নিজেকে নিয়ে যত্নবান হওয়ার টিপস, নিজেকে ভালোবাসুন

নিজেকে নিয়ে যত্নবান হওয়া


নিজেকে নিয়ে যত্নবান না হলে নিজের চাপ কমানোর জন্য দুনিয়ার যত উপায়ই প্রয়োগ করেন না কেন, কোনো লাভ হবে না। আগে নিজের যত্ন নিতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। নিজের যত্ন না নিলে তো সুস্থ-ই থাকা যায় না, তাহলে অন্য কোনো কিছু করবে কীভাবে? তাই সবকিছুর আগে প্রয়োজন নিজেকে নিয়ে যত্নবান হওয়া, নিজেকে ভালোবাসা



নিজেকে নিয়ে যত্নবান হওয়া মানে কী?


আরাম-আয়েশ করে থাকাকেই নিজের যত্ন বলে না। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানে হলো নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, খাবার, সামাজিক, ধর্মীয় ও আত্মিক ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া। একজন মানুষের সুস্থতাও নির্ভর করে এই বিষয়গুলোর উপর। এমনকি এই বিষয়গুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োগের মাধ্যমে কেউ হয়ে ওঠে উন্নত পারসোনালিটির, আত্মসম্মানবোধ থাকা মানুষ। আর উন্নত পারসোনালিটি থাকা মানেই মানুষ ও সমাজের কাছে ভালো বিবেক, মানসিকতার বলে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া।

শারীরিক যত্ন মানে শুধু রূপচর্চা, স্কিন কেয়ারিং-ই নয়, শরীর সম্পর্কিত সবকিছুরই যত্ন নেওয়া বোঝায়। শরীরের ভেতর, বাহিরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহের যত্নই হলো শারীরিক যত্ন। 

প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ হয়ে যাচ্ছে অলস, কর্মবিমুখ। ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে হারিয়ে খোঁজে পাওয়া হয়ে গেছে কঠিন। এই কঠিন সময়ের মাঝে নিজেকে খোঁজে পাওয়া, নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া, নিজের পছন্দের কোনো কাজ করা, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য ব্যায়াম করার সময় রাখার কাজগুলোই নিজের যত্ন নেওয়া।

নিজেকে যত্নের মধ্যে রাখা মোটেও সহজ কাজ নয়। এরজন্য প্রয়োজন শ্রম, অধ্যাবসায়, সময়ানুবর্তিতা, মনোবল।

পড়ুন-

নিজের যত্ন নেওয়া কেন দরকারী? 


সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার। তা না হলে জীবন হয়ে যাবে কঠিন, দূর্বিষহ, ভর করবে নানান রোগব্যাধি। 

শুধু নিজের ক্ষেত্রে নয়, পরিবার, আত্মীয়, কাছের মানুষদের সাথেও সম্পর্কের অবনতি হয়।

শরীরের রোগব্যাধি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, স্ট্রেস ও অবসাদ কাটাতে, সহনশীলতা ও আত্মসম্মান উন্নত করতে, আত্মিক ও দৈহিক শান্তি বজায় রাখতে, মানুষের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে, হাসিখুশি থাকতে, দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে নিজের যত্ন নেওয়া খুবই দরকারী।

নিজের যত্ন নেওয়া ব্যতীত কেউই সুস্থ ও সুখী থাকতে পারে না।


কীভাবে বোঝা যাবে নিজের প্রতি যত্নবান নন?


নিজের দিকে তাকান আর নিজেকে জানুন। নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করুন,

  • আপনি যেভাবে দিন শুরু করেন সেটা কি ঠিক হচ্ছে? 
  • আপনার ঘুম কি স্বাভাবিক হয়?
  • হালকা-পাতলা পরিশ্রম, ব্যায়াম করছেন কি?
  • আপনার খাওয়া খাবার কি আসলেই আপনার স্বাস্থ্য উপযোগী? 
  • পরিবার, বন্ধু, কাছের মানুষদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
  • আপনি কি সামাজিক না-কি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত?
  • কী পরিমাণ সময় বাইরের আলো-বাতাসে কাটান আর ঘরে মোবাইল, কম্পিউটার, টিভিতে কাটান?
  • নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আপনি কী করছেন এবং কতটুকু সমসময় দিচ্ছেন?
  • নিজের পছন্দের কোনো কাজ আছে কি? পছন্দের কাজে সময় দেওয়া হয়? কতটুকু সময় দেন?
  • আপনার নিজস্ব ধর্মীয় কাজে কতটা মনোযোগ আছে?
  • নিজের আবেগ যেমন - রাগ, বিরক্তি, হাসি, কান্নার মতো ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন কি?
  • নিজের জীবন নিয়ে নিজেকে মাঝেমধ্যেই কোন প্রশ্ন গুলো আপনি বেশি করেন? জীবন নিয়ে হতাশামূলক প্রশ্ন না-কি তৃপ্তিদায়ক প্রশ্ন? 

এই প্রশ্নগুলোর জবাব যদি সন্তোষজনক না হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিজেকে নিয়ে আপনি যত্নশীল নন।



নিজের যত্ন নেওয়া


নিজেকে নিয়ে যত্নবান হওয়ার টিপস


শারীরিক ও মনের শক্তির অভাব? আত্মসম্মান কম? ব্যক্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত? - নিজেকে নিয়ে এমন হীনমন্যতায় ভোগার হাত থেকে স্বস্তি দিবে নিজের যত্ন নেওয়া। এছাড়া দুনিয়ার আর কোনো উপায়, পদ্ধতি অবলম্বন করেও নিজেকে হীনমন্যতা থেকে সরাতে পারা যাবে না। নিজে ভালো থাকা যাবে না।

কীভাবে সেল্ফ-কেয়ার করবেন অর্থাৎ নিজের যত্ন নিবেন?  তা সহজ কিছু টিপস মানলেই সম্ভব। 

এখানে সেরকম টিপস দেওয়া হলো :

শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, ধর্মীয়, সামাজিক সবদিকের জন্য নিজেকে কীভাবে যত্নশীল হতে হবে সেগুলো একসাথে দেওয়া হলো।


ব্যায়াম ও পরিশ্রম 

প্রতিদিন কমে হলেও ত্রিশ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করা। যদি দৈনন্দিন শারীরিক শ্রমের কাজ করা হয়, তাহলে তো ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই।

সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা 

সকালে ঘুম থেকে ওঠা। এই কাজটি মনকে উৎফুল্ল ও ফ্রেশ রাখে। সকালের হাওয়া স্বাস্থ্যকর। সকালে উঠলে নিজের কাজগুলো করার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। 

খাবার

পুষ্টিকর, স্বাস্থ্য উপযোগী খাবার খাওয়া। হার্ট, ফুসফুস, কিডনি, রক্তচাপ, যকৃত এসবের জন্য ক্ষতিকারী খাবার এড়িয়ে খাওয়া। ফলমূল, শাকসবজি খাওয়া।

ফাস্টিং বা মাঝেমধ্যে উপোস থাকাও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করুন। এটা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

রাতে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। ওজন, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ এসব নিয়ন্ত্রিত রাখতে এটা করা উচিত।

২ লিটার পরিমাণ পানি প্রতিদিন পান করুন।


পরিবার, বন্ধু, কাছের মানুষ 

পরিবারকে সময় দিন। সবার ভালোমন্দ জানুন। পরিবারের যত্ন নিন। একমাত্র পরিবারই সবার প্রকৃত আপন আবাসস্থল। জীবনে অনেক কিছুই ঘটে। সবাই পাশে থাকে না, কাউকে ডাকলেও পাওয়া যাবে না এমন পরিস্থিতিও আসে মানুষের জীবনে। কেউ না থাকলেও, আপনার পরিবার সব পরিস্থিতিতেই আপনার পাশে থাকবে।

১০ টা অদরকারী বন্ধু থাকার চাইতে ১ টা প্রকৃত বন্ধু থাকলেই যথেষ্ট। পরিবার, বন্ধু এরাই কাছের মানুষ। বেশি মানুষের মাঝে নিজেকে না ছড়িয়ে ফেলাই ভালো।


সবার সাথে শেয়ার না করা

নিজেকে মানুষের কাছে বেশি প্রকাশ করতে যাবেন না। যদি করেন তাহলে নিজেই অনেককিছু হারাবেন। ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিজেকে বেশি প্রকাশ আর প্রচার করলে। তখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পেয়ে যাবে মানুষ। তাই নিজের আবেগ, অনুভূতি, সফলতা, ব্যর্থতা, ব্যক্তিগত, পারিবারিক যে বিষয়ই হোকনা কেন, তা মানুষের সাথে শেয়ার না করাই ভালো। 


"না" বলার সাহস থাকা

 "না" বলতে পারা শিখতে হবে। নিজেকে খুব সস্তা বানিয়ে ফেলা যাবে না। সবার সব কথাতে রাজি হয়ে "হ্যাঁ " বলে দিলে আপনাকে সবাই সস্তা মনে করে নিবে। টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে যাবেন। নিজের প্রায়োরিটি আর সক্ষমতার কথা ভাবতে হবে।
আপনি সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, এমন সময় কেউ আপনাকে হয়তোবা কাছের কেউ বললো তার একটি কাজ করে দিতে। আপনি না ভেবেই যদি রাজি হয়ে যান, তাহলে তাতে নিজেরই অযত্ন করা হবে।

আপনাকে সবাই ডাকলে সবসময় আপনি উপস্থিত থাকেন, তাই আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। কোনো পর্যায়ে দেখবেন আপনার দরকারে যদি কাউকে ডাকপন, তাহলে কেউ আপনার ডাকে সাড়া দিবে না। আপনার বিপদে এগিয়ে আসবে না।

তাই ব্যক্তি আর নিজের প্রায়োরিটি বোঝে মানুষকে "না" বলতে শিখুন। তাহলে নিজের আত্মবিশ্বাস ও পারসোনালিটি উন্নত করতে পারবেন।


নিজেকে সময় দেওয়া 

নিজের কোনো শখ পূরণ করার চেষ্টা করুন। ছোট বা বড় যেরকম শখই হোক, চেষ্টা করতে হবে তা পূরণ করার। এতে নিজের মন ভালো থাকবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

নিজের পছন্দের কাজ বাছাই করুন এবং সেটার জন্য সময় রাখুন। বইপড়া, মুভি দেখা, বাগান করা, যে কাজই থাকুক পছন্দের, সেটার জন্য সময় বরাদ্দ রাখা। তাতে মানসিক চাপ কমবে, অবসাদ দূর হবে, একঘেয়েমি কাটবে, প্রফুল্ল থাকা যাবে, সৃজনশীলতা বিকাশ হবে।

দক্ষতা বাড়ানোয় মনোনিবেশ 

দিনের বেশিরভাগ কি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইলেকট্রনিক ডিভাইস এর সাথে কাটে? এটা নিজের প্রতি অযত্নের নিদর্শন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটিয়ে জাগতিক কোনো লাভ হয় কি? যদি না হয়, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত পরিমাণে সময় না কাটিয়ে নিজেকে দক্ষ করে তোলার কাজে সময় দিন।

দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বাড়ানোর কাজে মনোনিবেশ করা মানসিক যত্নের দিক।

লক্ষ্য নির্ধারণ করা 

একসাথে সব কাজ শেষ করতে হবে না। ছোট ছোট স্টেপ নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ করতে লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। তা মনের উপর থেকে চাপ, অবসাদ, দূর্বলতা, ডিপ্রেশন কাটাবে।

রুটিন তৈরি 

চাপমুক্ত থাকার জন্য প্রতিদিনের কর্মপরিকল্পনার রুটিন রাখা উচিত। কাজ, লেখাপড়া, কাছের মানুষদের সময় দেওয়া, ঘুরতে যাওয়া, বাজার করা, ব্যায়াম করা ইত্যাদি কাজের জন্য আলাদা আলাদা করে সময় নির্ধারণ করে রুটিন ফলো করলে শরীর ও মন দুটোরই যত্ন নেওয়া হবে।

বাইরে সময় কাটানো

ঘুরতে যান। এটা নতুন কিছু জানতে ও শিখতে দারুণ এক পন্থা। 

সারাদিন ঘরে বসে না থেকে বাইরে অন্তত কয়েক ঘণ্টা সময় কাটান। বাইরের আলো-বাতাসে গা লাগান। তাতে শরীরের জন্যও উপকার বয়ে আনবে, সাথে মনের জন্যও।

দীর্ঘকালীন রোগব্যাধির নিরাময়ে বাইরের পরিবেশে সময় কাটানো খুবই ভালো একটি উপায়। চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখা, হার্টের যত্ন, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে বাইরের আলো-বাতাস ভালো প্রভাব রাখে।

ঘুম

ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। সুস্থ থাকতে, কাজ করার শক্তি বুস্ট করতে, ব্রেইন ভালো রাখতে, শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে ঘুম অতি প্রয়োজনীয়। বয়স অনুযায়ী সঠিক আর পর্যাপ্ত ঘুমানো সবার জন্য প্রয়োজন। 

চিকিৎসা 

কোনো রোগের জন্য চিকিৎসা নেওয়া ও সময়মতো ঔষধ সেবন করা নিজের যত্ন নেওয়ার  অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চিকিৎসা না নিলে, ঔষধ সেবন না করলে রোগব্যাধি ধীরেধীরে আরও প্রকট হতে থাকে। সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা নিয়ে ঔষধ সেবনের মাধ্যমে রোগব্যাধি প্রতিরোধ ও দূর করা যায়।


উপসংহার

বেঁচে থাকতে সবদিক থেকে নিজেকে সচেতন হতে হয়। নিজের যত্ন নেওয়া সেসব সচেতনতার একটি। তাই নিজের যত্ন নিন, নিজেকে ভালোবাসুন, সঠিক জীবনযাপন করুন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url