সর্দি কাশি দূর করতে ও নাক বন্ধ হলে করণীয়
সর্দি কাশি তে মানুষ তার ৬০-৭০ বছরের জীবনে বেঁচে থাকতে শ'খানেক বার আক্রান্ত হয়। এটি রোগ না বলে স্বাভাবিক একটি অসুস্থতা বলা যায়। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে সর্দি কাশি জটিল রুপও ধারণ করতে পারে। সাধারণ সর্দি কাশি থেকে ফ্লু, যক্ষার মতো জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তাই শরীরের কোনো বিরূপ লক্ষণকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। সুস্থ থাকতে চাইলে অবশ্যই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সর্দি কাশি দূর করতে ও নাক বন্ধ হলে করণীয় সম্পর্কে-ই বলা হবে।
টাইটেলগুলো-
- সর্দি কাশি কী কারণে হয়
- সর্দি কাশির উপসর্গ
- সর্দি কাশি ও ফ্লু
- সর্দি কাশি দূর করতে করণীয়
- নাক বন্ধ দশা কাটাতে করণীয়
- সর্দি কাশি থেকে সুরক্ষা পেতে
- ইতিকথা
সর্দি কাশি কী কারণে হয়?
মূলত এটি একটি ভাইরাসজনিত অসুস্থতা। নাক ও গলায় এই সংক্রমণ বেশি হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে ২০০ প্রজাতির বেশি ভাইরাস রয়েছে যা সর্দি কাশির জন্য দায়ী। সর্দি কাশি ছোঁয়াচে সংক্রমণ। কারণ এটি বাতাস, আক্রান্তের হাঁচি,কাশি ও সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। ২০২০ সালে শুরু হওয়া মহামারী করোনা ভাইরাসও এভাবে ছড়ায়। কিন্তু সর্দি কাশি হওয়া মানেই করোনা সংক্রমিত হওয়া নয়। সর্দি কাশি সাধারণ এক অসুস্থতা, যা আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণেই মাঝেমধ্যে হয়ে থাকে।
আবহাওয়ার পরিবর্তন, কোনো বস্তুর প্রতি সংবেদনশীলতা ( যেমন- বৃষ্টিতে ভিজলে কারও কারও সর্দি কাশি ও জ্বর হয়), আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ হওয়া এগুলোর কারণেই যেকেউই যে কোনো বয়সে সর্দি কাশিতে ভুগতে পারে।
মানসিক চাপে থাকার ফলে, একাধিকবার ঠাণ্ডা পানিতে গোসলের জন্যে, অতিরিক্ত গরমের কারণে, আবহাওয়া বদলানো ও সর্দি কাশিতে সংক্রমিত কারও সংস্পর্শ হলে যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে।
সর্দি কাশির উপসর্গ
প্রাপ্ত বয়স্ক দের বছরে ৫ বারেরও অধিক, এবং শিশুদের বছরে ১০ বারেরও অধিক সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হওয়াকে সাধারণভাবে ও স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে এর উপসর্গগুলোও ভিন্ন হতে পারে। তবে সর্দি কাশির সাধারণ কিছু উপসর্গ সবার মাঝেই দেখা যায়। যে উপসর্গগুলো সাধারণত হয়ে থাকে-
১. নাক দিয়ে সর্দি বা পানি পড়া।
২. গলায় কফ জমা, গলা ব্যথা।
৩. ঘনঘন হাঁচি, কাশি।
৪. কানে চাপ অনুভূত হওয়া যাকে কানে তালা লাগাও বলা হয়।
৫. মাথা ব্যথাও হয়।
৬. খাওয়ায় অরুচি থাকা।
৭. নাক দিয়ে ঠিকমত শ্বাসক্রিয়া না হওয়া, নাক বন্ধ থাকা।
৮. হালকা জ্বর ও শরীর ব্যথা।
এগুলোই সর্দি কাশির সাধারণ কিছু উপসর্গ যা শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবার দেখা যায়।
সর্দি কাশি ও ফ্লু
সর্দি কাশি স্বাভাবিক একটি অসুস্থতা, যেটা বড়জোর ১ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু ফ্লু এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। সর্দি কাশি আর ফ্লু এক না। ফ্লু হলো ইনফ্লুয়েঞ্জার ও নিউমোনিয়ার মতো জটিল রোগের অবস্থা, যেটা 'ইনফ্লুয়েঞ্জা' নামক ভাইরাসের কারণে হয়। সর্দি কাশি ও ফ্লু-তে উপসর্গগুলো প্রায় একইরকম। কিন্তু ফ্লু-তে উপসর্গগুলো কঠিন ও ভয়াবহও হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের ভালো, তাদের ক্ষেত্রে সর্দি কাশি ২-৩ দিনেই সেরে যায়। আর দূর্বল ক্ষমতার হলে ১ সপ্তাহের মতো লেগে যায় সর্দি সারতে।
কিন্তু ফ্লু এত তাড়াতাড়ি সারে না। ফ্লু ভালো হতে ২ সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে যায়। সর্দি কাশিতে উপরোক্ত উপসর্গগুলো মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার হয়। ফ্লু-তে উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে তীব্রতর হতে পারে।
ফ্লু-তে যে জটিলতা গুলো দেখা যায়:
- জ্বরের মাত্রা বাড়তে থাকে, কাঁপুনি জ্বরও দেখা যায়।
- নাক, গলা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা।
- খুবই দূর্বলতা ও ক্লান্তিতে ভোগে রোগী।
- শুকনো কাশি চলতে থাকে, আস্তে আস্তে কাশির মাত্রা বাড়ে।
- ঘুমে ব্যাঘাত।
- খেতে না চাওয়া, বমিভাব।
- ডায়রিয়াও হতে পারে।
ফ্লু'র এই উপসর্গগুলো সঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট না নিলে আরও জটিল আকার নিতে পারে। এমনকি ফ্লু-তে মৃত্যুর ঘটনাও দেখা যায় বিশ্বে।
সর্দি কাশি দূর করতে করণীয়
সর্দি কাশি থেকে মুক্তির ব্যবস্থা না নিলেও কয়েকদিনের মধ্যেই এই অসুস্থতা কেটে যায়। কিন্তু সর্দি আর কাশি যদি খুব কষ্টের হয়, যেমন- নাক একেবারেই বন্ধ হওয়ায় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের কাজ করতে কষ্ট, অনবরত কাশি, ব্যথা থাকে তাহলে কিছু উপায়ে তা উপশম করার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সর্দি কাশির কষ্ট দূর করবেই এমন কিছু উপায় :
আরামদায়ক পরিবেশ
সর্দির সময় শরীরে শীত-শীত অবস্থা বিরাজ করে। এমতাবস্থায় যদি শরীর গরম রাখার কাপড়চোপড় পরা হয়, তাহলে তা হবে আরামের। সোয়েটার, জ্যাকেট, হুডি, মোজা, জুতা, টুপি এগুলো পরলে শীতভাব কমে ও শরীর তার প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতিতে কাজ করতে পারে। এসব না পরলেও কাঁথা বা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন, পারলে ঘুমান। এমন আরামদায়ক পরিবেশ পেলে শরীরে সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থা আরও সবল হয়।আর তা সবল হলে সর্দি কাশি থেকে উপশম মিলবে দ্রুতই। সকালের ও বিকেলের পড়ন্ত নরম রোদে গা পোহান ২০-৩০ মিনিট। এতেও আরাম অনুভব হবে।
বিশ্রামে থাকা
সর্দি কাশিতে সংক্রমিত হলে নিতে হবে বিশ্রাম, হতে হবে ভালো ঘুমের রুটিন। বিশ্রাম শুধু শরীরকেই না, মনকেও দিতে হবে। আপনি জানেন কি যে মানসিক চাপের কারণেও সর্দি কাশি হয়ে থাকে? হ্যা, এটা সত্যি যে খারাপ মানসিক অবস্থার কারণে শরীর তার প্রতিরোধী কার্যক্রমে বাঁধার সামনে পড়ে। ফলে সর্দি কাশির মতো সাধারণ অসুস্থতাগুলো দিয়ে শরীর তার কাজের অস্বাভাবিকতার জানান দিয়ে থাকে। তাই বিশ্রাম নিন পর্যাপ্ত।
নাক বন্ধের কষ্ট দূর করবে যেগুলো
নাক বন্ধের কষ্ট করতে না চাইলে নিচের এই কাজগুলো সন্ধ্যা ও রাতের ঘুমের আগে করুন:
গরম পানি
পানি গরম করে তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসলে মৃদু গরম তাপমাত্রার পানি দিয়ে গড়গড়ালে গলায় ও নাকে স্বস্তি আসে। যাদের সর্দি কাশি আছে তারা সন্ধ্যায় একবার, আরেকবার ঘুমানোর আগে এভাবে গড়গড় করে নিলে ঘুমের সময় নাক বন্ধ দশা হবে না এবং নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের কাজ ঠিক থাকবে।
লেবু
ভিটামিন-সি সর্দি কাশি সারাতে কার্যকর তা অনেক আগেই প্রমাণিত। আস্ত লেবুও খাওয়া যায়, আবার লেবু দিয়ে গরম চা খাওয়াও যায়। গরম পানি নাক বন্ধের সমস্যার সমাধান করে, আর লেবু নাক পরিষ্কার করে সর্দি কাশি দূর করে। লেবুর সাথে এক চামচ মধুও নিয়ে গরম পানির সাথে মিশিয়ে পান করলে আরও ভালো।
আদা
সর্দি কাশির সময় আদার চা খাওয়ার উপকার সম্পর্কে জানে অনেক মানুষই। আদার টুকরা কেটে অথবা চায়ে আদার কুচি দিয়ে তা খেলে আরাম পাওয়া যাবে সর্দি কাশি থেকে। আদার সাথে এলাচ, দারুচিনিও দিলে তা আরও বাড়তি উপকার বয়ে আনবে।
রসুন
রসুনের কোয়া অথবা কুচি করে কেটে তা চিবিয়ে খেলে নাক বন্ধ দশা কাটবে। এটা আদার মতোই কাজ করে। রসুনের গন্ধ সহ্য করতে না পারলে হালকা একটু লবণে মেখে নেন।
হলুদ
প্রদাহ বিরোধী উপাদান হলুদে থাকায় এটি গ্রহণ করলে সর্দি কাশিজনিত ব্যথা, নাক ও গলা ফোলার সমস্যার পরিত্রাণ পাওয়া যায়। হলুদ সিদ্ধ করেও নিতে পারেন, অথবা হলুদের গুঁড়া, লেবু আর মধু একসাথে সহনীয় গরম পানিতে গুলে পানীয় বানিয়ে খেয়ে নেওয়া যাবে।
দারুচিনি
এটাও আদার মতো ব্যবহার করা যায়। এছাড়া বহুলভাবে ব্যবহৃত যে পদ্ধতি আছে দারুচিনি ব্যবহারের, তা হলো- পানিতে দারুচিনি ও তেজপাত ফুটিয়ে নিয়ে পানি কিছুটা সহনীয় তাপমাত্রায় আসলে তা চায়ের মতো গ্রহণ করা। একটু মধুও মিশিয়ে গ্রহণ করতে পারলে স্বাদও লাগবে, ভালোও লাগবে।
বাষ্প গ্রহণ
এটা পানির ভাপ নেওয়া। একটি বালতিতে অথবা পাতিলে অথবা গামলার মধ্যে গরম পানি রেখে উপুড় হয়ে নাক দিয়ে গরম পানির বাষ্প গ্রহণ করার মাধ্যমে নাক বন্ধের হাত থেকে রেহাই মিলে। বাষ্প ভালোভাবে গ্রহণের জন্য মাথা গামলা বা পাত্রের উপর রেখে গামছা বা তোয়ালে দিয়ে উপুড় হয়ে মাথা সহ ঢেকে নিবেন।
খাবার
বিট, গাজর, মিষ্টি আলু, তরমুজ, আম, আনারস, কমলা, কুমড়ো, শাকসব্জি সহ ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি আছে এমনসব খাবার খেলে ভালো সর্দি কাশির সময়।
আর নিশ্চয়ই বেশি বেশি পানি খেতে হবে। অন্যান্য তরলীকৃত খাবার যেমন ফলের জুস, দই, গরম দুধ ও স্যুপ খেয়ে নেওয়া যায়।
এই ব্যবস্থাসমূহ নেওয়ার মাধ্যমেই সর্দি কাশি ও নাক বন্ধ দশা দূর করা যাবে।
সর্দি কাশি থেকে সুরক্ষা পেতে
ছোঁয়াচে সংক্রমণ যা সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যদের মাঝে ছড়ায়। সর্দি কাশির কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন নেই, তাছাড়া এটি কোনো গুরুতর অসুখও নয় বলে বিশেষজ্ঞগণ বলেন। কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করলেই সর্দি কাশি অন্যদের মাঝে ছড়াবে না। সুরক্ষাগুলো :
১. মূল সুরক্ষা হলো সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হয়েছে এমন কারও সংস্পর্শের কাছাকাছি না যাওয়া।
২. সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহার করা কোনো জিনিসপত্র ধরলে পরে হাত সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ধোয়ার আগ পর্যন্ত সেই হাত দিয়ে নিজের অথবা অন্য সুস্থ কারও দেহে হাত দেওয়া যাবে না।
৩. যারা সংক্রমিত হয়েছে তাদের কর্তব্য হলো সচেতন হয়ে নিজের কর্মস্থল থেকে বের হয়ে ঘরে অবস্থান করা এবং নিজের আশেপাশে মানুষের আনাগোনা হতে না দেওয়া।
৪. সংক্রমিত ব্যক্তির উচিত হলো সবসময় নাক-মুখ মাস্ক দিয়ে ঢেকে চলাচল করা এবং মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলা। হাঁচি, কাশির সময় নাক-মুখ চেপে হাঁচি ও কাশি দেওয়া।
৫. সুরক্ষিত থাকার সঠিক উপায় হলো দৈনিকে অন্তত ২০ মিনিটের ব্যায়াম করা। এর ফলে বডির ইমিউন সিস্টেম উন্নত হবে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়া
যদি
- সর্দি কাশির উপসর্গগুলো ১ সপ্তাহের বেশি ধরে চলমান থাকে
- কাশি ৩ সপ্তাহের বেশি চলতে থাকলে। ৩ সপ্তাহের বেশি কাশি থাকা যক্ষার লক্ষণ বলা হয়।
- কাশিতে রক্তমিশ্রিত থাকে
- শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি হয়
- সংক্রমিত কারও দীর্ঘসময় ধরে কিডনি জনিত, হার্ট জনিত, ফুসফুস ও ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক রোগগুলি থাকে
- পানিশূন্যতার সমস্যা লক্ষিত হয়
তাইলে সংক্রমিত ব্যক্তিকে নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। প্যারাসিটামলের ঔষধগুলো ও নাকের ড্রপার ব্যবহার করে সারানো যায়। তবে ভুলেও ডাক্তার এর সাজেশন ছাড়া কোনো ঔষধ নিবেন না।
ইতিকথা
সর্দি কাশি সাধারণ অসুস্থতা হলেও এটিকে হেলাফেলা করা ঠিক নয় যদি লক্ষণে জটিলতার তৈরি হয়। উল্লিখিত ব্যবস্থাসমূহ নিলে সর্দি কাশি দূর হবে সাথে নাক বন্ধের সমস্যাও।