কোমর ব্যথার মূল কারণ ও করণীয় (ঘরোয়া পদ্ধতি)

কোমর ব্যথার মূল কারণ ও করণীয়


বয়স বাড়তে থাকার সাথে সাথে মানুষকে বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক ধকলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কোমর ব্যথা হলো তেমন এক ধকল। কোমর ব্যথার মূল কারণ ও করণীয় বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় এর নিরাময়েও সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না অনেকসময়। তাই আগে জানতে হবে এ ব্যথার কারণ কী এবং এ থেকে নিরাময় পেতে কী কী করতে হবে, তারপরই উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে ব্যথামুক্ত থাকা যাবে।


কোমর ব্যথার মুল কারণ 

কোমর ব্যথা হয় সাধারণ কোমরের যেকোনো এক পাশে, এমনকি উভয় পাশ কিংবা চারপাশেও হতে পারে। ব্যথা কোমর থেকে ছড়িয়ে পিঠে এবং পায়েও যায়। কোমরে ব্যথা নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম, হাঁটাচলা, ওঠা বসা, শুয়ে থাকার মতো কাজগুলোতে কষ্ট হয়। অসহ্যকর এ ব্যথা কমাতে তাই ব্যথানাশক খেয়ে থাকে অনেকে।

কোমর ব্যথা কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। একপ্রকার ব্যথা আছে যা হঠাৎ করে শুরু হয়ে সাময়িক সময় স্থায়ী হয়, আরেক প্রকার আছে মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে এবং দীর্ঘসময় ভোগায়।

ব্যথা হবার বেশ কয়েকটি কারণ থাকে। এমনি এমনি ব্যথা হওয়ার ঘটনা তেমন দেখা যায় না। যে কারণগুলোর জন্য কোমরে ব্যথা হয়ে থাকে :

হাড়ের ক্ষয় : মানুষের কোমরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫ টি হাড় থাকে। কোনো কারণে যেমন, ক্যালসিয়ামের অভাব, বয়স, জিনগত কারণে সেই হাড়গুলোর কোনোটা ক্ষয় হয়ে গেলে লক্ষণস্বরূপ কোমরে ব্যথা হয়।

আর্থ্রাইটিস : এটি হলো একাধিক হাড়ের সংযুক্ত স্থলের নাজুক ও ফোলা অবস্থা, সংযুক্ত স্থল নরম, ভঙ্গুর হয়ে ফুলে যায়। এই অবস্থাকে আর্থ্রাইটিস বলে। কোমরের হাড়েও যদি এরকম হয়ে তাহলে তখন তা ব্যথা হওয়ার কারণ। 

কোমরে আঘাত : কোনো দূর্ঘটনার কারণে কোমরের জয়েন্ট বা আশেপাশের হাড় ভেঙে গেলে ব্যথা তো হবেই সেটা না বললেও চলে।

অস্টিওপরোসিস : "হাড়ভাঙা রোগ"ও বলা হয় এটাকে। নিরবে কোনো আগাম সংকেত ছাড়াই এই রোগ হাড়ে বাসা বাঁধে, এবং আস্তে আস্তে হাড়গুলোকে দূর্বল করতে করতে এমন দূর্বল করে দেয় যে হাড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। অস্টিওপরোসিস হওয়ার পর আস্তে আস্তে এর সংকেত হিসেবে ব্যথা হতে শুরু করে।

হাড়ের উপর অত্যাচার : ঠিকভাবে না বসা, হাড়ে মোচড় ফেলা, মেরুদণ্ড অত্যধিক বাঁকিয়ে রাখা, অধিক ভারী বস্তু মাথা ও কোমরে বহন করা এই কাজগুলো কোমর ও মেরুদণ্ডের হাড়ের উপর অত্যাচার স্বরূপ। এসব অত্যাচারে একসময় হাড় স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে ও হাড়ের কাঠামোয় পরিবর্তন হয়। সে কারণেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। 

ক্যান্সার : দেহের কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয় এই রোগ। কোমরের হাড়েও অনেক কোষ ও স্নায়ু রয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত হলে সেই কোষ ও স্নায়ুগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তখন হাড় দূর্বল হয়ে যায় ও ফলস্বরূপ ব্যথা হয়। 

মেডিসিন : স্টেরয়েডযুক্ত মেডিসিন দীর্ঘদিন ধরে সেবনে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ব্যথানাশক বেশিরভাগ মেডিসিনই স্টেরয়েডযুক্ত। এসব মেডিসিন সাময়িক ব্যথা মুক্ত করে স্বস্তি দিলেও অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে। কিডনির সমস্যা, হাড় ক্ষয় হলো এই শ্রেণির মেডিসিনের ক্ষতিকর প্রভাব।

হাড়ের কোনো ইনফেকশন : হাড়ে যদি কোনো সংক্রমণ হয় তাহলে সেটার কারণেও ব্যথা হতে পারে। হাড়ের ইনফেকশন হলে হাড়ের সংযুক্ত স্থল ফুলে যাওয়া, দূর্বল হাড়, ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে।

এগুলোই মূলত কোমর ব্যথার উপযুক্ত কারণ। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো - কিডনির সমস্যা হলে কোমর ব্যথা হয় এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কারণ, কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি হলে শুধু কোমরের ব্যথাই হয় না, আরও লক্ষণ থাকে। তাই কোমর ব্যথাকে কিডনির সমস্যার সাথে পুরোপুরি মিলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।

কেন কোমরে ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে তা ডাক্তারি পরীক্ষা করেই জানা যাবে।

কারা কোমর ব্যথায় শিকার হয়?

নির্দিষ্ট কোনো বয়স বলা যায় না। প্রতিটি মানুষের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা আলাদা। কখন কার মধ্যে কোন সমস্যা ও রোগ হয় তা কেউই অগ্রিম বলতে পারবে না। কোমরে ব্যথায় ভুক্তভোগীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় ৩০ বছরের পর হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ৪০ বছরের উর্ধ্বে গেলে কোমরের ব্যথা সহ হাড়ের অন্যান্য সমস্যার ঘটনা বেশি ঘটে।

শেষ বয়সীরা সহজেই হাড়ের রোগে শিকার হয়। কারণ সে বয়সে প্রতিরোধ ব্যবস্থা, হরমোন নিঃসরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কমে যায়।

লক্ষণসমূহ

এ সমস্যার লক্ষণ সব কোমরকে ঘিরেই বেশি হয়। কিছু মূল লক্ষণ হলো :
  • নামাজ পড়তে কষ্ট। বিশেষ করে রূকু সিজদাহ্ করার সময়।
  • কোমর নড়াচড়া করলে ব্যথা বাড়া।
  • ব্যথা বাড়তে বাড়তে কোমরের উপরের অংশে, নিতম্বে, উরু ও পায়ের দিকে ছড়িয়ে পড়া।
  • হাঁটতে কষ্ট হওয়া।
  • কোমর ও পায়ের পেশিতে চোট লাগা।

কোমর ব্যথা হলে করণীয় (ঘরোয়া পদ্ধতি) 

প্রথমে নিজে ব্যথার ধরণ ও স্থায়িত্বকাল পর্যবেক্ষণ করে নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ, পরে তা চিকিৎসা পেতে ও ব্যথা নিরাময় করতে সুবিধা হবে।

ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যথা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ঘরোয়া পদ্ধতি যেগুলো প্রয়োগ করলে আরাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো :

  • কোমরে ব্যথার ঘটনা থাকলে যতসম্ভব কোমর, মেরুদণ্ডের হাড়কে বিশ্রাম দিতে হবে। কোমর ও মেরুদণ্ড বাঁকানো, উপুড় হয়ে কাজকর্ম করা, ভারী কিছু বহন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • যে পাশে ব্যথা হয় সেই পাশে ভর দিয়ে বা সে পাশে কাত হয়ে শোয়া থেকে বিরত থাকুন। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে ব্যথা কম অনুভূত হয়।
  • ব্যথার জায়গায় বরফ দিয়ে রাখলে ব্যথা কমতে থাকে। বরফ অথবা ঠাণ্ডা কোনো কিছু দিয়ে ব্যথার জায়গা চেপে রাখার মাধ্যমে ব্যথা লাঘব করা যায়।
  • ব্যথার জায়গাতে তেল, মলম মালিশ করার মাধ্যমেও অনেকটা আরাম অনুভূত হয়। এই পদ্ধতিটি বহুল ভাবে প্রচলিত একটি পদ্ধতি।
  • ওজন যদি বেশি থাকে, তাহলে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। অস্টিওপরোসিস এর বেলায় ওজনাধিক্যতা বেশি ভোগায়।
  • সমান বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। ঘুমানোর জন্যও সমান বিছানা ব্যবহার করতে হবে। বিছানা যেন উঁচুনিচু না হয়। আবার খুব নরম বিছানাও না, কিছুটা শক্ত বিছানা ব্যবহার করতে হবে।
  • ঠিকভাবে ওঠাবসা না করার কারণে, ভারী বলপ্রয়োগের কারণে অর্থাৎ হাড়কে অত্যাচার করার কারণে যদি ব্যথা হয় তাহলে তা সোজা হয়ে কোমরকে সংকোচন প্রসারণ করার মাধ্যমে লাঘব করা যায়। অনেকটা ব্যায়াম করার মতোই।
  • ব্যথানাশক নিয়ে সাময়িকভাবে আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে স্টেরয়েডযুক্ত মেডিসিন বা ব্যথানাশক যেন না নেওয়া হয়।
  • কোমরে বেশি বলপ্রয়োগ না করা। কোমর, ঘাড়, মাথায় ভারী বস্তু বহন না করা।
  • প্রতিদিন মেরুদণ্ড, কোমর এর পেশি ও হাড়ের সুবিধামতো ব্যায়াম করা। পেশি ও হাড় সোজা হয়ে টান দেওয়া, সংকোচন প্রসারণ ( স্ট্রেচিং)  করা, সাঁতার, লাফানোর মতো ব্যায়াম গুলো করলে ভালো।

হাড়ের সুস্থতায় খাবার

ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে খুবই প্রয়োজনীয়। হাড়ের অসুস্থতা, ব্যথা যাতে না হয় তারজন্য দৈনিক খাদ্য তালিকাতে এই উপাদান দুটি রাখা উচিত।

কোমর ব্যথার কারণ নির্ণয় করা

এক্সরে, আল্ট্রাসাউন্ড, এমআরআই, সিটিস্ক্যান, রক্ত পরীক্ষার সাহায্যে আসলে কোন কারণে ব্যথা হচ্ছে তা নির্ণয় করা হয়। কোমরের হাড়ে ও হাড়ের সংযোগস্থলে ভাঙা, ইনফেকশন, হাড়ক্ষয় সহ অন্যান্য কোন কারণে ভোগান্তি হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া যায় এসব পরীক্ষার দ্বারা।

কোমর ব্যথা হোক অথবা অন্যান্য জায়গায়ই হোক, ঘরোয়া চিকিৎসায় যদি পরিত্রাণ না মেলে তাহলে অবহেলায় না রেখে ডাক্তারি পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url