কীভাবে জানবেন আপনার হরমোনের সমস্যা আছে? (Signs of hormonal problem)
হরমোন প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ এককথায় সমগ্র জীবজগতের মধ্যে বিদ্যমান। প্রতিটি জীবের জন্ম, বেঁচে থাকা, মৃত্যু সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে হরমোনের পদচারণ। যদি হরমোনের নিঃসরণ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, হরমোনের কোনো অস্বাভাবিকতা হয় তাহলে সেটার প্রভাব পড়ে জীবের জীবন চালনের সর্বক্ষেত্রেই। শরীরে হরমোনের নিঃসরণ বাঁধা পাচ্ছে কি-না, কোনো অস্বাভাবিকতা বা কোনো ত্রুটি হয়েছে কি-না তা সবাই বুঝতে পারে না। কীভাবে জানবেন আপনার হরমোনের সমস্যা আছে? চিন্তা করবেন না, এখনই তা জানতে পারবেন।
হরমোন
জীবের জীবনের প্রতিটি কাজ, ক্ষেত্র সবকিছুতেই হরমোনের প্রভাব। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হরমোনের নিঃসরণ চলতে থাকে। হরমোন এক রাসায়নিক তরল জাত উপাদান, যা শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। মানবদেহের সর্বত্র অসংখ্য গ্রন্থি আছে। সেসব গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়ে তা জীবদেহের রক্তের মাধ্যমে সারাদেহে চলাচল করে। তবে সর্বপ্রথম হরমোন তৈরি হয় মস্তিষ্কে থাকা গ্রন্থিতে, তারপর শরীরের সর্বত্র বিদ্যমান গ্রন্থিগুলোতে। আর উদ্ভিদের মধ্যে শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে ছড়ায়।
হরমোন নিঃসৃত হয়ে তা শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে বিধায় হরমোনকে শরীরের "রাসায়নিক বার্তাবাহক" বলা হয়।
প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নিজেদের কাজের জন্য জাগিয়ে দেওয়া, উত্তেজিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে হরমোন। ঘুম থেকে জেগে উঠা থেকে সারাদিনের যাবতীয় কাজেই হরমোনের বিচরণ। অসংখ্য কোষ নিয়ে জীবদেহ গঠিত, সেসব কোষ ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে রাসায়নিক আদান-প্রদান, যোগাযোগের কাজ করে হরমোন। সহজেই অনুমান করা যায় যে, যদি হরমোনের সমস্যা হয় তাহলে কী কী হতে পারে।
হরমোনের সংখ্যা
মানুষের শরীরে ৬০ টির অধিক হরমোন রয়েছে যা মানুষের জীবনের কোনো না কোনো বিষয়ের সাথে জড়িত। এতগুলো হরমোনের নাম সবাই জানে না, কিন্তু টেস্টোস্টেরন, এস্ট্রোজেন, থাইরয়েড, এড্রেনালিন, প্রজেস্টেরন, এনৃড্রোজেন, ইনসুলিন, কর্টিসল - এই হরমোন গুলোর নাম অনেকেই জানে। একেকটি হরমোনের কাজও আলাদা আলাদা।
জীবকে ছোট থেকে বড় হওয়া, খাটো থেকে লম্বা হওয়া, ওজন কম-বেশি, ইমিউন সিস্টেমের পার্থক্য, আবেগ-অনুভূতি সবকিছুতেই রয়েছে হরমোন। নিজস্ব নিয়মেই প্রতিটি হরমোন কাজ করে যায়। যখনই হরমোনের কোনো সমস্যা হবে তখন প্রাণীরা কোনো না কোনো রোগ কিংবা শারীরিক ও মানসিক কোনো সমস্যায় ভুগতে শুরু করবে।
হরমোনের সমস্যা হওয়ার বয়স
নির্দিষ্টভাবে কোনো বয়স নেই। যে কারও, যে কোনো বয়সে হরমোনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ছোট বাচ্চা ও বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলেমেয়েদের হরমোনের সমস্যা হলে অপুষ্টি, উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাঁধা বা লম্বা না হওয়া, মেধাশক্তি কম থাকা, অতি চাঞ্চল্যতা অথবা চুপচাপ থাকা এরকম কিছু লক্ষণের প্রকাশ ঘটে।
আর সকল বয়সীদের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে।
কীভাবে জানবেন আপনার হরমোনের সমস্যা আছে?
বুঝলেনই তো হরমোন কতটা প্রয়োজনীয়। যদি কখনো হরমোনের নিঃসরণ ঠিকমতো না হয়, ব্যালেন্স ঠিক না থাকে তাহলে জটিল সব সমস্যার দেখা দিতে পারে। হরমোনের সমস্যা মানে শুধু হরমোন নিঃসরণ কম হওয়া নয়, অত্যধিক মাত্রায় হরমোন নিঃসরণও হরমোনের সমস্যা।
ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে সমস্যাগুলো হয়
একসাথে ছেলে ও মেয়ে অর্থাৎ নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে যে সমস্যাগুলো দেখা যায় সেগুলো বলা হলো :
মাংশপেশির দূর্বলতা
যেহেতু হরমোন বিভিন্ন কোষ ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে জড়িত থাকে, সেহেতু হরমোনে সমস্যা হলে কোষে ও অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে তার প্রভাব পড়বেই। মাংসপেশি দূর্বল হয়ে যাওয়া হলো তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। মাংসপেশি ব্যথা, ফোলা, অসাড় হয়ে যাওয়া, ক্ষয় হওয়া হলো দূর্বলতার প্রকাশ।
অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, ফোলা
কোষ আর অঙ্গে-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোতে অসুস্থতা বিরাজ করবে। হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হবে, জোড়া স্থলে বা হাড়ের কোনো অংশ ফুলে যাবে হরমোনের সমস্যা হলে। এর একটি পরিচিত লক্ষণ হলো গলা বা কাঁধের পাশে ফোলা হওয়া, যাকে "কুঁজ" বা "গজ" বলা হয়।
ওজন কম-বেশি
হরমোনের নিঃসরণ অথবা তারতম্যের কারণেই মানুষের ওজনেরও তারতম্য হয়। কারও হয় বেশি, কারও হয় কম। যখন হরমোন নিঃসরণ না হবে, তখন হঠাৎ করেই কারও ওজন কমে যেতে থাকবে। আবার যদি কারও মধ্যে হরমোনের নিঃসরণ খুব বেশি হতে থাকে তাহলে ওজন বাড়তেই থাকবে।
হার্টবিটের তারতম্য
রক্ত চলাচলের সাথে হরমোন বাহিত হয়। রক্ত প্রবাহিত হয়ে হার্ট বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াতে অবদান রাখে। হরমোন সমস্যার কারণে রক্তের প্রবাহতে অস্বাভাবিক অবস্থা হয়, তখন হার্টবিট /হৃৎস্পন্দনের তারতম্য দেখা যায়। স্পদন বেড়ে যেতে পারে, আবার কমেও যেতে পারে।
যৌন ক্ষমতায় পরিবর্তন
ছেলে-মেয়ে সবার এমনকি সকল প্রাণীরই যৌন স্বাস্থ্যের উপর হরমোনের প্রভাব রয়েছে। যদি হরমোনে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়, তাহলে যৌন ক্ষমতা কমে যেতে থাকে।
অনুভূতির পরিবর্তন
ত্বকের সর্বত্র রয়েছে অসংখ্য কোষ। কোষের সাথে থাকে হরমোন, এরজন্যই আমরা কোনো বস্তু ঠাণ্ডা না-কি গরম তা অনুভব করতে পারি। কোন জিনিসের ঘ্রাণ কেমন তা বুঝতে পারি। হরমোন সমস্যা হলে এসব অনুভূতি হুট করে বেড়ে যায়। বেড়ে গেলে স্বাভাবিক ঠাণ্ডাকে অনেক ঠাণ্ডা বা শীতল অনুভব হবে, আর স্বাভাবিক গরমকে লাগবে অসহ্যকর। তবে কারও ক্ষেত্রে এমন সেনসিটিভিটি কমতেও পারে।
বাওয়েলের নড়াচড়া বৃদ্ধি
বাওয়েল হলো পেটের ভিতরে থাকা অন্ত্রসমুহ। হরমোন ঠিকঠাকভাবে থাকে বলেই ভিতরের অন্ত্রগুলোও ঠিক থাকে ফলে পেটে ক্রিয়া বিক্রিয়া ভালোভাবে হয়। পেট পরিষ্কার থাকে। কিন্তু হরমোনের সমস্যায় তা ঠিক থাকে না। তখন কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবার হজম না হওয়া ও অন্ত্রগুলোর নড়াচড়া, চলাচল বেড়ে যায়।
মানসিকতার পরিবর্তন
আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে হরমোন বড় এক প্রভাবক। হরমোনের তারতম্য হলে তাই সেটার প্রভাব পড়ে মানসিকতার উপর। ডিপ্রেশন বেড়ে যাওয়া, অবিরত অবসাদ ও দূর্বলতা, দুশ্চিন্তা, স্নায়ুচাপ বেড়ে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়।
স্কিনে সংক্রমণ
ত্বক বা স্কিনের সবখানেই রয়েছে কোষ। সেসব কোষে থাকে হরমোন। হরমোনাল সমস্যা হলে স্কিনে বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দেয়। ব্রণ হওয়া এবং সহজেই তা না যাওয়া, স্কিনের যেকোনো স্থানে চুলকানো, ফুসকুড়ি হয়, ত্বকে শুষ্কতা।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস
স্মৃতিশক্তি বজায় রাখা মস্তিষ্কের কাজ। হরমোন সর্বপ্রথম মস্তিষ্কেই তৈরি হয়। মস্তিষ্কই দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কে যদি হরমোন ঠিকমতো নিঃসরণ না হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেটা মস্তিষ্কে বিরূপ অবস্থা সৃষ্টি করবে। তখন স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়।
আরও কিছু সমস্যা
মাথা ব্যথা, চোখে অস্পষ্ট বা ঝাপসা দেখা, চুল ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া, ঘনঘন পিপাসা লাগা, ঘনঘন প্রস্রাব, ঘুম ঠিকমতো না হওয়া বা ব্যাঘাত ঘটা, চোখ-মুখ ফোলাভাব, খিদের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত ঘাম।
ছেলেদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যে সমস্যাগুলো
- যৌনসক্ষমতা কমে যাওয়া
- অণ্ডকোষের আকার হ্রাস অর্থাৎ ছোট হয়ে যাওয়া
- লিঙ্গ শক্ত না হওয়া, পুরোপুরি খাড়া না হওয়া
- বীর্য কমে যাওয়া, সন্তান জন্মদানে অক্ষম, বন্ধ্যাত্ব
- চুল ও দাঁড়ি কম হওয়া, দাঁড়ি গজাতে দেরি
- মাংসপেশির ক্ষয়
- ম্যানবুবস বা ছেলেদের স্তন অস্বাভাবিক নরম
- অল্পতেই চমকে উঠা, মেজাজ বিগড়ে যাওয়া
- হাড়ক্ষয়, বাত ব্যথা
- শক্তি কমে গিয়ে ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়া
মেয়েদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যে সমস্যাগুলো
- অনিয়মিত অথবা ঘনঘন পিরিয়ড, পিরিয়ড না হওয়া
- মুড সুইং
- ছেলেদের মতো শরীরে লোম গজানো
- চুল ঝরে যাওয়ার হার বাড়া
- মুখমণ্ডলে, বুকে, পিঠে ব্রণ বা ফুসকুড়ি
- থাইরয়েডে সমস্যা, এ সমস্যা হলে উল্লেখ করার মতো একটি লক্ষণ হলো অবিবাহিত মেয়ে ও বৃদ্ধ নারীদের স্তন থেকে দুধ বের হয়ে আসা
- স্তনের বর্ণ ও আকারে পরিবর্তন, স্তন বেশি ঝুলে যাওয়া, স্তনের ভিতর গোঁটা বা সেরকম কোনো মাংসপিণ্ড
- যৌনাঙ্গ অনেক শুষ্ক হওয়া
- যৌন মিলনের সময় যৌনাঙ্গে ব্যথা
- সন্তান জন্মদানে অক্ষম, বন্ধ্যাত্ব
সবার ক্ষেত্রেই যে একসাথে সবগুলো সমস্যা থাকবে এমনটা নয়। কারও কম, কারও বেশি, আবার কারও মধ্যে সবগুলো সমস্যা-ই থাকতে পারে।
শেষকথা
আপনার হরমোনের সমস্যা আছে কি-না তা নিজেই উপলব্ধি করুন, কোনো সমস্যা হলে হরমোন বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে নিশ্চিত হোন ও ট্রিটমেন্ট নিন।