ডায়াবেটিস এর আগাম সতর্ক সংকেত

ডায়াবেটিস এর আগাম সতর্ক সংকেত


ডায়াবেটিস হলো মারাত্মক যত রোগ আছে সেগুলোর তালিকায় উপরের দিকে থাকা এক রোগ। জীবনের যেকোনো দশায় যেকেউই ডায়াবেটিসের শিকার হতে পারে। ডায়াবেটিস হুট করেই আসে না। কিছু কারণের জন্য ডায়াবেটিসের সমস্যা হয় এবং ডায়াবেটিস এর আগাম সতর্ক সংকেত পাওয়া যায়।

 

কেন ডায়াবেটিস হয়?

ডায়াবেটিস হওয়াতে মানুষের জীবন যাপিত করার কিছু কারণ জড়িত। যেগুলো মানুষ জেনে, না জেনেই করছে এবং যার ফলে ডায়াবেটিস দেহে বাসা বাঁধতে শুরু করে। বছর বছর অসংখ্য মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। 

শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি, পরিশ্রম না করা, ওজন বেড়ে গিয়ে অতিস্থুলতা, সঠিক ও স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন না করা, খাবার-দাবার নিয়ে সচেতন না থাকা এই কারণগুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

সঠিক চিকিৎসা আর নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে মরণঘাতী এই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। প্রকারভেদে সম্পূর্ণরুপে প্রতিকারও করা সম্ভব।
 

ডায়াবেটিস এর ক্ষতি 

দীর্ঘ স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে ডায়াবেটিস। এটি হলে রোগীর শরীরের পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে, রক্তে শর্করা গ্লুকোজ বেড়ে গিয়ে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি করে। 

রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা কমে গেলে সহজেই অন্যান্য রোগব্যাধি আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা উচ্চ রক্ত চাপ, হার্ট অ্যাটাকজনিত ও কিডনির বড় ধরণের রোগেও পড়ে।

প্রকারভেদ 

ডায়াবেটিসের দুইটি প্রকার রয়েছে। 
টাইপ-১ ডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। 

টাইপ-১ ডায়াবেটিসটি সাধারণত কমবয়সীদের মাঝে দেখা দিয়ে থাকে এবং সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মকানুন মেনে চললে এটা প্রতিকার করা সম্ভব। 

টাইপ-২ ডায়াবেটিসটি বয়স্ক বিশেষ করে মধ্য বয়সের পর থেকে শুরু হয়। এটা ডায়াবেটিসের সবচেয়ে কঠিন ধরণ। এর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয় অনেকদিন। এই স্টেজে আসলে ডায়াবেটিস প্রকট হয়ে ওঠে।

এটি হওয়ার বয়স

শিশুরাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। প্রতি মাসে হাসপাতালগুলোতে কয়েকশো শিশু ডায়াবেটিস রোগী আসে। রোগটি বংশগতভাবে হওয়ায় যেকোনো বয়সী কেউ এটার শিকার হতে পারে যদি সঠিক জীবন-যাপনে না চলে।


ডায়াবেটিস এর আগাম সতর্ক সংকেত 


কিছু অভ্যাসের কারণে যেহেতু ডায়াবেটিসের সূত্রপাত হতে থাকে, তখন কিছু আগাম সতর্ক সংকেত পাওয়া যায় এটা পুরোপুরি হওয়ার আগে। সেই সংকেত, লক্ষণগুলো উপলব্ধি করা মাত্র যদি সতর্ক হওয়া যায়, তাহলে ডায়াবেটিস হওয়া থামানো যাবে।

ডায়াবেটিস এর আগাম সতর্ক সংকেত :

১. ঘনঘন প্রস্রাব : রক্তে শর্করা তথা সুগারের পরিমাণ বাড়লে ঘনঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা হয়। বেশিরভাগ রাতে এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশিবার মূত্র ত্যাগ করার অনুভূতি জাগে এরকম হলে।

ডায়াবেটিস যখন কিডনিকে বাড়তি চাপে ফেলে রক্ত থেকে সুগার বা গ্লুকোজ অপসারণের জন্য, তখন কিডনি বাড়তি চাপ নিতে পারে না। ফলে ঘনঘন প্রস্রাব সমস্যার উদ্ভব হয়।


২. মূত্রনালীতে সংক্রমণ : অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের না হতে পেরে তা কিডনি, মূত্রথলি ও মূত্রনালীর উপর চাপের সৃষ্টি করলে তখন মূত্রথলি ও মূত্রনালীর বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দেয়। মহিলাদের মধ্যে ডায়াবেটিস হলে মূত্রনালীর সংক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। 

অনিয়মিত মাসিকের ঘটনা, ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন ইত্যাদি সমস্যা গুলো ডায়াবেটিসের আগাম লক্ষণ।

৩. অতিরিক্ত পিপাসা : ঘনঘন প্রস্রাব হওয়ায় শরীরে পানিস্বল্পতার সমস্যার সৃষ্টি করে। এর কারণে প্রচুর পানির পিপাসা লাগে এবং একটু পরপরই সেই পিপাসা জাগে।

৪. অতিরিক্ত ক্ষুধা : আপনি যে খাবারই খান না কেন, খাওয়ার পর তা শরীরের অভ্যন্তরস্থ ক্রিয়াবিক্রিয়ায় গ্লুকোজ, শর্করায় রুপান্তরিত হয়। এবং তা থেকে আপনি পর্যাপ্ত শক্তি পান। কিন্তু ডায়াবেটিসের ঘটনা ঘটলে অভ্যন্তরস্থ কোষগুলো গ্লুকোজকে সঠিকভাবে শোষিত করে শক্তিতে রুপান্তর করতে পারে না।

শক্তিতে রুপান্তর না হওয়ায় শরীরও পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। তখন শুধু খাবার হজমই হয়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। কাজ না হওয়ায়, শক্তি না পাওয়ায় খাবারগুলো বেশিক্ষণ ক্ষুধা মিটিয়ে রাখতে পারে না। কারণ বেশিক্ষণ ক্ষুধা ধরে রাখার শক্তি থাকেনা। তখন ঘনঘন ও অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগে। এমনকি খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবার ক্ষুধা লাগে। 

৫. অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমা : খাবার থেকে শক্তি না পাওয়ায় তখন শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশি ও চর্বি স্তর গুলো ভাঙতে শুরু করে। মাংসপেশির আর চর্বি স্তরের জন্য মানুষের ওজন কমবেশি হয়ে থাকে। কিন্তু যখন ডায়াবেটিসের কারণে এগুলো ভাঙতে শুরু করে ও ভেঙে যায়, তখন ওজন আর স্বাভাবিক থাকে না।

৬. অবসাদ, দূর্বলতা : পর্যাপ্ত শক্তি ও জ্বালানি না পাওয়ায় সারাদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম গুলোও করার মতো শক্তি সামর্থ্য থাকে না। সবসময় অবসাদ আর দূর্বলতা তখন লেগেই থাকে।


৭. দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন : অতিরিক্ত গ্লুকোজ এর কারণে চোখের সাথে সংযুক্ত রক্তের শিরাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা দেখা যায়। চিকিৎসা না করালে এই সমস্যা পরবর্তীতে চোখের ব্যাপক ক্ষতি করে। 

৮. রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা : ডায়াবেটিস এর কারণে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তা কমে যায়। প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হওয়া ও কমে যাওয়ায় অন্যান্য রোগও সহজে বাসা বাঁধতে পারে। কোথাও কেটে গেলে সেই কাটা স্থান, ক্ষত, ঘা শুকাতে ও ভালো হতে দেরি হয়। শ্বেত রক্তকণিকা সঠিক থাকতে পারে না। 

৯. কোনো অঙ্গে অসাড়তা, অচল হওয়া : রক্ত চলাচল ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ায় ও বিভিন্ন স্নায়ুকোষের ক্ষতি হওয়ায় শরীরের কোনো কোনো অঙ্গে ব্যথা হয়, আবার কোনো অঙ্গ নড়াচড়া করা যায় না, অসাড় ও অচল অবস্থার মতো লাগে। হাত ও পায়ে এরকম অচল, অসাড়তা ও অবশ হওয়ার মতো অনুভূতি হয় বেশি।

১০. চামড়া, ত্বক কুঁকড়ে যাওয়া : ইনসুলিন আধিক্যের কারণে গাঢ় বর্ণের প্যাচের মতো ত্বকের কোথাও চামড়া দলা বেঁধে কুঁকড়ে যায়। ত্বক অতি শুষ্ক হয়ে যায়। 


১১. মাড়ি ও দাঁত : গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়ায় মুখের মাড়ি ও দাঁত এর বিভিন্ন সমস্যার তৈরি করে। মুখে লালা কমে যাওয়া, লালা না থাকা, মাড়ি ফোলা, ব্যথা, রক্ত ও পুঁজ হওয়া, দাঁতের ব্যথা ও ক্ষয় হতে থাকে।

অন্যান্য সংকেত


মুখের গন্ধ ফলের মতো হওয়া, সর্দি-কাশির ন্যায় কিছু উপসর্গ অনেকদিন ধরে লেগে থাকা, মাঝেমাঝেই বমি হওয়া, শ্বাসকষ্ট এই রকম লক্ষণগুলোও থাকে।

উপরিউক্ত সংকেত ও লক্ষণগুলো সবগুলো একসাথে হয় না। এর কোনোটি যদি অস্বাভাবিকভাবে উপলব্ধি হয়, তাহলে যত সম্ভব হয় ডাক্তারকে দেখিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। পরে নিয়মমাফিক জীবন-যাপন করতে হবে।


শেষ কথা

ডায়াবেটিস এর আগাম সংকেত ও লক্ষণ দেখে আগে থেকে সতর্ক হলে ভয়ংকর হয়ে ওঠা এই রোগটিকে প্রতিরোধ এবং একে প্রতিকার করা সম্ভব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url