মাসিক না হওয়ার উপযুক্ত কারণ
মাসিক হওয়া প্রতিটি কিশোরী থেকে মধ্য বয়সী নারীর সুস্থতার বহিঃপ্রকাশ করে। কোনো কারণে মাসিক না হওয়া নারীর অসুস্থতা ও অন্য কোনো কারণ হতে পারে। নিয়মিত মাসিক না হলে প্রতিটি নারীই দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করে। কিন্তু কেন অনিয়মিত পিরিয়ড হচ্ছে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান সবার থাকে না। ফলে মাসিকের কারণে হওয়া বিভিন্ন রোগ, যৌন সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
নিয়মিত মাসিক হওয়া
বয়ঃসন্ধি কালের শুরুতে নির্দিষ্ট বয়স ধরে বললে ১২ বছরের পর থেকেই সকল মেয়েদের মাসিক শুরু হয়ে যায়। আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে কোনো কোনো দেশে মেয়েদের মাসিক শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়, ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু হতে পারে।
আবার কোনো দেশের মেয়েরা বিশেষ করে যেসব দেশে আবহাওয়ায় গরমের হার বেশি ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেশের মেয়েদের ১২ বছরের আগেই মাসিক শুরু হয়ে যায়।
মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতি মাসেই নিয়ম করে একটা নির্দিষ্ট তারিখে অথবা সেই তারিখের আশেপাশের তারিখে এই ঋতুস্রাব চলতে থাকে। যা চলে মেনোপজ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সাধারণত ২২-৩২ দিন পরপর মেয়েদের মাসিক হয়। এই নিয়মে প্রতিমাসে হওয়াকে নিয়মিত মাসিক বলে।
কোনো কারণে যদি এই নিয়ম ও রুটিনে পরিবর্তন হয়, মাসিক কয়েক মাস বন্ধ থাকে তাহলে সেটাকে অনিয়মিত মাসিক অথবা মাসিক না হওয়া বলা হয়।
মাসিক না হওয়ার উপযুক্ত কারণ
বিভিন্ন কারণেই মেয়েদের জরায়ুর প্রতিমাসে চক্র আকারে চলায় ব্যাঘাত হতে পারে। হরমোন, ওজন, বয়স, পানিশূন্যতা, গর্ভাবস্থা, যৌনাঙ্গের কোনো সংক্রমণের জন্য, অতিরিক্ত ডিপ্রেশন, স্ট্রেসের মতো কারণগুলোর জন্য মাসিক না হওয়ার কিংবা অনিয়মিত পিরিয়ড এর সমস্যা হয়ে থাকে।
আবার সময় হওয়ার আগেই মাসিক হওয়া, মাসিক ৭ দিনের বেশি থাকা, বেশি পরিমাণে রক্ত আসা এগুলোও মাসিকের সমস্যা।
উপযুক্ত কারণগুলোর বর্ণনা :
বয়ঃসন্ধিকাল : প্রথম প্রথম মাসিক হলে তখন অনিয়মিত পিরিয়ড এর সমস্যা হতে পারে। প্রথম মাসিক শুরুর পর থেকে প্রথম এক অথবা দুই বছর পর্যন্ত মাসিকের সমস্যা দেখা যেতে পারে কিশোরী মেয়েদের মাঝে। এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। নতুন নতুন সবকিছুই খাপখাইয়ে নিতে কিছুটা সময় নেয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম : সহজে এটাকে PCOS বলা হয়ে থাকে। এটি জরায়ুর আশেপাশের একটি সংক্রমণ। ডিম্বাশয় এর প্রবেশপথে একাধিক ছোট ছোট দলার মতো বস্তু হয় যা ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করে। জরায়ু মুখের সামনে এই বাঁধা হওয়ায় জরায়ু থেকে মাসিক চক্রের রক্ত বের হতে পারে না। ফলে তখন মাসিক বন্ধ থাকে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম - PCOS কেন হয় এবং এটি দূর করার ব্যবস্থা জানতে এটি পড়ুন।
গর্ভে সন্তান আসা : পরিকল্পিত হোক কিংবা অপরিকল্পিত হোক, বেবি কনসিভ অর্থাৎ গর্ভে যদি সন্তান আসে, তাহলে মাসিক বন্ধ থাকে ডেলিভারির পূর্ব পর্যন্ত। এসময় কোনো রোগ বা সমস্যার জন্য মাসিক বন্ধ হয় না। শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠা, শিশুতে পরিণত হওয়া, পৃথিবীতে আসার মতো কাজগুলো জরায়ু ও ডিম্বাশয়ে চলতে থাকে, তাই প্রেগন্যান্সির সময় পিরিয়ড বন্ধ থাকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত।
ব্যাকটেরিয়া : একধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে যা অনিরাপদ যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে যোনিতে প্রবেশ করে। পরে তা জরায়ু ও আশেপাশের অংশে ছড়িয়ে ব্যাকটেরিয়ার বংশবিস্তার করে। এর কারণে জরায়ুমুখ ক্ষতির শিকার হয়। জরায়ু তখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না।
সন্তান জন্মদান, অকাল গর্ভপাত : সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়, অকাল গর্ভপাত ঘটলে, অথবা ইচ্ছাকৃত অকাল গর্ভপাত ঘটালে যোনিপথ ও কাটা স্থান দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে তা জরায়ুর পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার, টিউমার : জরায়ুর পথে একধরণের কোষ থাকে যা বৃদ্ধি পেয়ে টিউমারের মতো হয় এবং জরায়ু পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কোষ বৃদ্ধি পেয়ে সর্বশেষ ধাপে পৌঁছে গেলে তখন ক্যান্সারে পরিণত হয়। এই দু'টির জন্য জরায়ু স্বাভাবিক থাকতে পারে না, তাই জরায়ুতে কোনো কাজও সম্পাদিত হতে পারে না।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল : কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টিন হরমোনের মিশ্রণে তৈরি। পিল অপরিকল্পিত গর্ভধারণ থামাতে কাজ করে। সেসব পিল নিয়মিত ও নিয়মমাফিক সেবন না করলে তা মাসিকে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
ওজনজনিত কারণ : ওজন অতিরিক্ত হওয়াও ভালো নয়, আবার অতি স্বল্প হওয়াও ভালো নয়। ওজনে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মাসিকে অনিয়ম ঘটায়।
ডিপ্রেশন, স্ট্রেস : সবসময় মনমরা, হতাশা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপের মধ্যে অনেকদিন থাকলে তা হরমোনে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করে। যার প্রভাবে মাসিক না হওয়ার সমস্যা হয়।
শারীরিক পরিশ্রম : অতিরিক্ত পরিশ্রম কিংবা ব্যায়ামের কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। তবে এই কারণে সমস্যা হওয়ার হার তেমন নেই।
সর্দি-জ্বর : সর্দিকাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হলে তখন মাসিক হতে দেরি হতে পারে।
হরমোন : হরমোনের অস্বাভাবিকতা মাসিকে ব্যাঘাত ঘটায়। থাইরয়েড হরমোন অতিরিক্ত কমে যাওয়া অথবা বেড়ে যাওয়া, এন্ড্রোজেন হরমোন বাড়তি থাকাও এই সমস্যা ঘটায়।
কিছু মেডিসিন : অধিকমাত্রায় স্টেরয়েডযুক্ত মেডিসিন সবার স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। মেয়েদের মাসিকের ক্ষেত্রেও এধরণের মেডিসিন বাঁধা সৃষ্টি করে।
চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া : কারও ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন এর মতো চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে পরবর্তীতে সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মাসিক বন্ধ থাকে।
পানিশূন্যতা : পানি দেহের সকল ক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে। দেহে যদি পানিশূন্যতা হয়, দেহের অন্যতম একটি ক্রিয়া হচ্ছে মাসিক, তাহলে তখন তা মাসিকের ক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা আনতে পারে।
মেনোপজ : ৪৫ বছরের পর থেকে নারীদের মেনোপজের সময়কাল শুরু হয়। মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে মাসিকের অনিয়ম দেখা যায়।
কীভাবে জানবেন মাসিকের সমস্যা আছে?
যখন কারও মাসিকে বাঁধা সৃষ্টি হয়, সমস্যা হয় তখন কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেগুলো দেখে বুঝতে পারা যায় যে তার মাসিকের সমস্যা আছে।
সেই উপসর্গগুলো :
- মাসিকের সমস্যা বোঝার সহজ উপসর্গ হচ্ছে মাসিক না হওয়া, দেরিতে হওয়া। যদি দেখা যায় গতমাসের মাসিক হলেও পরের মাসে হচ্ছে না, তারপরের মাসেও হচ্ছে না। এভাবে পরপর টানা ৩ মাস যদি মাসিক না হয়, তাহলে বুঝতে হবে মাসিকে গণ্ডগোল আছে।
- স্তনের আকার ফুলতে থাকা ও স্তন ভারী হয়ে ওঠা।
- ঘন ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদাস্রাব।
- মাসিকের সময় হওয়ার আগেই শুরু হওয়া, ৭ দিনেরও বেশি সময় ধরে মাসিক থাকা, রক্তপাতের পরিমাণ অনেক বেশি হয় যে ১/২ ঘণ্টা পরপর প্যাড চেঞ্জ করতে হয়, রক্তের চাকা বড় বড় আসা।
- ঘনঘন মেজাজ পরিবর্তন।
- মুখমণ্ডলে ব্রণ ওঠা।
- পুরুষদের মতো শরীরের সর্বত্র লোম হওয়া, গোঁফ হওয়া।
- পিরিয়ড রক্তের রঙ পরিবর্তন। রঙিন লেখায় ক্লিক করে পিরিয়ডের রঙ সম্পর্কে জানুন।
- তলপেট ও যৌনাঙ্গে অসহনীয় পর্যায়ের ব্যথা।
- জ্বর।
এগুলো যদি দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা হয়েছে।
মাসিকের সমস্যা দূর করা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজে থেকেই ২-৩ মাসের বিরতির পর আবসর মাসিক হওয়া শুরু করে। কিছুক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নিতে হয় মাসিকের সমস্যা দূর করার জন্য।
যে ব্যবস্থাগুলো নিতে হবে :
- দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ কমাতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ ও ফুরফুরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
- ওজন বেশি থাকলে কমিয়ে আনতে হবে। অতিরিক্ত কম থাকলে ওজন কিছুটা বাড়িয়ে স্বাভাবিক ওজন রাখতে হবে।
- পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি গ্রহণ করতে হবে।
- স্টেরয়েডযুক্ত ও বিভিন্ন ব্যথানাশক মেডিসিনের সেবন কমানো।
- প্রতিদিন হালকা পরিশ্রম, ব্যায়াম।
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের পরিবর্তন। তবে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিতে হবে।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
- যৌন কোনো সংক্রমণ, মাসিক সম্পর্কিত কোনো উপসর্গ ও পরিবর্তন দেখা গেলে অভিজ্ঞ গাইনি ডাক্তারের কাছে যাওয়া।
মাসিক এর সময় কষ্ট হলেও যতটা না চিন্তা হয়, মাসিক না হওয়া তারচেয়ে বেশি চিন্তায় ফেলে দেয় মেয়েদের। সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকে এর কারণ ধরতে পারে না যার দরুন চিকিৎসাও সম্ভব হয় না। যদি সচেতন থাকা যায়, তাহলেই মাসিক বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা দূর করা সহজ হবে।