এনাল ফিসার নিরাময় ও প্রতিকার করার কার্যকর ঘরোয়া ব্যবস্থা
এনাল ফিসার, অন্য কথায় অর্শ্বগেঁজা নামেও বলা হয়। এনাল পথের চামড়ার ভঙ্গুরতা থেকে চামড়া ফেটে যাওয়া ও তার কারণে ব্যথা, জ্বালা করা, ঘা, রক্ত পড়া, গেঁজা হওয়ার মতো সমস্যাই এনাল ফিসার। পাইলস ও এনাল ফিসারের মধ্যে তফাৎ আছে। আমাদের আগের আর্টিকেল থেকে পাইলস সম্পর্কে পড়লেই এ দুটোর পার্থক্য জানতে পারবেন। এখানে বলা হবে এনাল ফিসার নিরাময় ও প্রতিকার এর জন্য সহায়ক, উপকারী ব্যবস্থা সম্পর্কে।
এনাল ফিসার বা অর্শ্বগেঁজা
পায়ু তথা এনাল পথের যত রোগ, সমস্যা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
মানবদেহের মলাশয়ে বর্জ্য বা মল জমা থাকে। যখন মলাশয় মলে ভরে আসতে থাকে, তখন মানুষের পায়খানা করার অনুভূতি জাগে, পায়খানার বেগ পায়। পায়খানা করার সময় মল স্বাভাবিকের তুলনায় শক্ত হলে জোরে চাপ দিয়ে, কুদ /কোত দিয়ে মল বিসর্জন করার ফলে পায়ু পথে ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
যদি এনাল পথের চারপাশের চামড়া অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার কারণে ফেটেই যায়, তাহলে তখন এনাল পথে ব্যথা, জ্বালাপোড়া করা, এমনকি রক্তও আসে। এনাল পথের এই অবস্থাই হচ্ছে এনাল ফিসার।
মূলত মল শক্ত হয়ে থাকা, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সমস্যা থেকেই এনাল ফিসারের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক ব্যবস্থা না নিলে সমস্যাটি কঠিন পর্যায়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবণা থাকে। কঠিন পর্যায়ে গেলে তখন গেঁজা, এবং পরবর্তী তে এনাল ক্যান্সারও হতে পারে।
কেন হয়?
পেটে, এনাল পথে কোনো সমস্যা থাকলে তা এনাল ফিসারের উদ্ভব ঘটায়। এখানে পেট ও এনাল পথের সেরকম সমস্যাগুলো দেওয়া হলো যেগুলোর জন্য এনাল ফিসার হতে পারে।
- প্রতিদিন প্রয়োজন অনুসারে পানি না খাওয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা
- আঁশ আছে এমন খাবার না খাওয়া
- অ্যালকোহল বেশি গ্রহণ করা
- ঘনঘন ডায়রিয়ার সমস্যা থাকা
- গর্ভবতীদের সন্তান প্রসবের কারণে
- অতিরিক্ত জোরে চাপ /কুদ দিয়ে মলত্যাগ করা
- এনাল সেক্স
- এনাল পথে কোনো কিছু ঢুকানো
- এনাল পথের চামড়ায় কোনো চর্মরোগ
- যৌন বাহিত রোগ
এসব কারণই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এনাল ফিসার এর সাথে জড়িত।
এনাল ফিসার এর উপসর্গ
উপসর্গ কেমন হয় তা এই লেখা পড়া শুরু করার পরই অনেকটা জানা গিয়েছে। কারও এনাল ফিসার হলে একটি অথবা একাধিক উপসর্গ থাকতে পারে। নিম্নোক্ত উপসর্গের মধ্যে কোনো টা থাকলে তাহলে দেরি না করে সঠিক চিকিৎসার সাহায্য নিতে হবে।
মল বিসর্জন এর পর থেকে ব্যথা
অতিরিক্ত ব্যথা, জ্বালাপোড়া। ব্যথা মূলত পায়খানা করার সময় মল বের হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এবং সেই ব্যথা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। ব্যথার অনুভূতিটা অনেকটা চামড়ার দুই পাশে কোনো কাচ, ধারালো বস্তু বিঁধলে অথবা বের হয়ে আসার সময় যেরকম অনুভূত হয়, সেরকম। মল বিসর্জন শেষ হলেও সেই ব্যথা থাকে, সাথে এনাল পথে জ্বালাপোড়াও। ব্যথা হতে পারে মল বিসর্জন এর সময়ও।
এনাল পথে চিহ্ন
মলাশয় থেকে মল পায়ুপথ দিয়ে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত পায়ু পথের চামড়া সংকুচিত অবস্থায় থাকে। মল বিসর্জনের সময় চাপ পড়ায় চামড়ার সংকোচন ফেটে যায়, ছিঁড়ে যায়। যার কারণে এনাল পথে ফেটে গেলে, ছিঁড়ে গেলে, ঘা হলে যেমন দাগ বা চিহ্ন হয়, তেমন চিহ্ন হয়ে যায়। চিহ্ন গুলো বেশিরভাগ এনাল পথের মুখ এর কাছে হয়ে থাকে।
গোটা, গেঁজা
চামড়া ফেটে সেই ফাটা জায়গার আশেপাশে ছোট ছোট চামড়ার দলা সৃষ্টি হয়। পরে আস্তে আস্তে তা বড় হয়ে গেঁজার হয়ে যেতে পারে।
চুলকানি হওয়া
এনাল ফিসার হলে এনাল পথে চুলকানি থাকে। মল বিসর্জন এর সময় ছাড়াও প্রায় সবসময়ই থাকতে পারে চুলকানি।
রক্তপাত
পাইলস এর সাথে এনাল ফিসার এর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো রক্তপাত হওয়া। ফিসারে রক্তপাত হয় বেশি এবং রক্তের রঙ হয় টাটকা, তাজা লাল। পাইলসে রক্তপাত হলেও খুব কম হয়। মল বিসর্জন এর সময়, বিসর্জন শেষ হওয়ার পরও হতে পারে রক্তপাত। রক্ত লেগে থাকে মলে, শৌচকাজের সময় হাত অথবা টিস্যু ব্যবহার করলে হাতে, টিস্যুতে রক্ত লেগে যায়।
এই উপসর্গ গুলোই বেশিরভাগ হয়ে থাকে। কারও বেলায় যেকোনো একটি উপসর্গও থাকতে পারে, আবার একাধিকও থাকতে পারে।
এনাল ফিসার নিরাময় ও প্রতিকার
কেন এটি হয় তা থেকে দেখা যায় ব্যক্তি নিজের কিছু ভুল অভ্যাস, ভুল কাজের জন্য এনাল ফিসার এর শিকার হয়। যেমন, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার পেছনে পানি কম খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করা, আঁশ না খাওয়া। যদি ব্যক্তি নিজের সেই ভুল কাজগুলো শোধরাতে পারে, তাহলেই এই বিব্রতকর ও অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
যাদের এনাল ফিসার হয়েছে, তারা এটি নিরাময় করতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গুলো অবলম্বন করলে ঘরোয়া ভাবেই ভালো করা যাবে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
এনাল পথ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করতে হবে। অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করতে হবে। কারণ লোমের কারণে এনাল পথ ঘাম ও পানির জন্য ভেজা থাকে। ভেজা জায়গায় এনাল ফিসার এর সমস্যা আরও বাড়ে। যদি এনাল পথ পরিষ্কার রাখা হয়, তাহলে পথটি শুকনো থাকবে। শুকনো থাকলে এনাল ফিসাসের জন্য হওয়া ঘা, ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকাতে পারবে।
অনবরত ঘষামাজা না করা
শৌচ কাজের সময় হাত দিয়েই হোক বা টিস্যু দিয়ে, কোনোভাবেই সেখানে জোরে অনবরত ঘষামাজা করা থেকে সাবধান থাকতে হবে। ঘষামাজার কারণে ক্ষত, ঘা শুকাতে সময় লাগে ও আরও ব্যথা, রক্তপাত হয়। তাই সেখানে বেশি ঘষামাজা করা যাবে না।
জোরে কুদ দেওয়া যাবে না
মল বিসর্জন স্বাভাবিক ভাবেই হতে পারে। তাই সেটা করার জন্য জোরে কুদ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আর এনাল ফিসার থাকলে তো কুদ দেওয়া থেকে যত সম্ভব পারা যায় কুদ বা চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। জোরে চাপের ফলে এনাল পথ আরও ফেটে যাওয়ার সম্ভাবণা থাকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ঠেকানো
পায়খানা করলে কষ্ট, দীর্ঘ সময় ধরে টয়লেটে বসে থাকা, মল শক্ত এগুলো কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য হয়। এগুলোই আসলে এনাল ফিসারের মূল কারণ। এগুলোর জন্যই এনাল পথে ক্ষত, ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। ক্লিক করে পড়ে নিন কোষ্ঠকাঠিন্য সম্পর্কে।
খাবার
গরম তরল খাবার, বিশুদ্ধ পানি, আঁশ যুক্ত খাবারে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এগুলোই পারে পেট ভালো রাখতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে রাখতে।
ব্যথা নিরাময় করার জন্য
পাইলস এর ব্যথা কমানোর জন্য যে পদ্ধতি, এনাল ফিসারেও সেগুলো প্রয়োগ করা যায়।
এখানে আলাদা করে এই রোগের জন্য ব্যথা নিরাময়ের পদ্ধতি উল্লেখ করা হচ্ছে :
পানিতে ডুবানো
গরম পানিতে এনাল পথ ডুবানো। ব্যথা নিরাময়ে পাইলসের বেলায়ও এটি করা হয়। এটির বেলায়ও করা যায়। একটি গামলাতে হালকা গরম তাপমাত্রার পানি নিয়ে ভরতি করতে হবে। তারপর এনাল পথ সম্পূর্ণ পানিতে লাগিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে। এভাবে থাকলে অল্প সময়েই ব্যথা নিরাময় হবে। এছাড়া এই পদ্ধতিতে এনাল পথের সংকোচন দূর হয়ে পথকে নরম করে। পথ নরম থাকলে মলত্যাগের সময় বেশি চাপের প্রয়োজন হয় না।
ত্বক নরম করার উপকরণ লাগানো
পেট্রোলিয়াম জেলি, ভেসলিন, মেরিল, গ্লিসারিন এরকম ত্বককে মসৃণ রাখার উপকরণ গুলো এনাল পথে লাগানো যায়। এসব লাগালে এনাল পথ নরম হবে, ব্যথা কম হবে।
মল নরম রাখার জন্য
শক্ত মল হলে তা এনাল পথকে চাপে ফেলে এবং ফেটে যায়। তাই মল যাতে নরম থাকে তার জন্য গরম স্যুপ, পানি, আঁশ বেশি করে খেতে হবে।
প্রতিকার
যদি এই রোগটি থেকে সবসময় দূরে থাকতে চান, তাহলে এই কাজগুলো করুন।
- কোষ্ঠকাঠিন্যকে বিদায় করা।
- ডায়রিয়ায়া হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া।
- এনাল পথ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখা।
- বেশি ঘষামাজা না করে সাধারণ সাবান, পানি দিয়ে পরিষ্কার করা।
- আঁশ, পর্যাপ্ত পানি নিয়মিত খাওয়া।
- সবসময় অলস শুয়ে-বসে না থেকে হাঁটাচলা, ব্যায়াম করা।
- পেট ভালো রাখা, অন্ত্র ভালো রাখা।
উপসংহার
এনাল ফিসার নিরাময় করা পুরোপুরি সম্ভব যদি এটি হওয়ার প্রথম দিকেই এর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথম দিকে ব্যবস্থা নিলে কোনো অপারেশন ব্যতীতই এটি দূর করা যাবে।