হাঁপানি বা এজমার উপযুক্ত চিকিৎসা

হাঁপানি বা এজমার উপযুক্ত চিকিৎসা


আসছে শীতকাল। এই সময়ে শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষদের হাঁপানি সমস্যা বেড়ে যায় অন্য সময়ের তুলনায়। এমন কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো শুধু শীতকালে ই নয়, যেকোনো ঋতুতে হাঁপানি বা এজমা বাড়িয়ে দেয়। হাঁপানি বা এজমার কষ্ট কমাতে কী করতে হবে, এর কারণ, লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। 


হাঁপানি বা এজমা 

লক্ষণ, উপসর্গ ও ঝুঁকির কারণ!! 


হাঁপানি বা এজমা কী?

হাঁপানি একটি  দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যা আমাদের ফুসফুসের শ্বাসনালীকে প্রভাবিত করে এবং যার ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। শ্বাসনালীর ভেতরে ফুলে গিয়ে বাতাস চলাচলে বাঁধা দেয়। শ্বাসনালীর চারপাশের পেশীগুলো শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে চটচটে শ্লেষ্মার উৎপাদন বেড়ে যায়, যা শ্বাসনালীর পথে আরও বাধার সৃষ্টি করে।‌‌ সুতরাং, হাঁপানি হচ্ছে শ্বাসযন্ত্রের একটি রোগ ও শ্বাসকষ্টের একটি কারণ। 


হাঁপানি বা এজমার লক্ষণ 

শ্বাসকষ্ট : শ্বাসকষ্টের একটি কারণ হচ্ছে এজমা। তাহলে এজমা হলে এর লক্ষণ হিসেবে শ্বাসকষ্ট হবে সেটা নিশ্চিত।

বুকে চাপ অনুভব : মনে হবে বুকের উপর কিছু চেপে আছে, কিছু আঁটকে আছে, কোনো ভারী কিছু বুকের উপর রাখা আছে। 

বুকে ব্যথা : মৃদু থেকে অসহনীয় মাত্রার ব্যথা হতে পারে। মৃদুও হতে পারে, মাঝারিও হতে পারে, আবার অসহনীয় ব্যথাও হতে পারে। 

কাশি : বেশিরভাগই শুকনা কাশি থাকবে। অনবরত কাশির চোটে দম বন্ধ হওয়ার দশা হতে পারে। 

শ্বাস ছাড়ার সময় শোঁ শোঁ শব্দ : নিঃশ্বাস ফেলার সময় বাতাস প্রবাহের মতো শোঁ শোঁ শব্দ থাকতে পারে। যেহেতু বাতাস চলাচল বাঁধা প্রাপ্ত হয়, সেহেতু বাতাস ছাড়ার সময় শব্দ হয়।

দ্রুত শ্বাস : শ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসে। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়া যায় না। ছোট ও সংক্ষিপ্ত দমে শ্বাস নিতে হয়।

ক্লান্তি : হয়রান ও ক্লান্তি বিরাজ করবে। অল্প পরিশ্রম, এমনকি একটানা কয়েক মিনিট হাঁটার ফলেও ক্লান্তি ভর করা।

ঘাম : শরীরে ঘর্মাক্ত দশা হতে পারে। তবে সারা শরীরে না হলেও মুখে ঘাম হয়ে থাকে।

প্যানিক : মনের মধ্যে সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করে। উচ্চ শব্দেও ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়া। কারও জোরে কথা বলা, জোরে কোনো শব্দ শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়া।

ঘুমাতে অসুবিধা স্লিপিং অ্যাপ্নিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। শ্বাসকর্ম স্বাভাবিক না থাকায় ঘুমে বারবার ব্যাঘাত ঘটে।

হাঁপানির লক্ষণ বেশিরভাগই সকালে অথবা সন্ধ্যার দিকে হয়।

এই লক্ষণ সমূহ দেখলে একা থাকা অথবা একা একা ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে হবে। 


হাঁপানির জন্য দায়ী ও কারণ 

এলার্জি : যদি এলার্জি থাকে কারও, তাহলে তার শ্বাসকষ্ট হওয়ার পসিবিলিটি থাকে।

দূষণ : পরিবেশে ও বাতাসে ময়লা, ধূলিকণার উপস্থিতি বেশি থাকলে তা নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে শ্বাসযন্ত্রের পথে বাঁধা দেয়। তা থেকে হাঁপানি হয়।

ধোঁয়া : আগুনের ধোঁয়া, বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া শ্বাসযন্ত্রে অক্সিজেন চলাচলে বাঁধা দিয়ে থাকে। তাই তার জন্য হতে পারে এজমা।

পশুপাখির লোম : এলার্জি থাকলে এই কারণটি হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী। পশুপাখির লোম, বিষ্ঠা এলার্জিকে উস্কে দেয়। আর এলার্জি এজমার জন্য দায়ী একটি কারণ। 

পরাগ : এটা এলার্জির সাথে সংশ্লিষ্ট। ফুলের পরাগের সংস্পর্শে এলার্জি হলে তা থেকে হয়ে থাকে এজমা।

আবহাওয়া : শীতকালীন আবহাওয়া এই সমস্যার সৃষ্টি করে বেশি। বাতাসে অক্সিজেনের অনুপস্থিতি পর্যাপ্ত না থাকলে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আবহাওয়ায় থাকলে শ্বাস নিতে সমস্যা হয় একজন সুস্থ মানুষেরই। সেক্ষেত্রে এজমা আক্রান্ত কারও জন্য তো তা হতে পারে বিপদসংকুল। 

শরীরচর্চা : অতিরিক্ত ভারী শরীরচর্চার ধকলে দেহে অক্সিজেনের ভারসাম্যহীনতা হতে পারে। যার জন্য এই সমস্যা হওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। 

গভীর কোনো আবেগ : অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, অবসাদ দেহে বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে। তার কারণে অক্সিজেনের চলাচলে সমস্যা হলে হতে পারে এজমা।


হাঁপানি বা এজমার উপযুক্ত চিকিৎসা কী?

দুঃখের খবর হলো এই যে, এখনও হাঁপানি পুরোপুরি সারিয়ে তোলার মতো কোনো চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নি। কিছু ঔষধ ও কৃত্রিম শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র (যেমন- ইনহেলার) নিয়মিত ব্যবহার করলে হাঁপানির ঝুঁকি এড়ানো যায়।

আমি আপনাদেরকে কিছু জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে বলবো যেগুলো এজমা আক্রমণের সাথে সাথে পদক্ষেপ নিলে এর অনিশ্চিত ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। 


যে পদক্ষেপ গুলো দ্রুত নিতে হবে :


১. প্রতিটি এজমা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথেই একটি করে ইনহেলার সবসময় রাখা উচিত। বলা তো যায় না কখন আক্রমণ করে বসে!

সাথে সবসময় কৃত্রিম শ্বাস যন্ত্র বা ইনহেলার রাখতে হবে। যখনই শ্বাস-প্রশ্বাস কাজে কষ্ট শুরু হবে, অর্থাৎ এজমা আক্রমণ করবে তখনই ইনহেলার বের করে মুখে নিয়ে কয়েক টান গ্রহণ করতে হবে। 

তাতে কষ্ট কমিয়ে আনা যাবে।

২. শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বেশিরভাগ রোগীই স্থির থাকতে পারে না। ভয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি করা শুরু করে। নাড়াচাড়া, হাঁটাচলা অনবরত দ্রুত করতে থাকে। তার সাথে আশেপাশের মানুষেরাও পরিস্থিতি আরও অস্থির করে তুলে।

কিন্তু এমন করা যাবে না। চেষ্টা করতে হবে শান্ত থাকার। আক্রমণ শুরু হলে রোগীকে ও আশেপাশের মানুষেরদের শান্ত থাকতে হবে। 

রোগীকে অভয় দেওয়া ও ইনহেলার, অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করে রোগীর কষ্ট কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৩. আক্রমণ শুরু হলে বেশিরভাগ রোগীকে দেখা যায় শুয়ে পড়তে। শুয়ে কাতরাতে। কিন্তু শুয়ে পড়লে কষ্ট আরও বেশি হয়। যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অথবা সোজা হয়ে বসে থাকার।

৪. অস্থির হয়ে রোগী হাত-পা নড়াচড়া বেশি করতে থাকে। ডাক্তার রা অনেকসময় রোগীকে যখন এজমা আক্রমণ করে তখন রোগীর হাত উপরের দিকে তুলতে নিষেধ করে। হাত উপরে তোলার ফলে শ্বাসতন্ত্রে চাপ পড়তে পারে। তাই হাত উপরের দিকে না তুলে সোজা নিচের দিকে অথবা বুকের নিচের অংশে স্বাভাবিক ভাবে রাখতে হবে। 


কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে? 

আক্রমন করার পর প্রাথমিক ভাবে কয়েক মিনিটে যদি লক্ষণ সমূহের উন্নতি না হয়, রোগী কথাই বলতে পারছে না এমন অবস্থা, একদমই শ্বাস নিতে পারছে না, শ্বাস নিতে বুকে চাপ দিতে হচ্ছে - এই অবস্থা দেখা দিলে অতিদ্রুত ডাক্তার অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

রোগীর একা যাওয়া ঠিক হবে না। সঙ্গে কাউকে যেতে হবে।


ঘরোয়া সমাধান 

এটা ঠিক যে, নিজে নিজে কোনো ব্যবস্থা নিয়ে এজমা ভালো করা যায় না। কিন্তু কিছু কাজ আছে যেগুলো করার ফলে কিছুটা হলেও ঘরোয়া ভাবে সমাধান পাওয়া যাবে। 

সেগুলো হলো -

১. শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক অবস্থা ভালো করতে ও শ্বাসযন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক করতে অনেক উপকারী। প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলে এজমার অবস্থা পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে উন্নতি করা যায়। 

ব্যায়াম করুন এভাবে -

  • মুখ বন্ধ রেখে নাক দিয়ে ধীরেধীরে শ্বাসকর্ম করুন। কয়েক সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখুন। পরে আবার শ্বাসকর্ম শুরু করুন। এভাবে কয়েকবার করে করুন।
  • মুখ বন্ধ নাকের এক ছিদ্র আঙুল দিয়ে চেপে রেখে শুধু এক নাক দিয়ে কয়েক সেকেন্ড শ্বাসকর্ম চালান। চেষ্টা করবেন কমপক্ষে ৫ সেকেন্ড এভাবে করার। তারপর নাক ছেড়ে দিয়ে দুই নাক দিয়েই স্বাভাবিকভাবে শ্বাসক্রিয়া চালান ৫-৭ সেকেন্ড। পরে অন্য নাকটি দিয়েও এভাবে করুন।

যখন শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে শুধু তখনই এটি করবেন।

২. নাক দিয়ে গরম পানির ভাপ নিন। ভাপ না নিলে গরম পানীয় বিশেষ করে কফি পান করুন প্রতিদিন সন্ধ্যায়।

৩. ভারী কাজ, ভারী ব্যায়াম করবেন না যদি আপনার শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে।

৪. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অবস্থান করুন। নির্মল, বিশুদ্ধ বাতাসে তৃপ্তি নিয়ে শ্বাসক্রিয়া করুন।

৫. শীতের সময় উষ্ণ থাকার চেষ্টা করতে হবে। নাক-মুখ ঢেকে রাখার ও গরম রাখার জন্য মাফলার, মাস্ক ব্যবহার করবেন।

৬. যাদের এলার্জি আছে, তারা এলার্জিকে উস্কে দিয়ে থাকে এমন নিয়ামকের আশেপাশে যাবেন না।


শেষে বলবো,

হাঁপানি বা এজমা আক্রমণ করলে রোগী ও রোগীর আশেপাশের মানুষেরা ভয় না পেয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন। রোগীকে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। অবস্থার পরিবর্তন না হলে অতিদ্রুত ডাক্তার এর নিকট নিয়ে যান, রোগীর কষ্ট নিবারণে ও প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url