সহজেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ১৫ টি উপায়

সহজেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ১৫ টি উপায়


রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ব্যক্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। রাগের সময় বলা কিছু কথা, কিছু কাজ আপনার ব্যক্তিত্বকে কলুষিত করে দিতে পারে। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ করা একজন উত্তম ব্যক্তিত্বের মানুষের পরিচয়। সহজেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় জেনে তা মেনে চললে ব্যক্তিত্বের পথে রাগ বাঁধা হতে পারবে না।

 

রাগ ও মেজাজ

গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন, রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে অনেক সময় ধরে। আপনার কাজের অথবা জায়গায় পৌঁছানোর সময় হয়ে গেছে তবুও জ্যাম ছাড়ছে না, তখন মেজাজের যে রূপটি প্রকাশ হয় সেটাই রাগ।


মেজাজের একটি রূপ হলো রাগ। মেজাজ ঠাণ্ডা, গরম ইত্যাদি প্রকারের হয়। রাগ হলো মেজাজের গরম দিক। রাগ হলো মানুষের মন-মেজাজের সাধারণ একটি অনুভূতি। শুধু মানুষই নয়, পশুপাখিরও রাগ হয়, তারাও রাগ দেখায় নানাভাবে।

কারও সাথে রাগ করে গালাগালি, অশ্লীল কথা, অশালীন আচরণ, জিনিসপত্র ভাঙা, কাউকে আঘাত করা, সহ্য করতে না পেরে কান্না করা - এসব কাজের মাধ্যমে রাগের প্রকাশ করে থাকে। অন্যান্য প্রাণীরাও এরকম কোনো কোনোভাবে রাগকে প্রকাশ করে।

সুতরাং রাগ হলো মেজাজের এক বহিঃপ্রকাশ।


কেন রাগ হয়?

রাগ হওয়ার মতো কিছু হলেই তো রাগ হয়। তাই নয় কি? কারণ ছাড়া তো রাগ হবার কথা না। আবার কিছু মানুষ আছে হুটহাট রেগে যায়, ছোট কিংবা বড় কিংবা তুচ্ছ কারণেও রেগে যাওয়ার অভ্যাস আছে হুটহাট রেগে যাওয়া মানুষের। এদেরকে বলা হয় অতি বদমেজাজি। 

আবার কেউ কেউ আছে শত আঘাতেও রাগ হয় না, উল্টো মুচকি হাসি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এরা হলো রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল মানুষ। এরা ম্যাচুরিটি সম্পন্ন।

যে কারণেই রাগ হোক, কিন্তু রাগটা আসলে কেন হয়?
রাগ হলো আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনেরই একটি অংশ। আবেগ ছাড়া মানুষ হয় না। শুধু মানুষ না, অবুঝ প্রাণীদেরও আবেগ আছে। হতাশা, দুশ্চিন্তা, অবসাদ, ক্লান্তি, বিরক্তি, পছন্দ অপছন্দ জিনিসগুলো রাগের সাথে সম্পৃক্ত। 

একটা জিনিস খুবই বিরক্ত করছে, তখন রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কেউ আপনার পছন্দ অপছন্দের মূল্যায়ন করছে না, তখন রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সবাই।

মস্তিষ্কের কোনো একটি অংশ থেকে যেহেতু আবেগ তৈরি হয়, সেহেতু রাগও সেখান থেকেই উৎপন্ন হয়। রাগের সাথে যে ব্যাপারগুলো সম্পৃক্ততার কথা বললাম, এগুলোর কোনো একটি হলে রাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে। আবার কিছু খাবার আছে যা রাগের সাথে সম্পৃক্ত এই ব্যাপারগুলো বাড়িয়ে দেয় ফলে রাগও বাড়ে।

অতিরিক্ত ম্যাঙ্গানিজ যুক্ত খাবারের কারণে আমাদের দেহে হতাশা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, দূর্বলতা, রাগ হয়। যখন শরীরে এই উপাদানের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন তা কোনোভাবে বের হতে না পেরে রাগ, হতাশা, অবসাদের মতো ব্যাপারগুলোর মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।


সহজেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ১৫ টি উপায় 

রাগ হচ্ছে একজন মানুষের শত্রু। রাগের মাথায় করা কোনো একটি ভুল, কোনো একটি কথা, কোনো কাজ সারাজীবনে জন্য একজন মানুষকে অনুশোচনার মধ্যে রাখতে পারে। সুন্দর স্বভাব গুণের একজন মানুষের চরিত্রে কুৎসিত একটি দিক হয়ে যায় রাগ। তাই রাগকে নিয়ন্ত্রণ রাখা সবার উচিত।

এখানে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ১৫ টি উপায় উল্লেখ করা হলো, যেগুলো কার্যকরী ভাবে রাগকে দমন করতে সাহায্য করবে :

১. আগে ভাবুন

কেন রাগ হয়েছে সেটার কারণ কি আসলেই যুক্তিযুক্ত কি-না, সেই মুহুর্তে রাগ করা উচিত হবে কি-না, সেই জায়গায় রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ হবে কি-না, আপনাকে বুঝতে পারবে কি-না এই বিষয়গুলো ভাবুন। যদি দেখেন যে রাগ করার কোনো মানে হয় না, কেউ আপনাকে বুঝবে না, তাহলে চুপ হয়ে যান।

২. তারপর বলুন

যদি আসলেই রাগ হবার কোনো কারণ থাকে এবং রাগ দেখিয়ে পরিস্থিতি ঠিক রাখা যাবে তাহলে ভেবেচিন্তে কথা বলুন। এমনকিছু বলবেন না যার জন্য পরে পস্তাতে হয়, অনুশোচনায় ভুগতে হয়। তাই ভেবেচিন্তে বলুন আর আচরণ করুন।

যার সাথে রাগ হয়েছে তার সাথে কথা না বলে কাছের মানুষের সাথে রাগের কারণ গুলো বললে হালকা লাগে।

৩. সমাধান খুঁজুন 

রাগ না দেখিয়ে, অন্যকে আঘাত না করে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক মনে হয় সেই যুক্তি আর কথাগুলো সহজভাবে বলে দিন।

৪. গণনা করা 

বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত একটি উপায় হলো যখন রাগ হবে অথবা রাগ হওয়ার উপক্রম হবে, তখন ১ থেকে গুণতে গুণতে ১০০ পর্যন্ত যাওয়া। অথবা ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো করে গণনা করা। এই কাজটি করলে হৃৎস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক হতে থাকবে ও মস্তিষ্ক অন্যদিকে মনোযোগ দিবে। এতে রাগ একেবারেই কমে আসবে।

শব্দ করে গণনা করতে হবে না, মনেমনেই করুন।

৫. মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা

এটি ধর্মীয়ভাবেও বলা হয় যে, যখন রাগ হবে তখন দৃষ্টিকে নিচু রাখতে। অর্থাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা। এটাও প্রমাণিত এক উপায় যা রাগ নিয়ন্ত্রণে আনে।

৬. অবস্থান পরিবর্তন 

রাগের সময় দাঁড়িয়ে থাকলে বসে যেতে বলা হয়, অথবা শুয়ে থাকতেও বলা হয়। এতে মন কিছুটা শান্ত হতে থাকে।

৭. স্থান পরিবর্তন 

যেখানে যার সাথে রাগ হবে কথা না বাড়িয়ে সেই স্থান পরিবর্তন করে নিন। রাগ হওয়ার উপকরণ যেখানে আছে, সেখানে আপনি থাকলে রাগ আরও বাড়তে থাকবে। সেই মুহুর্তে কেউ আরও কথা বলতে আসলে, তর্ক করতে চাইলে ঈশারায় থামিয়ে দিন এবং নিজে সরে যান।

৮. ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিন

বাড়ির বা পরিবারে রাগ হলে নিজের ঘরে এসে পড়ুন। আর নিজের ঘরেই কারও সাথে রাগ হওয়ার উপক্রম হলে তাকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিন। বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারেন। ঘরের কোনো কাজ করার থাকলে, কিছু গোছানোর থাকলে গুছিয়ে ফেলুন। এতে মন হালকা হবে।

৯. গান, ওয়াজ, ইসলামি সঙ্গীত 

কানে ইয়ারফোন, হেডফোন গুঁজে হেটে চলা মানুষ রাস্তাঘাটে অনেক দেখা যায়। এতে বাইরের কোলাহল থেকে বাঁচা যায়। এই কাজটি রাগের সময়ও করতে পারলে মন রিলাক্স হতে পারবে। পছন্দের গান, সঙ্গীত শুনলে মন সহজেই হালকা ও নরম হয়ে যায়। 

১০. পছন্দের কাজ করা

রাগের সময় যত সম্ভব চুপচাপ হয়ে যাওয়াই উত্তম। অযথা তর্কাতর্কি না করে নিজের পছন্দের কাজে মনোনিবেশ করলে অজান্তেই রাগ কমে গিয়ে মেজাজটা ঠাণ্ডা হয়।

১১. সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকবেন না

সোশ্যাল মিডিয়ায় হরেক রকমের মানুষ হরেক রকম টপিক নিয়ে আলোচনা করে, পোস্ট করে। আপনি রাগ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে যদি অপছন্দের বা বিরক্তিকর কোনো টপিক সামনে দেখেন, তখন রাগ কমার বদলে আরও বাড়বে। তাই এই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় না ঢুকলেই ভালো।

১২. লেখা ও পড়া

চুপ হয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে নিজের ডায়েরিতে অথবা মনমতো কোনো জায়গায় নিজের কথা লিখে রাখুন। রাগ কমলে সেগুলো পড়ে দেখুন রাগ হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল।

১৩. হাঁটাহাটি 

মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য এই কাজটি করা যায়। অনবরত হাঁটার ফলে মন অন্যত্র নিবেশ হয়ে যায় ফলে রাগ কমে আসতে থাকে। হাঁটার ফলে কিছুটা ব্যায়াম করাও হলো যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী।

মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য করতে পারেন যোগব্যায়াম, মেডিটেশন। 

১৪. মানিয়ে নিন

নিজের রাগকে প্রকাশ না করে মানিয়ে নেওয়াটাই সবচেয়ে সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত উপায়। মানিয়ে নেওয়ার পর নিজের যুক্তিগুলো, কথাগুলো বুঝিয়ে বলুন। তাতে কারও মনোমালিন্য হবে না।

১৫. ক্ষমা করা

যখন কোনো উপায়ই কাজে লাগছে না, তখন স্মরণ করুন সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ের কথা। ক্ষমা করে দেওয়া হলো সেই গুণ, সেই উপায়। নিজের মধ্যে কারও প্রতি রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের ইচ্ছা না রেখে ক্ষমা করে দিন। তাহলে তর্কে হেরে গেলেও, রাগ দেখাতে না পারলেও আপনিই জয়ী হবেন ও মেজাজ ভালো রাখতে পারবেন।

রাগের ভালোমন্দ 

রাগের কোনো ভালো দিক থাকে না। রাগ হয় আপনার ব্যক্তিত্বকে দূষিত করবে, না হয় অনুশোচনা ও প্রতিশোধের আগুনে পোড়াবে।

কিছু কথা

নিজের কোনো বদঅভ্যাস যেমন- ধুমপান আর নেশাদ্রব্য নেওয়ার অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করুন। কারণ এসব অভ্যাস মেজাজকে আরও খারাপ করে তুলে।

নিজের রাগের কথা অন্যকে বলে লাভ নেই। আপনি কারও জন্য যেমন অনুভব করেন, তারা আপনার মতো করে অনুভব করে না। এখানেই পার্থক্য। তাই মেনে নিয়ে মানিয়ে নেওয়াটাই উচিত। 


শেষকথা 

জীবনের কোনো সময়ে যেন অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, মনে তুষের আগুনে জ্বলতে না হয়, তারজন্য রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। রাগকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url