লিভার ভালো রাখুন ৩ টি কাজ দ্বারা
প্রাণীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে লিভার অন্যতম। একে শক্তির ঘরও বলা হয়। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও স্বাভাবিক লিভার। কিন্তু নিজেদের কিছু ভুল, দোষের কারণে নিজেরাই অমূল্য এই অঙ্গের ক্ষতি ডেকে আনে অনেকে। লিভার ভালো রাখতে কী করতে হবে, লিভার ভালো রাখার খাবার ও কোন কাজগুলো করে এটিকে সুস্থ রাখা যায় তা নিয়েই থাকছে।
লিভার দেহে কী কাজ করে?
লিভারকে পাওয়ার হাউজ বলা হয় এজন্য যে এটি দেহে একাধিক গুরুত্ব পূর্ণ কাজ করে থাকে। প্রোটিন ও রক্তের গ্লুকোজ উৎপাদন করা, ভিটামিন ও খনিজ দেহের জন্য সঞ্চিত করে রাখা ও তা সারাদেহে জোগান দেওয়া, হজমের সহায়তা, অ্যালকোহল ও বিভিন্ন ঔষধের বিষাক্ত উপাদানকে নষ্ট করে দেওয়ার মতো অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে। এই কাজগুলো না হলে কেউ সুস্থ থাকতে পারবে না। তাই নিজে সুস্থ থাকার জন্য লিভার এর সুস্থ রাখার কাজও করতে হবে।
লিভারের রোগ অনেকটা নিরবেই থাকে দীর্ঘদিন ধরে, ফলে সহজেই তা বুঝতে পারা যায় না। লিভারের ক্ষতি না চাইলে তাই এটিকে ভালো রাখতে কী কী করতে হবে সে ব্যাপারে ধারণা রাখতে হবে।
লিভার ভালো রাখুন ৩ টি কাজ দ্বারা
কিছু খাবার, বাজে অভ্যাস পরিত্যাগ, এক্সারসাইজ করে লিভার ভালো রাখা যায়।
এক. যেসব খাবারে লিভার ভালো থাকে :
গ্রীন টি, কফি : কয়েকটি পরীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে গ্রীন টি /চা ও কফি পানের মাধ্যমে লিভার সিরোসিস, লিভারের অন্যান্য ক্ষতি, ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবণা অনেকাংশে কমে যায়। যদি কেউ আগে থেকে এই রোগসমূহে ভুগতে থাকে, তাহলে নিয়মিত চা বিশেষ করে গ্রীন টি ও কফি পান করলে সেসব রোগকে প্রতিরোধ করা যায়। রক্ত চলাচলকে উন্নত করার মাধ্যমে লিভারের স্বাস্থ্য উন্নতিতেও এই পানীয় দু'টি কার্যকর। লিভারের কোষে চর্বি জমা হয়ে ফ্যাটি লিভার সমস্যাটিকে দমন করতেও পানীয়দ্বয় কার্যকরী। মনমেজাজ চাঙা করতেও এক কাপ কফি অথবা চা কাজে আসে।
রসুন : এতে থাকা ভিটামিন-সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সেলেনিয়াম, প্রদাহবিরোধী উপাদানগুলো শরীর ও লিভার থেকে বিষাক্ত বস্তু শোষণ করতে ও তা দেহ থেকে বের করে দিতে কাজ করে। রসুনের প্রদাহবিরোধী গুণের জন্য এটিকে "প্রাকৃতিক হারবাল" বলা হয়ে থাকে। তরকারিতে দেওয়ার পাশাপাশি কাচা রসুন খাওয়ারও অভ্যাস করাও ভালো।
ওটস : ওটস কার্বোহাইড্রেট জাত এক খাবার। কার্বোহাইড্রেট লিভারকে সুস্থ রাখার অসাধারণ এক উৎস। ক্ষতিকারক কোনো কার্বোহাইড্রেট নেই ওটসে। এতে থাকা মিশ্রিত কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার ওজন কমিয়ে আনতেও পারদর্শী।
সবুজ শাক সবজি : বাঁধাকপি, ব্রকোলি, পালংশাক এসমস্ত শাক সবজি তে থাকে ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার ও প্রদাহ প্রতিরোধী পদার্থ যা দেহ থেকে বিষাক্ততা অপসারণ করে এবং লিভারকে সুস্থভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। বিষাক্ত পদার্থ অপসারণের সাথে খাদ্য হজম হওয়া ও ওজনের নিয়ন্ত্রিতকরণেও এসব খাবার সহায়তা করে।
ফ্রুটস : আঙুরফল, জাম, জাম্বুরা, অ্যাভোকাডো, আপেল, জলপাই, স্ট্রবেরি, লেবু এসব ফ্রুটস শুধু লিভারই নয়, সর্বোপরি স্বাস্থ্যের জন্যই দারুণ কার্যকর। এসবে থাকে এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, মিনারেল, ফ্যাটি অ্যাসিড, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা লিভার থেকে টক্সিক পদার্থ শোষণ, অপসারণ করে ও স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বজায় রাখে।
চর্বির মাছ : স্যামন, পাঙ্গাশ, রূপচাঁদা, এসব মাছে থাকে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ওমেগা৩ যা লিভারের জন্য ভালো।শুধু লিভার নয়, হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যও ওমেগা৩ উপকার দিয়ে থাকে।
বাদামজাত শস্য : বিভিন্ন রকম বাদাম, মটরশুঁটি, শিমের বিচি, ডাল ইত্যাদিতে এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকে। এগুলোও নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে লিভারকে ভালো রাখা যায়।
তেল : খাবারে ও রান্নায় সয়াবিন, সরিষার তেল বেশি ব্যবহার না করে জলপাইয়ের ও অ্যাভোকাডোর তেল ব্যবহার করলে বেশি স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যাবে। জলপাইয়ের তেলের রয়েছে অনেক উপকারিতা। এনজাইম ও চর্বিস্তরের উন্নতি করা, বিপাকের কাজে সহযোগিতা করার মতো উপকারগুলো জলপাই তেল করে থাকে। অ্যাভোকাডোকে ফলের রাজা বলা হয় এর অনেক গুণাগুণের জন্যই। তাই এটির তেলও গুণাগুণ সম্পন্ন।
বিশুদ্ধ পানি : দিনের শুরুতে খালি পেটে, খাবারের পর, একবেলা থেকে আরেক বেলার খাবারের মাঝামাঝি সময়, ঘুমাতে যাওয়ার দুই ঘণ্টা আগ পর্যন্ত সময়ে সারাদিনে যতসম্ভব চেষ্টা করতে হবে ৩-৪ লিটার পানি পানের। কমপক্ষে ২ লিটার করে পানি গ্রহণ করতেই হবে সুস্থতার জন্য। পানি শরীরের সকল ক্রিয়া বিক্রিয়াকে সচল রাখে।
দুই. যেসব কাজ করতে হবে :
১. যখন মানসিক ধকল এর মধ্যে থাকবেন তখন খাবার খাবেন না। বিশেষ করে ভারী খাবার খাবেন না। মানসিক ধকল থাকলে শরীরও নেতিয়ে পড়ে ও বিভিন্ন ক্রিয়া বিক্রিয়া অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এসময় হজমক্রিয়াও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে ফলে তখন খাবার খেলে ঠিকভাবে হজম হতে চায় না। তখন তা লিভারের জন্য চাপের হয়ে যায়। তাই এসময় না খাওয়ার চেষ্টা করুন।
২. রাসায়নিক ও বিষাক্ত বস্তু স্পর্শ করা, খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ খাবারের মাধ্যমে রাসায়নিক দেহের ভিতরে প্রবেশ করে লিভারের ক্ষতিসাধন করে। খাবার খাওয়ার আগে সেই খাবারের রাসায়নিক দেখে ও সতর্কতা মেনে খেতে হবে। কোনো অঙ্গ দিয়ে রাসায়নিক ও বিষাক্ত কিছু স্পর্শ করলে সাবান ও জীবাণুনাশ দিয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে।
৩. নিরাপদ যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং যৌনবাহিত রোগ থেকে দূরে থাকতে হবে। হেপাটাইটিস এ,হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এর জন্য ভ্যাকসিন নিতে হবে।
৪. ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, হার্টের অসুখের পরিচর্যায় থাকতে হবে।
৫. অ্যালকোহল বর্জন করতেই হবে। কারণ এটা ফ্যাটি লিভারের, সিরোসিস ও এরকম দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে।
৬. স্মোকিংও বাদ দিতে হবে। কারণ স্মোকিং এর তামাক ও তা থেকে নির্গত ধোঁয়া ফুসফুসের সাথে লিভার ও চোখেরও ক্ষতি করে।
৭. শরীরে ট্যাটু করা যাবে না। ট্যাটু রক্ত প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্ত করে।
৮. ব্যথা নিবারক মেডিসিন ঘনঘন সেবন করা যাবে না।
৯. অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।
১০. যারা লিভারজনিত সমস্যায় ভুগছে তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পরপর লিভার পরীক্ষা করা ডাক্তারের সাজেশন নিয়ে চলতে হবে।
তিন. এক্সারসাইজ / ব্যায়াম
স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যায়ামের পরিপূরক নেই। লিভারের সুস্থতার চাবিকাঠির একটি হলো নিয়মিত এক্সারসাইজ। উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের স্বাভাবিক সুরক্ষায় ব্যায়াম খুবই কার্যকর। এই দু'টি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে লিভারও ভালো রাখা যাবে। এক্সারসাইজ করায় শরীর থেকে ঘাম নির্গত হওয়া ভালো। কারণ ঘামের সাথে বিষাক্ত পদার্থও বের হয়ে যায়।
তাই সিদ্ধান্ত নিন দিনে বেশি বেশি ঘাম ঝরানোর। মাঝারি বা দ্রুতগতিতে হাঁটা, দৌড়, সাইকেল চালানো এই এক্সারসাইজগুলো লিভারে রক্ত প্রবাহিত করে ও লিভারকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখে।
দেহের জন্য পাঁচশোরও অধিক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্ব পূর্ণ ক্রিয়া বিক্রিয়ায় লিভারের ভূমিকা অপরিসীম। তাই লিভার ভালো রাখতে সচেতন হতে হবে।