কী করলে চোখ ওঠা ভালো করে আটকানো যাবে?
২০২২ সালের শেষের দিকে এসে "চোখ ওঠা" রোগটি প্রকোপ ছড়াচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে নানান বয়সী লোকজন। কেন চোখ ওঠা রোগ হয় এবং কী করলে চোখ ওঠা ভালো করে আটকানো যাবে এ বিষয়গুলো জানা থাকলেই ছোঁয়াচে এই রোগটি প্রতিরোধ করা যায়।
কেন চোখে এইরকম হয়, চোখ ওঠা প্রতিরোধ করতে সবার কর্তব্য, কোন খাবার চোখ ওঠা রোগকে ভালো করে তুলতে পারে, এ বিষয়টিকে নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাজ, গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যগুলোই থাকছে।
চোখ ওঠা
এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। মানুষের চোখের সাদা অংশের উপর এক আবরণ রয়েছে যাকে "কনজাংটিভা" বলা হয়। এই আবরণ কোনো সংক্রমণ অথবা ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হলে তখন চোখ উঠে। পুঁথিগতভাবে এই চোখের এই অবস্থাকে "কনজাংটিভাইটিস" বলে।
একাধিক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া, এলার্জির ঘটনা থাকলে, চোখের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশের সংক্রমণের কারণেই মূলত এটা হয়। আবহাওয়ার পরিবর্তন বিশেষ করে অতি গরম ও বর্ষাকাল এবং অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা পরিবেশও এই অবস্থার জন্য দায়ী।
এটি একটি ছোঁয়াচে সংক্রমণ, যা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে, বায়ুর মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে।
কেন চোখ ওঠা রোগ হয়?
কেন হয় তা উপরেই জেনে গিয়েছেন। এছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে যেগুলোর জন্য অত্যধিক ছোঁয়াচে এই সংক্রমণটি হয়।
যে বা যারা এটাতে আক্রান্ত হয়েছে তার বা তাদের সাথে শারীরিক স্পর্শ, আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড়-চোপড় পরিধান করা, একই জিনিসপত্র ব্যবহার করা, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা পানিতে হাতমুখ ধুইলে অথবা সে ব্যক্তির সাঁতার কাটা পানিতে কেউ সাঁতার কাটলে রোগটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, ভাইরাস ও আক্রান্তদের মাধ্যমেই এটি হয়। অধিক ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্তদের মাধ্যমে এটি বিস্তৃত আকারে একসাথে অনেক মানুষষের মধ্যে হলে সেটাকে "ভাইরাল চোখ ওঠা" বলা হয়।
চোখ ওঠা বোঝার লক্ষণ
চোখের বর্ণ লাল বা গোলাপি হওয়া এই রোগটির সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ। অন্যান্য আরও যে লক্ষণগুলি দেখা যায় :
- চোখ বেয়ে অস্বাভাবিকভাবে পানি পড়া
- চোখে কোনো কিছু বিঁধছে এমন অনুভূতি
- শুরুতে এক চোখ ও পরে অপর চোখও সংক্রমিত হওয়া
- চোখের চারপাশ ফোলা
- হলুদ বর্ণের মতো ঘন আঠালো পুঁজ /পিচুটি
- চোখ অভ্যন্তরে জ্বলা, জ্বালাভাব, চুলকানো
- কোনো কিছু দেখতে ঝাপসা ও অস্পষ্ট লাগা । মায়োপিয়া ও ঝাপসা দেখা
- মণি ও এর আশেপাশে দাগ সৃষ্টি হতে পারে
- সূর্যের ও লাইটের আলো সহ্য না হওয়া, সেদিকে তাকাতে না পারা
- ব্যথাও হতে পারে হালকা
সময়কাল ও স্থায়িত্বকাল
প্রতি বছরই চোখের এই ভাইরাল সংক্রমণি সচরাচর হয় না। কয়েক বছর পরপর সাধারণত এটি দেখা যায়।
যেকোনো বয়সী মানুষই এটার শিকার হতে পারে। ছোট শিশুদেরও হয়ে থাকে সতর্কতার অভাবে।
এই রোগ কারও হলে ভয়ের কিছু নেই। এটি নিজে থেকে ১ সপ্তাহ, বড়জোর ২ সপ্তাহের ভিতরেই ভালো হয়ে যায়। শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি উন্নত হয়, তাহলে ৩-৪ দিনেই সেরে যায়।
কী করলে চোখ ওঠা ভালো করে আটকানো যাবে?
ভাইরাসঘটিত এই ছোঁয়াচে রোগকে আটকাতে হলে আক্রান্তদের ও তাদের ব্যবহার করা জিনিস ছোঁয়ার বাইরে থাকতে হবে। সহজ কিছু ব্যবস্থা ও সচেতনতা মেনে চললেই অতি সংক্রামক রোগটি আটকানো যাবে। কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা, টিকা না থাকায় এটিকে আটকানোই চোখ ওঠা ভালো করার মূল কাজ।
যা যা করতে হবে :
- যদি নিজে চোখ ওঠায় আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে সেটা যেন অন্যদের মাঝে না ছড়ায় তারজন্য নিজেকে সচেতন থাকতে হবে।
- আক্রান্ত কারও ব্যবহার্য জিনিসপত্র ধরা, পরা ও ব্যবহার করা যাবে না। যেমন- আক্রান্তের জামাকাপড় ধরা ও পরা যাবে না, গামছা ও তোয়ালে ব্যবহার করা যাবে না, সে যেসব জিনিস ও জায়গায় স্পর্শ করেছে সেসব স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা।
- কোনোভাবে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির জিনিসপত্র ও জায়গায় স্পর্শ হয়েও যায় তাহলে তখন নিজের হাত সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। হাত ধোয়া ব্যতিত কখনোই নিজের চোখে-মুখে সেই হাত লাগানো যাবে না।
- চোখ উঠলে বারবার চোখের ভিতরে পানি দেওয়া উচিত নয়।
- চোখ উঠলে চোখ আবৃত / ঢেকে রাখে এমন চশমা ও সানগ্লাস পরলে বাইরের জীবাণু প্রবেশ করতে পারবে না। চশমা ও সানগ্লাস পরে বাইরে গেলে সূর্যের আলোয় কষ্ট হবে না।
- জনসমাগম পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। তাহলে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া আটকাবে।
- বাইরে থাকাকালীন চোখ পানিতে ভিজে উঠলে অথবা বেয়ে পানি পড়লে অপরিষ্কার হাত চোখে লাগানো যাবে না। এরজন্য আলাদা টিস্যু পেপার, রুমালের ব্যবহার করতে হবে।
সহজ ও সংক্ষিপ্ত করে বললে,
চোখ উঠেছে এমন কারও কাছাকাছি শারীরিক স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। আক্রান্তের ব্যবহার করা থালাবাসন, কাপড়চোপড়, মোবাইল, দরজা এককথায় সে যেসব বস্তু স্পর্শ করেছে সেসব বস্তু স্পর্শ করা যাবে না। তাহলেই চোখ ওঠা প্রতিরোধ করা যাবে।
সচেতনতা
- চোখ উঠলে বাইরে যাওয়া ও মানুষের কাছাকাছি না যাওয়া।
- এক অথবা দুই সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া।
- অতিরিক্ত আলো, ধুলা-বালির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে না যাওয়া।
- টিভি দেখা বন্ধ রাখা। কারণ টিভির পর্দা থেকে নির্গত রশ্মি তখন চোখের জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে।
- একজনের দেওয়া চোখে ব্যবহারের ড্রপ অন্যজন ব্যবহার না করা।
- শিশু ও এই বিষয়ে সচেতন না এমন লোকদেরকে বুঝিয়ে সতর্ক করে দেওয়া।
- পরিবারের কেউ কোনোভাবে এতে সংক্রমিত হয়ে আসলে তা পরিবারের সবার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ার হার বেশি। তাই কেউ এতে শিকার হলে পরিবারের সুরক্ষার জন্য নিজে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চোখ ওঠা ভালো করতে খাবার
সকল চোখের জন্যই ভিটামিন-এ দরকারী। কনজাংটিভাইটিসের সময় যে খাবারে চোখের এই অবস্থার জন্য উপকার দিতে পারে এমন কয়েকটি খাবার হলো মধু, কিশমিশ, আমলকী, জলপাই, বিভিন্ন রঙিন শাক ও সবজি, বিটলবণ।
অন্যান্য ভিটামিনযুক্ত বিশেষ করে ভিটামিন- সি যুক্ত খাবারের সাথে চোখ ওঠা রোগে ভোগার সময় এই কয়েকটি খাবার বেশি করে খেলে তা চোখকে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বাড়তি সাপোর্ট দিবে।
অবশ্যই বেশি করে পানি পান করুন।
চিকিৎসার জন্য
নিজে থেকেই কিছুদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়, তাই চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। যদি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো :
- অতিরিক্ত চুলকানি, ফোলা, খুব বেশি টকটকে লাল হলে, বিঁধে যাওয়ার অনুভূতি বেশি হলে
- ঝাপসা দৃষ্টি অনেকক্ষণ চলতে থাকলে
- এক সপ্তাহের বেশি সময় অস্বাভাবিক পরিমাণ পানি পড়তে থাকলে
- ১ সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে
দেরি না করে চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। চোখের অন্যান্য কোষ আক্রান্ত হয়েছে কি-না তারজন্য চোখ পরীক্ষা করা উচিত।
চোখ ওঠা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
চোখ উঠলে ছোট ছেলে বাচ্চাদের গোপনাঙ্গ চোখে স্পর্শ করানো, যার চোখ উঠেছে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ উঠে - এই দু'টি সবচেয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা। চোখ ওঠাকে নিয়ে এরকম কাণ্ড ও কথা গ্রামে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
এসব কথা ও কাজ সম্পূর্ণরূপেই মিথ্যা ও বানোয়াট কুসংস্কার। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসবের কোনো উল্লেখ নেই।
ছেলে শিশুর গোপন অঙ্গ ছোঁয়ানোর কাজটি যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন একটি ভুল ধারণা।
মূলকথা
চোখ ওঠা ভালো করে আটকাতে চাইলে নিজেকে ও নিজের আশেপাশের মানুষজনদেরকে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। সচেতনতা-ই ছোঁয়াচে রোগটিকে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পারে।