থাইরয়েড সমস্যা বোঝার লক্ষণগুলো ও প্রতিরোধ

থাইরয়েড সমস্যা বোঝার লক্ষণগুলো


থাইরয়েড সমস্যা বিশেষ করে নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অযত্ন আর অবহেলায় সেই সমস্যা ক্রমশ ক্ষতিকর হয়ে উঠতে থাকে। থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণগুলো না জানার অভাবে থাইরয়েড জনিত রোগটি মারাত্মক হতে থাকে। তাই থাইরয়েড সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য এটার লক্ষণ জানা আবশ্যক।



থাইরয়েড সমস্যা কেন হয়?


আমাদের গলার সামনের অংশে কিছুটা উঁচু একটি গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি রয়েছে, যা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায়। এই উঁচু গ্ল্যান্ডই হলো থাইরয়েড। নারী ও পুরুষ সবারই এমনকি অন্যান্য প্রাণীদের মাঝেও এটা থাকে। এটা ' আদম অ্যাপল / গোটা 'র কিছুটা নিচে থাকে।

গলার এই উঁচু অংশটার কাজ হচ্ছে শরীরের জন্য অতি আবশ্যক ও প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন করা। মস্তিষ্কের ও বিভিন্ন স্নায়ুকোষের পরিপক্বতা দানে, পরিপাকতন্ত্রে পরিপাক, শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে,  শিশুর বুদ্ধির বিকাশে ও বেড়ে ওঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে করার জন্য থাইরয়েড নামক হরমোনটি। 

কোনো কারণে যদি এই হরমোনের হেরফের ঘটলে অর্থাৎ উৎপাদন কমে গেলে কিংবা বেড়ে গেলে তখন থাইরয়েড সমস্যা দেখা দেয়।

বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ, গর্ভকালীন সময়, শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন চাপ, দুশ্চিন্তা, মাত্রাতিরিক্ত ডিপ্রেশন, পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি, অতিরিক্ত আয়োডিন খাওয়া, ডায়াবেটিস থাকা, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি কারণগুলোর জন্যই থাইরয়েড হরমোন ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারে না। করতে না পারায় তখন থাইরয়েড জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়।

থাইরয়েড নামক উঁচু সেই গ্রন্থিটির আকার ও গঠনগত কারণেও এই সমস্যা হয়। আকারে পার্থক্য হলে এই গ্রন্থি ফুলে যায়। এটা ফুলে যাওয়ার দশাকে গলগণ্ড রোগ বলে। এ থেকে টিউমার,  ক্যান্সারও হতে পারে।

এছাড়াও পিটুইটারি গ্রন্থির ও মস্তিষ্কের কোনো অস্বাভাবিকতার কোনো প্রভাবও থাইরয়েডের উপর পড়লে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
 


থাইরয়েড সমস্যার প্রকার সমূহ 


এর মূলত দু'টি প্রকার থাকে। সেই প্রকার নির্ধারণ করা হয় থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের হার বিবেচনা করে। হরমোন কম পরিমাণে উৎপন্ন হলে সেটাকে ' হাইপো থাইরয়েডিজম' বলা হয়। 

আর হরমোনটি বেশি ও অত্যধিক মাত্রায় নিঃসরণ হলে সেটাকে ' হাইপার থাইরয়েডিজম' বলে।



থাইরয়েড সমস্যা বোঝার লক্ষণগুলো


দ্রুতই এর লক্ষ লণ প্রকাশ পায় না। অনেকটা চুপিসারেই এর লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। নীরবে ও দেরিতে প্রকাশ পাওয়ার কারণে এই সমস্যাটি শুরুতেই অনেকে বুঝে উঠতে পারে না। সঠিকভাবে বুঝতে ও উপলব্ধি করতে না পারায় ধীরেধীরে সমস্যা বাড়তে থাকে।

এখানে থাইরয়েডের দুইটি প্রকারের জন্য লক্ষণ গুলো আলাদা আলাদা করে তুলে ধরা হবে।

হাইপো থাইরয়েডিজম এর লক্ষণ

হাইপোথাইরয়েডিজম হলো হরমোনটির নিঃসরণ কম হওয়া। এর জন্য যে সমস্যা ও ক্ষতি গুলো হতে পারে :
  • দেরিতে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হওয়া
  • শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
  • শিশুদের দাঁত পরিপূর্ণভাবে গঠন হতে দেরি
  • জন্ডিস
  • জিভ আকারে বড় হওয়া, তোতলানো 

এটার লক্ষণগুলো :
  • চোখমুখ ফোলা
  • খাওয়ায় অরুচি 
  • ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া 
  • ওজন বৃদ্ধি পাওয়া
  • শীত না থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া
  • চুল পাতলা ও চুল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পড়া
  • উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা (হাই ব্লাড প্রেশার)
  • কোলেস্টেরল বেড়ে ওঠা  
  • মাংসপেশিতে ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
  • সবসময় অবসাদ, দূর্বলতা লেগে থাকা
  • ক্লান্তি বোধ
  • কণ্ঠস্বর মোটা ও কথার আওয়াজ অনেকটা ফ্যাসফ্যাস হওয়ার মতো
  • ঘনঘন কোষ্ঠকাঠিন্যতা
  • হার্টবিট ধীরগতির হওয়া
  • পিরিয়ডের সমস্যা, ঘনঘন অথবা অনিয়মিত হওয়া
  • ক্ষত ও কাটা স্থান শুকাতে দেরি


হাইপারথাইরয়েডিজম এর লক্ষণ

হরমোন নিঃসরণ স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশি অথবা অতিরিক্ত পরিমাণে হলে থাইরয়েডের সেই সমস্যাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে।

এর কারণে 

  • মুখ ও শরীরের ত্বক অতি শুষ্ক হওয়া
  • দাঁত তাড়াতাড়ি ওঠে এবং তাড়াতাড়ি ক্ষয়ও হয়
  • জিভ বড় হয়ে যায় 
  • গ্রন্থিটির আকার পরিবর্তন হয়ে টিউমার ও ক্যান্সারের মারাত্মক দশায় পৌঁছায় 

এর লক্ষণগুলো

  • এটাতেও সবসময় অবসাদগ্রস্ততা ও দূর্বলতা লেগে থাকে
  • স্নায়ুচাপ, অল্পতেই নার্ভাস হয়ে পড়া
  • বিরক্তি ও রাগ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত খিটখিটে মেজাজ
  • নখ ও চুলের ভঙ্গুরতা 
  • চোখের চারপাশ ফোলা
  • হার্টবিট খুব দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত 
  • মাংসপেশির দূর্বলতা ও ব্যথা
  • ওজন হুট করে কমতে থাকা
  • ঘনঘন খিদে লাগা
  • অতিমাত্রায় ঘাম হওয়া
  • ঘুমাতে সমস্যা, ঘুম না হওয়া
  • শরীরে কাঁপুনি

নিজে নিজে থাইরয়েড পরীক্ষা

শরীরের বাহির থেকে দেখা যাওয়ায় থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থা নিজে নিজেই পরীক্ষা করে ধারণা পাওয়া যায় যে কোনো সমস্যা আছে কি-না।

এক গ্লাস পানি আর হাত দিয়ে ধরে রাখা যায় এমন আয়না অর্থাৎ ছোট আয়নার সাহায্যে সহজেই পরীক্ষা করতে পারবেন।

পদ্ধতি হলো :

হাতে আয়না নিয়ে গলার সামনের অংশে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মাথা পেছনে বা মুখ উপরের দিকে তুলে গলা টানটান অবস্থায় রেখে এক গ্লাস পানি খেতে হবে। পানি খাওয়ার পর গেলার সময় যদি গলার থাইরয়েড অংশে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ফুলে উঠতে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে থাইরয়েডের কোনো সমস্যা হয়েছে। পানি একবার খাওয়ার সময় যদি এরকম দেখতে পাওয়া না যায়, তাহলে আরও কয়েকবার পানি খেয়ে এভাবে পরীক্ষা করে দেখুন।

ঢোক গেলার সময় ফোলা হওয়া ছাড়াও গলার আশেপাশে কোনো গোটা দেখা গেলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে।


যারা ঝুঁকিপূর্ণ 


পুরুষদের চাইতে নারীরা থাইরয়েড সমস্যায় বেশি ভোগে। মেনোপজ হয়ে যাওয়া নারীরা এর ঝুঁকিতে বেশি থাকে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে এর জন্য।



থাইরয়েড সমস্যার প্রতিরোধ


বিশ্বের অনেক মানুষই কম বা বেশি থাইরয়েডের সমস্যার শিকার হয়। যেহেতু থাইরয়েড হরমোন সবার শরীরেই থাকে, সেহেতু এটার কার্যকারিতার পার্থক্য যে-কারও মধ্যে হতে পারে।

কিছু কাজ, খাবার, মেডিসিন নিয়মমতো করলে ও মেনে চললে সমস্যাটি প্রতিরোধ করা যায়। 

১. ভিটামিন ডি, ভিটামিন-বি ৬, জিংক, আয়োডিন, প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো খেতে হবে। 

২. শাকসবজি বেশি খাওয়ার চেষ্টা করুন।

৩. বিড়ি, সিগারেট, হুঁকা নেওয়ার মতো ধুমপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করুন। কারণ এগুলোর ধোঁয়া থাইরয়েডের ক্ষতি করে।

৪. অতিরিক্ত মশলাযুক্ত, চিনিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাদ্য এড়িয়ে চলতে হবে।

৫. সুস্থ থাকার জন্য ব্যায়াম করা সবার জন্য ভালো। কারও থাইরয়েড সমস্যা থাকলেও ব্যায়াম বাদ না দিয়ে ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া উচিত।

৬. কোনো কারণে যদি শরীর এক্সরে করার প্রয়োজন হয়, তাহলে থাইরয়েড গ্রন্থির সুরক্ষা নিশ্চিত করে তারপর এক্সরে করতে হবে। সম্ভব হলে এক্সরে না করাই উত্তম। কারণ এক্সরে থেকে নির্গত রশ্মি থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষতি করে। 

৭. নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে ও মেডিসিন নিতে হবে। মেডিসিন নেওয়া বন্ধ করলে সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে।

৮. ডায়াবেটিসের রুটিন, করণীয়গুলো মেনে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।


প্রতিকার


হাইপোথাইরয়েডিজম সাধারণ সমস্যা হিসেবে ধরা হয় যা কিছু নিয়মকানুন ও চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিকার করা যায়। তবে পুরোপুরি প্রতিকার করা যায় না, প্রতিরোধ করা যায়। 

হাইপারথাইরয়েডিজম খুবই বিরল এবং এর চিকিৎসাও কঠিন। এটিও পুরোপুরি প্রতিকার করা যায় না।

তাই প্রতিরোধ করতে অল্পসংখ্যক এই নিয়মগুলো অনুসরণ করে চলতে হবে।

চিকিৎসা


থাইরয়েড চেক-আপ, বায়োপসি, রক্ত পরীক্ষা করে চিকিৎসক সমস্যাটির অবস্থা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা দিবে।

পুরোপুরি প্রতিকার করা না গেলেও সার্জারি করে থাইরয়েডের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ অপসারণ করে অনেকাংশেই প্রতিকার সম্ভব।


শেষ করছি

থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণগুলো জেনে নিজে নিজে পরীক্ষা করে ও কোনো লক্ষণ উপলব্ধি করলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে উক্ত সমস্যাটি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সহজ হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url