দারুচিনি খাওয়ার অপকারিতা, দিনে কতটুকু দারুচিনি খাওয়া স্বাভাবিক
দারুচিনি খাওয়ার ব্যাপারে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে থাকে। কিন্তু দারুচিনির ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এটি খেতে সীমিত হতে বলা হয়। দারুচিনির উপকারী গুণ যেমন আছে, তেমনি এটি ক্ষতিও করতে পারে। দিনে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি গ্রহণ করলে হতে পারে বড় বিপদ। দারুচিনি খাওয়ার অপকারিতা ও ক্ষতিকর দিক এড়াতে চাইলে এটি দিনে কতটুকু খেতে হবে তা নিয়ে কথা হবে।
দারুচিনি খাওয়ার উপকারী গুণ
দারুচিনি তো সবাই চিনি। রান্নাঘরের অতি প্রয়োজনীয় একটি মশলা সামগ্রী। কাঠি আকৃতির ঝাল স্বাদযুক্ত এই রান্নার উপকরণের রয়েছে অনেক উপকারী গুণ। এটি বড় বড় কিছু রোগের প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নিতে সক্ষম।
এখানে দারুচিনির সবচেয়ে বেশি উপকারী গুণসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. এন্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর
শরীরকে অক্সিজেন ঘাটতিজনিত সমস্যা কাটিয়ে তুলতে ও অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখতে এন্টি অক্সিডেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। দারুচিনি থেকে সেই এন্টি অক্সিডেন্ট পাওয়া সম্ভব সহজেই। কারণ এটি থাকে সবার রান্নাঘরেই।
২. প্রদাহ প্রতিরোধী গুণ
বিভিন্ন ধরণের প্রদাহজনিত সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে আমাদের দেহে দরকার প্রদাহ প্রতিরোধী ব্যবস্থা। প্রদাহজনিত সমস্যা হলে দেহ তার স্বাভাবিক কাজকর্মে পূর্ণরূপে বহাল থাকতে পারে না ও কোষের ক্ষতি হতে থাকে। প্রদাহ থেকে যাতে কোনো সমস্যা না হয় ও দেহ যেন স্বাভাবিক থাকে তারজন্য সেই প্রদাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
দারুচিনি সেই কাজটি করে দিবে।
৩. হার্টকে সুরক্ষা দেওয়া
একাধিক উপকারী এন্টি অক্সিডেন্ট থাকায় এটি হার্টের জন্য উপকারী। কোলেস্টেরলের উপস্থিতি বেশি হলে তা হার্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। দারুচিনি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। কোলেস্টেরল যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে তা হার্টের জন্য ভালো।
৪. রক্তচাপ কমাতে
একটি গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, টানা ২ মাসের মতো নির্দিষ্ট পরিমাণ দারুচিনি গ্রহণ করলে তা রক্তচাপ কমিয়ে আনে।
৫. ইনসুলিন সহ্যশক্তি প্রদান
মানবদেহের জন্য মূল হরমোনের মধ্যে ইনসুলিন একটি। ইনসুলিন বিপাকীয় ও শক্তি বণ্টন কাজে সহায়তা করে। রক্ত প্রবাহের সাথে সুগারকে নিয়ন্ত্রিত রেখে কোষে স্থানান্তরিত করতে ইনসুলিন কাজ করে।
কিন্তু অনেকের মধ্যে দেখা যায় যে, ইনসুলিনের প্রতি তাদের দেহ সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। ইনসুলিন সহ্য করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি থাকে না। তখন ইনসুলিন এর এরূপ সমস্যার কারণে অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। ইনসুলিন এর প্রতি দেহ যেন অতি সংবেদনশীল বা সেনসিটিভ হয়ে না পড়ে তার জন্য শক্তি পাওয়া যায় দারুচিনি থেকে।
৬. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য সুরক্ষা
মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষের অস্বাভাবিকতার জন্য বিভিন্ন রোগ হতে পারে। আলঝেইমার্স ও পার্কিনসন হলো সেরকম দু'টি রোগ। মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার গুণও দারুচিনি থেকে পাওয়া এন্টি অক্সিডেন্ট দিয়ে থাকে।
৭. ক্যান্সারের প্রতিরোধ
বিভিন্ন এন্টি অক্সিডেন্টযুক্ত এই খাদ্য উপকরণটি ক্যান্সারের জন্য দায়ী কোষকে ধ্বংস করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম।
৮. ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
এতে বিদ্যমান এন্টি অক্সিডেন্ট ও অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকারী উপাদান ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে হওয়া বিভিন্ন রোগ হতে মুক্তি দিতে পারে।
জ্বর, সর্দিকাশিতে দারুচিনির চা এর উপকার সম্পর্কে সবাই জানে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু জ্বর থেকেও সারিয়ে তুলতে পারে দারুচিনির উপকারী গুণসম্পন্ন উপাদানগুলো। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের মাধ্যমে হওয়া রোগের চিকিৎসাও দারুচিনি থেকে পাওয়া যায়।
৯. বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরিতে
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে দারুচিনিতে এমনকিছু উপাদান রয়েছে যা দিয়ে জটিল জটিল রোগের ঔষধ তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়।
দারুচিনি খাওয়ার অপকারিতা
দারুচিনি যেমন স্বাস্থ্য উপকারী, তেমনি এটি অত্যধিক পরিমাণে গ্রহণে হতে পারে একাধিক ক্ষতিও। দারুচিনি অতিমাত্রায় গ্রহণের ফলে যে ক্ষতিগুলো হতে পারে সেগুলো হলো :
১. মুখে ক্ষত বা ঘা সৃষ্টি
ঝাল স্বাদের এই বস্তু অতিরিক্ত খেলে তা জিভ, মাড়ির ক্ষয় করে, মুখের ভেতরের চামড়া ছিলে যায়। আপনি হয়তো নিজে ইতিমধ্যে এই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন। চামড়া ছিলে গিয়ে ক্ষত হয়, যার জন্য পরে কোনো খাবার খেতে কষ্ট হয়, তিতকুটে অবস্থা হয়ে যায় সবকিছুর স্বাদ।
২. লিভারের ক্ষতি
সবাই সচরাচর যে ধরণের দারুচিনি ব্যবহার করে সেটাকে 'ক্যাসিয়া' বলে। এটাতে 'কমারিন' নামক উপাদান থাকে যা অতিমাত্রায় গ্রহণে লিভার বা যকৃতের ক্ষতিসাধন হতে পারে।
৩. নিম্ন রক্তচাপ
রক্তচাপ কমাতে এর উপকার সম্পর্কে জেনেছেন। কিন্তু অতিরিক্ত দারুচিনি খেলে রক্তচাপ কমতে কমতে অস্বাভাবিকভাবে কমে গিয়ে নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৪. ক্যান্সার
দারুচিনিতে থাকা 'কমারিন' উপাদানটি অতিমাত্রায় গ্রহণের ফলে শুধু লিভারের নয়, আরও বড় বড় ক্ষতিও করতে পারে। ক্যান্সারের জন্যও এই অতিমাত্রার কমারিন দায়ী।
৫. শ্বাসকার্যে সমস্যা
যে পরিমাণ ঝাল থাকে তা বেশি খেলে শ্বাসকার্যের সমস্যা তৈরি করতে পারে। একনাগাড়ে শুকনো কাশি, শ্বাস ধরে রাখতে না পারার সমস্যা হতে পারে। শুকনো (ক্যাসিয়া জাতের) দারুচিনি বেশি খেলে ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। ফুসফুসকে সংক্রমিত করে শ্বাসকার্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যদি এমতাবস্থায় ফুসফুসের চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে স্থায়ীভাবে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৬. কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
কমারিন সহ আরও কিছু উপাদান থাকায় দারুচিনি অতিমাত্রায় গ্রহণ করলে তা আপনার সেবন করতে থাকা কোনো ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কেউ যদি ডায়াবেটিস, হার্টের জন্য ও লিভারের কোনো ঔষধ সেবন করে, তখন সে বেশিমাত্রায় দারুচিনি খাওয়ার ফলে সেসব রোগের ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ঔষধের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
দিনে কতটুকু দারুচিনি খাওয়া স্বাভাবিক
কতটুকু খেতে হয় তা জানার আগে দারুচিনির জাত সম্পর্কে জানতে হবে। একাধিক জাতের দারুচিনি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে 'ক্যাসিয়া' ও 'সেইলন' মূল দু'টি জাত।
ক্যাসিয়া হচ্ছে যেটা সচরাচর ও বেশি দেখতে পাওয়া যায় এবং দামে সস্তা হওয়ায় তা ব্যবহার করা হয় বেশি। এই জাতের দারুচিনি বেশি কড়া ঝালযুক্ত হয়।
অপর জাত অর্থাৎ 'সেইলন' হচ্ছে সত্যিকারের ও আসল দারুচিনি। এটা সচরাচর সবাই ব্যবহার করে না। দামও কিছুটা বেশি। এর স্বাদ ক্যাসিয়া'র মতো অতটা কড়া ঝাল নয়।
এটা সবচেয়ে নিরাপদ।
যতটুকু খাওয়া স্বাভাবিক :
সেইলন বেশি নিরাপদ হওয়ায় এটা দিনে ২ চামচের বেশি খেলেও ক্ষতি নেই। তবে ৩/৪ চামচের বেশি না খাওয়াই ভালো।
আর যেটা ক্ষতিকর, সেটা হলো ক্যাসিয়া জাতের দারুচিনি। নিয়মিত ও সচরাচর যে দারুচিনি ব্যবহার করে মানুষ। এটাই ক্ষতিকারক বেশি।
এটা দিনে ১ গ্রাম থেকে ৬ গ্রাম খাওয়া নিরাপদ ধরা হয়। কমারিন থাকায় এই জাতের দারুচিনি দিনে ১ চা-চামচ এর বেশি গ্রহণ করা উচিত নয়। ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষের দিনে ৫ গ্রামের বেশি দারুচিনি নেওয়া ঠিক হবে না।
দারুচিনির উপকারিতার পাশাপাশি দারুচিনি খাওয়ার অপকারিতা রয়েছে। ক্ষতি এড়াতে হলে এটা নির্দিষ্ট ও নিরাপদ পরিমাণে খেতে হবে।