কিটো ডায়েট চার্ট : নিয়ম, খাবার, সুবিধা ও অসুবিধা
কিটো ডায়েট সাম্প্রতিক সময় ধরে ওজন কমানোর জন্য খুবই কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হওয়ায়, দিনদিন এটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সারাবিশ্বে। কিটো ডায়েট চার্ট কেমন হওয়া উচিত, এই ডায়েটের সুবিধা ও অসুবিধা, কোন খাদ্য গুলো এই ডায়েটে রাখা ভালো এই বিষয়সমূহ নিয়েই জানুন এই লেখাতে।
কিটো ডায়েট ও এর মানদণ্ড
কিটো ডায়েট শুরুতে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য এই ডায়েট পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো রোগীদের। পরবর্তীতে ওজন কমাতে এই ডায়েট পদ্ধতির আশানুরূপ ফলাফল দেখে এটাকে বর্তমান সময়ে ওজন কমানোর জন্যই বেশি গ্রহণ করা হয়।
কিটো ডায়েট হলো খাদ্য তালিকায় কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার একেবারেই কমিয়ে এনে ফ্যাট ও প্রোটিন বাড়িয়ে রাখা। যেমন ধরুন, আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত, যা একটি কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। প্রতিদিন কয়েক প্লেট ভাত খেয়ে থাকে এদেশের প্রতিটি মানুষ। দিনে কমপক্ষে কয়েকশো গ্রাম ভাত খেয়ে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে।
কিটো ডায়েট করলে এই অভ্যাস মানে খাবারের ধরণটি বাদ দিতে হবে। সর্বোচ্চ ৫০ গ্রামেরও কম পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট বা ভাত খেতে হবে। আর ফ্যাট ও প্রোটিনের খাবারের পরিমাণ কার্বোহাইড্রেটের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে খেতে হবে। এই পদ্ধতিতে খাওয়াকেই কিটো ডায়েট বলে।
একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বলি,
আপনি সারাদিন ১০০ গ্রাম ক্যালরির খাবার খেলেন। এই ১০০ গ্রামের মধ্যে ৫ শতাংশ বা ৫ গ্রাম ক্যালরি নিতে হবে ভাত ও এরকম কার্বোহাইড্রেট থেকে। সেখানে ৭৫ শতাংশ বা ৭৫ গ্রাম নিতে হবে ফ্যাট (চর্বি) সমৃদ্ধ খাবার থেকে। আর ২০ শতাংশ বা ২০ গ্রাম নিতে হবে প্রোটিন থেকে।
অথবা ১০ শতাংশ নিতে হবে কার্বোহাইড্রেট থেকে, ৩০ শতাংশ নিতে হবে প্রোটিন থেকে, ৬০ শতাংশ ফ্যাট থেকে।
এই শতকরার হিসাবেই কিটো ডায়েটের মানদণ্ড ধরা হয়।
যেখানে আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত ৫০ শতাংশ নেয় কার্বোহাইড্রেট (ভাত) থেকে, ২০-৩০ শতাংশ নিয়ে থাকে ফ্যাট থেকে, প্রোটিন থেকেও ২০-৩০ শতাংশ নিয়ে থাকে। যে পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট নিচ্ছে, প্রোটিন আর ফ্যাট দু'টি মিলিয়ে কার্বোহাইড্রেটের সমপরিমাণ নেয়।
এই যে, খাবারে কার্বোহাইড্রেট সাধারণ ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ৫-১০ শতাংশ নিয়ে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে যে ডায়েট পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, সেটাই কিটো ডায়েট।
আমাদের দেশসহ ভারত উপমহাদেশের অনেক দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত বা কার্বোহাইড্রেট। তাই এই ডায়েট এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কঠিন ও কষ্টসাধ্য। তবে বাড়তি ওজন কমিয়ে ফিট হওয়ার জন্য এই কঠিন ডায়েটকেই আজকাল মানুষ বেছে নিচ্ছে, বিশেষ করে মেয়েরা।
কিটো ডায়েট কীভাবে ওজন কমায়?
শরীরে বাড়তি ওজনের জন্য দায়ী কার্বোহাইড্রেট। দেহে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া বিক্রিয়া চলে। যত খাবার খাওয়া হয়, সেগুলো সেই ক্রিয়া-বিক্রিয়ার জ্বালানি জোগায়। দেহের সেসব কাজে সকল খাদ্য উপাদান সহজে ভেঙে জ্বালানিতে পরিণত হলেও কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার সহজে ভাঙে না। না ভাঙার দরুন তা দেহে জমা হতে থাকে। জমা হয়ে পরে তা বাড়তি স্তর সৃষ্টি করে ফলে ওজন বাড়ে।
এই লিংকে গিয়ে জেনে নিন আমাদের ওজন বাড়ার কারণ।
কার্বোহাইড্রেট জমা হয়ে যেন এই সমস্যার সৃষ্টি না করে তারজন্য কিটো ডায়েট। কারণ, এই ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট অতিমাত্রায় কম রাখা হয় বিধায় তা দেহে ভাঙতে সময় কম লাগে।
ডায়েট পদ্ধতিটি নিয়মিত মেনে চলার ২-৭ দিনের মধ্যে দেহ 'কিটোসিস' নামক পর্যায়ে চলে যায়। এই পর্যায়ে গেলে দেহ কার্বোহাইড্রেটকে পোড়াতে শুরু করে। কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম থাকলে সহজেই তা পুড়তে পারে। পুড়ে যাওয়ায় তা দেহে জমা থাকে না। তারপর অন্য জ্বালানি পুড়ানো শুরু করে।
এই ডায়েটে ফ্যাট (চর্বি) বেশি রাখার কারণ হলো ফ্যাট সহজে ভেঙে যায়, ফলে আমাদের দেহ ফ্যাটকে সহজে পুড়িয়ে শক্তি ও তাপ উৎপন্ন করতে পারে। এভাবে সকল জ্বালানি পুড়ে যায় ও দেহ তার জন্য শক্তি উৎপন্ন করে।
সব পুড়ে যাওয়ার পর আর কোনো কিছু জমা থাকে না, তখন ওজনও জমতে অর্থাৎ বাড়তে পারে না।
কার্বোহাইড্রেটকে সহজে ভাঙা ও পুড়ানোর জন্যই এই ডায়েট।
এভাবেই কিটো ডায়েটে সহজেই ওজন কমিয়ে আনা যায়। তাই এটি জনপ্রিয়তার তালিকায় রয়েছে।
কিটো ডায়েট এর কয়টি পদ্ধতি?
প্রকৃতপক্ষে ৪ টি পদ্ধতিতে এই ডায়েট পরিকল্পনা নেওয়া হয়ে থাকে।
১. প্রথম হলো স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি। এটিই ডায়েটটির আসল মানদণ্ড। এটি কীভাবে করতে হয় তার নিয়ম ও মানদণ্ড উপরেই বলা হয়েছে।
২. সাইক্লিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সপ্তাহে একদিন অথবা দুইদিন কার্বোহাইড্রেট বেশি খেতে পারবে। ৫০ গ্রামের পরিবর্তে সেই একদিন অথবা দুইদিন ১৫০ গ্রামের মতো কার্বোহাইড্রেট খেতে পারবে। এটি খেলোয়াড়েরা প্রায়ই মেনে চলে।
৩. টার্গেটেড বা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পদ্ধতি। এটা হচ্ছে যখন বা যেদিন হার্ডওয়ার্ক, ভারী পরিশ্রম, ব্যায়াম করতে হবে, তখন পরিশ্রম ও ব্যায়ামের পরিমাণমতো কার্বোহাইড্রেট খেতে পারবে। যেহেতু ভারী কাজ, ব্যায়াম করলে অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরে, সেহেতু কার্বোহাইড্রেট না থাকলে শক্তি পাওয়া যাবে না কাজ করার। তাই পরিশ্রমের ধরণ ও মাত্রা অনুযায়ী সেদিন কার্বোহাইড্রেট নিবে।
ভারী কাজ, ব্যায়াম শুরুর আধঘণ্টা আগে ৩০ গ্রাম, শেষ করে ৩০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট। এভাবেই সাধারণত নেওয়া হয় এই পদ্ধতিতে।
৪. নিরামিষ ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন পদ্ধতি।ভেগান /নিরামিষভোজীরা প্রাণীজ আমিষ (প্রোটিন) খায় না, তাই তাদের জন্য কিটোর এই পদ্ধতি। এতে নিরামিষভোজীরা প্রাণী থেকে পাওয়া প্রোটিনের পরিবর্তে অন্যান্য উৎস থেকে প্রোটিন নিতে পারবে।
আর উচ্চ মাত্রার প্রোটিন পদ্ধতিতে শুধু প্রোটিনের পরিমাণ বাড়বে। প্রোটিন নেওয়ার মানদণ্ড ২০-৩০ শতাংশের বদলে ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত নিতে পারবে।
কিটো ডায়েট চার্ট
যা যাবে
যেকোনো প্রাণীজ আমিষ
গরুর মাংস, মহিষের মাংস, ছাগলের মাংস। তবে এগুলো চর্বি ছাড়িয়ে, চর্বি ছাড়া খেতে হবে।
মুরগির মাংস, ডিম। সপ্তাহে দুইদিনের বেশি প্রাণীজ আমিষ না নেওয়া ভালো।
যেকোনো মাছ
সামুদ্রিক মাছ হলে বেশি ভালো। স্যামন, টুনার মতো সামুদ্রিক মাছ। অন্য মাছও খাওয়া যাবে।
সবধরণের শাকসবজি
লালশাক, পালংশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, পাটশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, ব্রকোলি, অ্যাভোকাডো, কুমড়া, লাউ, সজনেডাঁটা ইত্যাদি সহ বিভিন্ন সিজনাল শাকসবজি।
তেল
সয়াবিন বাদ দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর তেল যেমন অলিভ বা জলপাইয়ের তেল, সরিষা ও নারিকেল তেল, অ্যাভোকাডোর তেল সবচেয়ে ভালো।
অন্যান্য
বাদাম, টফু, বাদামের দুধ, ক্রিম, দই, ঘি, বাটার।
যা যাবে না
- আলু সহ আরও যেসকল সবজি মাটির নিচে জন্মায়, সেগুলো কিটো ডায়েটের সময় খাওয়া যাবে না। কারণ মাটির নিচে জন্মানো সবজিতে কার্বোহাইড্রেট থাকে।
- মিষ্টিযুক্ত, চিনিযুক্ত খাবার ও খাবারের আইটেম এসময় খাওয়া যাবে না।
- ভাত, রুটি, পরোটা, নুডলস ও অন্যসব অধিকমাত্রায় কার্বযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে।
- ফলমূল খাওয়া যাবে না। ফলমূলে সুগার ও শর্করা থাকে। অ্যাভোকাডোকে সবজি হিসেবেই ধরা হয়, তাই এটা যাবে।
- ডালজাতীয় খাবারও খাওয়া যাবে না।
কিটো ডায়েট এর সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা
- বড় যে সুবিধা সেটা তো উপরে জানলেনই। সেটা হলো ওজন কমানো। কম সময়ের মধ্যেই কিটো ডায়েট করে ওয়েট লস করা যায়।
- অতিরিক্ত ফ্যাট জমা না হওয়ায় শরীরের বিভিন্ন জায়গা যেমন, পিঠ, কোমর, পেটের মেদ কমে যায়।
- প্রোটিন ও ফ্যাট বেশি করে খাওয়ায় খিদের মাত্রা কম থাকে।
- ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত রাখা যায়।
- যাদের PCOS এর সমস্যা আছে, তারা এই ডায়েট থেকে উপকার পায়।
অসুবিধা
- মানদণ্ড অনুযায়ী নিয়মে না করলে, রুটিনে এলোমেলো হলে মাথাব্যথা, মাথাঘোরানো, খিদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, ঘুৃমে ব্যাঘাত, ক্লান্তিবোধ হয়। তবে এটা স্বাভাবিক ও প্রতিদিনের করা ডায়েট থেকে হুট করে কিটোতে গেলে প্রথম কয়দিন এরকম হয়ে থাকে।
- পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা না পেলে দেহ প্রয়োজনীয় তাপ ও শক্তি উৎপন্ন করতে পারবে না। ফলে ভারী কোনো কাজ করতে কষ্ট হবে।
- মাটিতে উৎপাদিত শস্য, সবজি, ফলমূল না খেলে শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি ও খনিজ পাবে না। এসব খাবার থেকে আঁশ পাওয়া যায় তা খুবই প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। আঁশযুক্ত খাবারের ঘাটতি হলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও হজমক্রিয়ার সমস্যা দেখা দিবে।
- নিরামিষ ও উদ্ভিদভোজীদের জন্য অনেক কষ্টকর হয়। কারণ তারা আমিষ খায় না।
- কার্বোহাইড্রেট শরীরে পানি ধরে রাখার কাজ করে। কিটোতে এটা কম গ্রহণ করা হয়, ফলে শরীরে পানি দ্রুত বের হয়ে যাবে ও পানিশূন্যতা হবে।
- ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকায় হার্টের অস্বাভাবিকতা হতে পারে, কিডনিতে প্রভাব পড়ে, ডায়রিয়া, চুলপড়ার প্রবণতা বাড়তে পারে, ত্বকের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কিছু সাজেশন
আপনার শারীরিক অবস্থা, গঠন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই এই ডায়েট পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। ভালো ফলাফল পেতে অন্ততপক্ষে ১ মাস এটি চালিয়ে যেতে হবে। ৩-৪ মাসের অধিক সময় ধরে এটি করা উচিত নয়।
ধৈর্য্য নিয়ে চালিয়ে যেতে না পারলে, অসুস্থ হয়ে পড়লে এটা না করাই ভালো।
আপনি প্রতিদিন কী পরিমাণ খাবার ও ক্যালরি গ্রহণ করছেন সেই হিসাব করে উপরে দেওয়া কিটো ডায়েট এর পার্সেন্টেজ মোতাবেক ডায়েট চার্ট তৈরি করবেন। নিজে না পারলে কোনো ডায়েেট বিশেষজ্ঞ থেকে পরামর্শ নিয়ে চার্ট তৈরি করুন।