পাইলস এর সমস্যা একেবারে দূর করার জন্য
পাইলস নিয়ে প্রতিটি মানুষই জন্মগ্রহণ করে। সেটা কোনো সমস্যা বা রোগ নয়। পাইলসকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে 'হেমোরয়েডস' বলে। পাইলস তখনই সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়, যখন এর শিরাগুলো ফুলে যায় ও কিছু উপসর্গ সৃষ্টি করে। পাইলস এর সমস্যা কেন হয়, এর উপসর্গ , ব্যথা দূর করা, পাইলস এর সমস্যা একেবারে দূর করার উপায়, পাইলস প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে এখানে জানুন।
প্রথমে জেনে রাখুন, পাইলস হচ্ছে পায়ুপথ সংলগ্ন সাধারণ সমস্যা বা অর্শ্ব রোগ। এনাল ফিশারের সাথে পাইলসের পার্থক্য আছে। এ আর্টিকেলে এনাল ফিসার সম্পর্কে বলা হয়েছে। এটাতে শুধু পাইলস বিষয়েই থাকছে।
পাইলস এর সমস্যা কেন হয়?
হেমোরয়েডস নামক একটি অংশ প্রতিটি মানুষের পায়ুপথের চারপাশে অথবা পায়খানার রাস্তার নিচের দিকে অবস্থিত। হেমোরয়েডস বা পাইলস এর ৩ টি প্রকার রয়েছে। অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, ও এই দু'টি একসাথে থাকা - এই হলো তিনটি প্রকার। প্রতিটি মানব এর এনাল পথে এই অংশটি থাকে।
যখন কোনো কারণে এই পাইলস নামক অংশগুলো ফুলে যেতে থাকে ও বড় হতে থাকে তখনই পাইলস সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন কারণে পাইলস এর এরকম সমস্যা হয়, যা মূলত মানুষেরই কিছু কাজের জন্য হয়। পাইলস বড় হওয়ার আগেই সহজসাধ্য কিছু কাজ করার মাধ্যমে অপারেশন ছাড়াই এই সমস্যা থেকে চিরতরে রেহাই পাওয়া যায়।
কী কী কারণে পাইলস এর সমস্যা হয়?
- টয়লেট করার সময় অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা অর্থাৎ জোরে কুদলে (বোঝানোর সুবিধার্থে এই শব্দটি)।
- অনেকদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে।
- টানা কয়েকদিন ডায়রিয়া থাকলে।
- অনেকক্ষণ সময় বসে থাকা, বিশেষ করে টয়লেটে যেভাবে বসা হয় সেভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকা।
- পায়ুপথে সঙ্গম বা এনাল সেক্স করা।
- পায়খানার রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করানো ও বের করা।
- খুব ভারী কোনো বস্তু একনাগাড়ে তোলার কাজ করা।
- নারীদের গর্ভকালীন সময়, সন্তান ডেলিভারির পর। কারণ এরকম অবস্থায় পায়ুপথ সংলগ্ন শিরায় চাপ পড়ে।
- খাবারের তালিকায় আঁশ জাতীয় খাবার না থাকা।
- যথেষ্ট পরিশ্রম না করা।
- ওজন অতিরিক্ত বেশি হলে।
- পারিবারিক ইতিহাস।
- বয়স পঞ্চাশ এর পর।
এগুলোই মূলত পাইলস এর সমস্যার কারণ। খেয়াল করলে দেখবেন এই কারণগুলো শেষের দু'টি ছাড়া সবগুলোই মানুষ নিজেরা করে। অতএব পাইলস এর সমস্যার জন্য মানুষ নিজেরাই কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
পাইলস এর উপসর্গ
পাইলস এর ৩ প্রকার থাকে যার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পাইলসে মানুষ বেশি ভুগে। আবার এই দু’টির মধ্যে বাহ্যিক বা পায়ুপথের বাহিরে হওয়া পাইলস সবচেয়ে বেশি সমস্যার ও ক্ষতিকর। আর অভ্যন্তরীণ পাইলস হলো পায়ুপথের ভিতর অর্থাৎ মলদ্বারের ছিদ্রের ভিতরের মুখে।
ভিতরে কিংবা বাহিরে যে ধরণের পাইলসই হোক, উপসর্গের প্রকাশ সব পায়ুপথেই হয়।
উপসর্গগুলো :
ভিতরের পাইলসের -
- প্রতিবার টয়লেটের পর শৌচ কাজ করার সময় টিস্যু / হাতে রক্ত আসা। মলের সাথেও রক্ত আসতে পারে।
- পাইলস অংশ বড় হয়ে পায়ুপথের বাহিরে চলে আসা।
- মলদ্বারে চুলকানি।
বাহিরের পাইলসের -
- পায়ুপথ এলাকায় পাইলস এর গুটি শক্ত হয়ে ফুলে যাওয়া, যা বাইরে থেকে হাত দিয়ে বোঝা যায়।
- পায়ুপথ, মলদ্বারে অতিরিক্ত চুলকানি।
- পায়ুর প্রবেশমুখে ব্যথা থাকতেও পারে, না-ও পারে। তবে বসে থাকার সময় ব্যথা হওয়ার সম্ভাবণা বেশি।
ব্যথা দূর করার জন্য
শরীরের যেখানেই ব্যথা হোক, গরম ভাপ ও বরফের স্পর্শ দেওয়া - এই দু'টি ঘরোয়া ব্যবস্থা খুবই কার্যকর। ব্যথা দূরীকরণে বরফ ও গরম ভাপ কার্যকর ও আরামদায়ক পদ্ধতি যা মানুষ অনেক আগে থেকে প্রয়োগ করে আসছে।
পাইলস এর সমস্যায়ও ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
গরম ভাপ যেভাবে নিতে হবে
- নরম কাপড় অথবা তুলো গরম করে নিয়ে তা পায়ুর খাঁজে গুঁজে রাখা। পাইলস এর সাথে লাগিয়ে গুঁজে রাখলে ভালো।
- এক গামলাতে গরম পানি নিয়ে সেই গামলার উপর দুই পা ফাঁক করে পায়ু বরাবর পানির বাষ্প নেওয়া।
যেকোনো একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবেন।
বরফ যেভাবে নিতে হবে
সরাসরি বরফের টুকরো পায়ুতে চেপে রাখা। অথবা কাপড়ে বরফ ঢেকে নিয়ে ঠাণ্ডা কাপড় সেখানে চেপে ধরা। নইলে ঠাণ্ডা বস্তুর উপর বসে থাকা।
ব্যথা কমাতে আরও যা করতে হবে -
- শৌচ কাজের সময় জোরে শৌচ না করা, জোরে না ঘষা।
- পায়ুতে কোনোভাবে চাপ না দেওয়া।
পাইলস এর সমস্যা একেবারে দূর করার জন্য
এমন জায়গায় সমস্যাটি হয় যার জন্য কাউকে জানানো, দেখানো বিব্রতকর ও লজ্জাজনক লাগে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর কাছে। কাউকে না জানিয়ে নিজেই কিছু ব্যবস্থা নিলে এটা দূর করা যাবে।
পাইলস কেন হয় ও এর কারণ গুলোতে জেনেছেন এরজন্য মানুষের নিজেদের কিছু কাজই মূল কারণ। তাই পাইলস চিরতরে দূর করতে মানুষকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সহজ কিছু কাজ ও নিয়ম মানলেই এটা দূর করা যায়।
যা যা করণীয় :
পেট ভালো রাখা
পেটে হজম, পরিপাক ও অন্ত্রসমুহের ক্রিয়া যেন ভালো ও সঠিকভাবে হয় তার জন্য নিয়মিত আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া। বিভিন্ন শাক ও সবজি, ফলফলাদি তে প্রচুর আঁশ বিদ্যমান। আঁশ জাতীয় খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে রাখে, অন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে, পায়খানার মল নরম রাখে ফলে টয়লেটে কষ্ট হয় না।
উদরাময় রোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, ৪ মাস বা তার বেশি সময় নিয়মিত শাক ও সবজি খাওয়া মানুষদের পাইলস এর সমস্যা থাকে না বললেই চলে। এবং নিয়মিত খাওয়াতে অন্ত্র ও পেটের পরিবেশ ভালো থাকে ফলে বিভিন্ন উদরাময় রোগ হতে পারে না।
অন্ত্র ভালো আছে নাকি সেটা বোঝার জন্য পড়ুন এটা।
পায়ু ও মলদ্বারে চাপ প্রয়োগ না করা
টয়লেট করার সময় জোরপূর্বক চাপ দিয়ে মলত্যাগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, জোরপূর্বক অতিরিক্ত বল প্রয়োগে পাইলস বাইরে চলে আসতে পারে। মলত্যাগে যেন জোরপূর্বক চাপ দিতে না হয় তার জন্য অন্ত্র ও পেটের পরিবেশ ভালো রাখতে হবে।
মাঝেমধ্যে গরম পানিতে পায়ুপথ ডুবানো
গামলায় অথবা বাথটাবে কুসুম গরম পানিতে ১০ মিনিট পায়ু ডুবিয়ে রাখলে তা পথে অবস্থিত পাইলসকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
বসে থাকা
টয়লেট করার পজিশনে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। টয়লেটেও সেই পজিশনে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না, সেই সাথে সব জায়গাতেও সেভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকার অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
সেই পজিশনে অতিরিক্ত বসে থাকলে পাইলসে চাপ পড়ে।
ভারী বস্তু না তোলা
মাটি থেকে অতি ভারী কোনো বস্তু ঘনঘন তোলা থেকে বিরত হতে হবে। ব্যায়ামাগারেও অতি ভারী সরঞ্জাম তোলা বা ভারোত্তোলন ঘনঘন করা যাবে না।
কারণ, তা ঘনঘন করতে থাকলে পায়ুপথে চাপ পড়ে।
এনাল সেক্স না করা
এনাল সেক্সে অনবরত লিঙ্গ ঢুকানো, বের করার কারণে পাইলস আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফুলে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এনাল সেক্স পরিত্যাগ করতে হবে।
পায়ুপথ দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ না করানো
কোনো বস্তু মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করালে তা পাইলসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই এই কাজ মোটেই করা যাবে না।
পরিশ্রম করা
কোনো শারীরিক কাজ না থাকলে, পরিশ্রম করা লাগলে একদম অলস জড়বস্তু না হয়ে প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিটের জন্য হলেও হাঁটুন। জগিং, শরীরকে টানা ও বাঁকানো অর্থাৎ স্ট্রেচিংও করতে পারেন। এগুলোর চেয়ে সহজ কোনো ব্যায়াম আছে?
এই সহজ ব্যায়াম ও হালকা পরিশ্রমটুকু করলে পেটের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
অবশ্যই পানি পান করতে হবে
পানি শরীরের ভিতর, বাহিরের সমস্ত কাজগুলোকে স্বাভাবিক রাখে, অক্সিজেন সরবরাহ করে, পেটের ভিতরে বিভিন্ন ক্রিয়া সচল ও স্বাভাবিক রাখে। তাই প্রতিদিন ৮ গ্লাসের বেশি পানি পানের চেষ্টা করতে হবে।
এই করণীয় গুলো মেইনটেইন করতে পারলেই অর্শ্বের বা পায়ুপথের সমস্যাটি একেবারে দূর করা যায়।
পাইলস এর চিকিৎসা
এটি ঘরোয়া উপায়েই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দূর করা সম্ভব উপরে বলা কাজগুলোর মাধ্যমে। অপারেশন করা ছাড়াই এটি নির্মূল করা সম্ভব।
কিন্তু যদি পাইলস বেশি শক্ত হয়ে যায়, বেশি ফুলে যায়, রক্তপাত বেশি হয়, ব্যথা বাড়তে থাকে, একবার ভালো হয়ে যাওয়ার পর বারবার হতে থাকলে, তাহলে চিকিৎসক এর কাছে যেতে হবে। এবং পরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসক উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে।
নিজের বা অনভিজ্ঞ কারও পরামর্শে কোনো মেডিসিন গ্রহণ করা যাবে না। মেডিসিন এর প্রয়োজন হলে অভিজ্ঞ ডাক্তার এর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
শেষ কথা
পাইলস দূর করা সম্ভব কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। প্রাথমিকভাবে নিজে কিছু নিয়ম মেনে চললেই তা নিরাময় করা যায়। কোনো অস্বাভাবিকতার দেখা দিলে চিকিৎসক এর নিকট যেতে হবে।