিকার হয়। আঘাতজনিত ও অসুস্থতাজনিত - এই দু-ভাগে ব্রেইনের ক্ষতিকে ভাগ করা হয়। এই কারণগুলোতে ব্রেইন ড্যামেজ হওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানুষ নিজেরাই বেশিরভাগ দায়ী।

আঘাতজনিত যেসব কারণে ব্রেইনের ক্ষতি হয় সেটাকে "ট্রমাটিক ব্রেইন ড্যামেজ " বলা হয়। এমনটা হয় কোনো বড় ধরণের শারীরিক আঘাত, পক্ষাঘাতজনিত কারণে। যেমন- মাথায় আঘাত, উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়া, গাড়ি দূর্ঘটনা, শারীরিকভাবে হেনস্তা, ভয়, আবেগ, শিশুকে উপরে ছুঁড়ে দোল খাওয়ানো ও অতিরিক্ত দোলানো। এসব কারণে যে-কেউই এই ড্যামেজের শিকার হতে পারে। 

আর অসুস্থতাজনিত যেসব কারণে ব্রেইনের ক্ষতি হয় সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- খাদ্যের বিষক্রিয়া, বিষাক্ত বস্তু শরীরে গ্রহণ করা, মাথায় কোনো ইনফেকশন, টিউমার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, স্নায়ুজনিত অসুস্থতা। 

খেয়াল করলে দেখবেন যেসব কারণে ব্রেইনের ক্ষতি হয়, সেসবে মানুষই কোনো না কোনোভাবে জড়িত।

কীভাবে ব্রেইনের ক্ষতি করছেন জেনেশুনে যে ৮ টি কারণে?

এখানে এমন সব কারণগুলো বলবো যেগুলো খুবই কমন ও সবার সাথে পরিচিত কিছু কাজ যা সবাই প্রতিদিন কমবেশি করে থাকে। সেক্ষেত্রে বলা যায় না জেনে ক্ষতি করার তুলনায় জেনেশুনেই ব্রেইনের ক্ষতি করছে মানুষ। 

যে ৮ টি কারণে ব্রেইনের ক্ষতি করছেন :

১. খাবার

প্রথম কারণটি খাবার দিয়েই শুরু করি। অনেকের খিদে সহ্য হয় না, খিদে পেলেও আর না পেলেও গলা পর্যন্ত ভরে খাবার খায়। এটা খুবই বাজে একটি অভ্যাস ও খারাপ স্বভাব। খাবারের মধ্যে সংযত হতে হবে। বেশি বেশি খাওয়ার কারণে ব্রেইনে চাপের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। আর চাপের সৃষ্টি হলে স্নায়ু আঘাতপ্রাপ্ত হয়। যা ব্রেইন ড্যামেজ করে দিতে পারে। অতিমাত্রায় লবণ, চিনি, মিষ্টি যেমন হার্ট, কিডনির ক্ষতি করে, তেমনই এগুলো ব্রেইনেরও ক্ষতি করে।
 
টুনা নামে সামুদ্রিক এক প্রজাতির মাছ আছে যা বেশিমাত্রায় খেলে ব্রেইন ফাংশনের এক্টিভিটি কমে যায়, কেননা টুনামাছে থাকে মার্কারি বা পারদ নামক বিষাক্ত উপাদান। প্রক্রিয়াজাতকরণ কিছু খাদ্য যেমন সয়া, টফু, সস, চিপস, রেডিমেড কেক, এগুলো ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর। অতি তৈলাক্ত, চিনিযুক্ত, সোডিয়ামে তৈরি খাদ্যগুলো এড়িয়ে চললে কিংবা সীমিত মাত্রায় খেলে তা ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর হবে না।

২. বিষাক্ততা গ্রহণ

বিষাক্ততা বিভিন্ন পন্থায় গ্রহণ করা যায়। আধুনিক বিশ্বে তো আরও কিছু আধুনিক পন্থা বের হয়েছে বিষাক্ত বস্তু আর পদার্থ গ্রহণের। বিষাক্ততা গ্রহণ হতে পারে খাদ্যের, নেশাদ্রব্যের, ধুমপানের , মেডিসিনের মাধ্যমে। পঁচা বাসি ও কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য খাওয়া, নেশাদ্রব্য সেবন, নিকোটিন মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। আপনি ধুমপান করছেন, তাতে আপনার ক্ষতি তো হচ্ছেই, সাথে আপনার আশেপাশে থাকা প্রাণীদেরও ক্ষতি করছেন। 
নেশাদ্রব্যগুলো মেমোরি লস, বৃক্ক ও যকৃতের সমস্যা সৃষ্টি করে। বিষাক্ততা গ্রহণ করা থেকে সচেতন থাকুন।

৩. অলসতা 

মস্তিষ্ক অলসতা পছন্দ করে না। অলসতার জন্য মস্তিষ্ক কর্মক্ষম হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক কর্মক্ষম হলে মানবদেহও কর্মক্ষম হয়ে যায়। ব্রেইনকে সচল রাখতে হলে নিজেকেও সচল রাখতে হবে। সারাদিন শুয়েবসে না থেকে হাঁটাচলা করতে হবে। অল্পসময়ের জন্য হলেও হালকা এক্সারসাইজ / ব্যায়াম করা উচিত সবার।

৪. ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার 

বর্তমানে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমে যাচ্ছে দিনদিন। মানুষ ঘরকোণো, অলস হয়ে সময় কাটাচ্ছে। সময় কাটানোর প্রধান ও সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যবহৃত মাধ্যম হলো বিভিন্ন ডিজিটাল ও ইলেক্ট্রনিকস ডিভাইস। টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল, ভিডিও গেইমে আসক্ততা বাড়ছে মানুষের। এসব ডিভাইস থেকে ক্ষতিকারক নীল আলো নির্গত হয় যা চোখের মাধ্যমে গিয়ে ব্রেইনে আঘাত করে ও ব্রেইনের ক্ষতি করে। এতে চোখ ও ব্রেইন উভয়েরই ড্যামেজ হয়, এসব হলো চোখ এবং ব্রেইনের শত্রু। এসব ব্যবহার ও চালনায় সাবধান থাকতে হবে। 

৫. অন্ধকারে থাকা

ব্রেইন খোলামেলা, আলো-বাতাস, বিশুদ্ধ পরিবেশ পছন্দ করে। এমন পরিবেশে ব্রেইনের এক্টিভিটি ভালো হয়। বর্তমানকালের মানুষেরা কিছুসংখ্যক আছে যারা অন্ধকার পছন্দ করে, ডার্ক লাভার। অল্পসময় অন্ধকারে কাটালে ক্ষতি নেই, কিন্তু যদি ক্রমাগত বেশি বেশি সময় অন্ধকারে কাটানো হয় তাহলে তা ব্রেইনের জন্য ভালো হয় না। অন্ধকারে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার চোখ ও ব্রেইনের শত্রু। অনেকসময় ধরে অন্ধকারে থাকা কমাতে হবে ব্রেইনের ভালো চাইলে। বাইরে সময় কাটান প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে হলেও।

৬. নেতিবাচকতা, বিষণ্ণতা 

ডিপ্রেশনে ভোগার মানুষের অভাব নাই আজকাল। অল্পতে ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া, বিষণ্ণতায় ভোগার মানুষ অনেক আছে। এতে যেমন মনের ওপর চাপ পড়ে, তেমনই ব্রেইনের জন্যও চাপের। ব্রেইন যদি ঘনঘন চাপের মধ্যে দিয়েই থাকে, তাহলে স্নায়ুকোষের ক্ষতি হতে থাকে যা পরবর্তীতে ব্রেইন ড্যামেজ করে দেয়। 

বেশিরভাগ সময়ই যদি কারও নেতিবাচক ও দুঃখের খবরের মধ্যে থাকতে হয়, তাহলে সেটাও বিষণ্ণতার মতো চাপের মধ্যে রাখে ব্রেইনকে। ব্রেইন উৎফুল্ল থাকতে পছন্দ করে। বেশি বেশি দুঃখের খবর, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ব্রেইনের উৎফুল্লতাকে গ্রাস করে। ব্রেইন ভালো রাখার জন্য মনকে ভালো রাখতে ও বিষণ্ণতাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

৭. উচ্চ শব্দ / হাই ভলিউম 

কোনো অনুষ্ঠানে, পার্টিতে কতরকম হৈ-হুল্লোড়, কুচকাওয়াজ, উচ্চ শব্দে গান বাজানো, ইয়ারফোন হেডফোন গুঁজে গান শোনা যেন এখন নিত্যতার সাথে মিশে গেছে আধুনিক মানুষের। উচ্চ শব্দ কানের জন্য মারাত্মক, আর তা কানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে মস্তিস্কেও প্রভাব ফেলে। এই উচ্চ শব্দের কাজগুলো ব্রেইনের কোষকে ড্যামেজ করে তুলে। কান ও ব্রেইন ভালো রাখতে এসব করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইয়ারফোন ব্যবহারের প্রয়োজন হলেও তা চেষ্টা করতে হবে যেন ভলিউম হাই না হয়। বলা হয় ইয়ারফোনে ভলিউম ১০ এর মধ্যে রাখতে। এটা করবেন যদি খুবকরে ইয়ারফোন হেডফোন ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।

৮. অসম্পূর্ণ ঘুম, অনেক রাত জাগা 

সুস্থ থাকার জন্য ঘুম খুবই দরকারী। ঘুমের কারণে ব্রেইন বিশ্রাম নেয় ও পরিপূর্ণ এক্টিভিটি ( কার্যক্ষমতা) লাভ করে। কিন্তু দিনদিন যদি ঘুম অসম্পূর্ণ হতে থাকে, পর্যাপ্ত না হয় তাহলে ব্রেইন বিশ্রাম নিতে পারে না ঠিকমতো। যার কারণে ব্রেইনের কার্যক্ষমতাও সম্পূর্ণরুপে হয় না। 

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকাও ব্রেইন ও চোখের জন্য খারাপ। ব্রেইন, চোখ এসব অতি গুরুত্ব পূর্ণ অঙ্গের বিশ্রামের দরকার আছে। তাই বেশি বেশি রাত না জেগে পরিপূর্ণ ঘুমান, অন্ততপক্ষে ৬ ঘণ্টা।

ব্রেইনের ক্ষতি হলে যে সমস্যা গুলো হয়

অতি-গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গ, ইন্দ্রিয় ব্রেইনের সাথে সংযুক্ত। ব্রেইন ড্যামেজ হলে সেসব অঙ্গ, ইন্দ্রিয়গুলোও ড্যামেজ হতে থাকে। সেই ড্যামেজের প্রভাব দেখা যায় অঙ্গ ইন্দ্রিয়গুলোতে, চিন্তাভাবনায়, আবেগে, চলাফেরায়। 

  • ব্রেইনের এক্টিভিটি দূর্বল হওয়া
  • দেহের কোথাও কোনো অনুভূতির প্রতি সাড়া না দেওয়া
  • দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, বাকশক্তির দূর্বলতা 
  • মনোযোগের ঘাটতি, চিন্তা করতে না পারা
  • মেমোরি লস, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া 
  • স্পর্শ ও ঘ্রাণে অনুভূতি হ্রাস
  • ক্রমাগত মাথাব্যথা
  • দেহের কোনো এক অঙ্গ অথবা কোনো একপাশ অবশ, অচল হয়ে পড়া (প্যারালাইসিস) 
  • বিবেক-মানসিকতা, অভ্যাসে পরিবর্তন

ব্রেইনের ক্ষতি হলে  এইসব সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।

উপসংহার 

জেনেশুনে কি নিজের ক্ষতি চাইবেন?  যদি না চান তাহলে ব্রেইনের ক্ষতি করে এমন কারণগুলো ও কাজগুলো ব্যাপারে সচেতন ও সাবধান হয়ে যান। তাতে আপনিও ভালো থাকবেন, অন্যরাও ভালো থাকবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url