স্লিপ অ্যাপ্নিয়া কেন হয়? স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হলে কীভাবে জানা যাবে? প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চমকে ওঠা, নাক ডাকা, শ্বাসকষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা আমরা অনেকের মাঝে দেখে থাকি। ' স্লিপ অ্যাপ্নিয়া ' হচ্ছে ঘুম জনিত বড় সমস্যা গুলোর একটি। আগে সমস্যাটি তেমন পরিচিত না হলেও, একবিংশ শতাব্দীতে এই স্লিপ অ্যাপ্নিয়া সমস্যার ভুক্তভোগীদের খবরও প্রকাশ্যে আসছে। কিন্তু এটি আসলে কী? কারও স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হলে কীভাবে জানা যাবে? জানতে হলে পড়তে থাকুন এই লেখা।
স্লিপ অ্যাপ্নিয়া
এটি হচ্ছে একটি ঘুম জনিত সমস্যা। ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটার ঘটনাটিই স্লিপ অ্যাপ্নিয়া। এটিকে স্লিপিং ডিজঅর্ডারও বলা হয়, যেহেতু এটি ঘুমের মধ্যে হওয়া একটি সমস্যা।
এটিকে সাধারণ সমস্যা হিসেবেই এতদিন মানুষ জানতো। কিন্তু বর্তমানে এটি পরিচিত হয়ে গেছে মরণঘাতী একটি রোগ হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন বড় বড় সেলিব্রিটি এই রোগের শিকার হয়ে মারা গিয়েছে। তারপর থেকেই এর পরিচিতি আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
এর একাধিক প্রকারও রয়েছে। প্রকার অনুসারে নির্ধারণ করা হয় কার এই সমস্যাটির মাত্রা কীরকম। হালকা, মাঝারি, তীব্র, হাইপো অ্যাপ্নিয়া, ও অ্যাপ্নিয়া - এই ৫ প্রকারের দেখা যায় ব্যক্তি বিশেষে। ৫ টির মধ্যে শেষ ৩ টি মারাত্মক পর্যায়ের।
কারও যদি এই সমস্যাটি থাকে, উপসর্গ উপলব্ধি করার সাথে সাথে এটি রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। সচেতন না হলে এটি এক পর্যায়ে গিয়ে হার্ট ডিজিজ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্ট্রোকের মতো ভয়ংকর রোগের সম্ভাবণা তৈরি করে।
স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হলে কীভাবে জানা যাবে?
এখানে আপনাদেরকে স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার মূল ও আসল লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো জানাবো। সেগুলো যদি কারও ঘুমের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে বড় সম্ভাবণা আছে তার এই সমস্যাটি রয়েছে।
শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট : এটিই স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার মূল লক্ষণ ও উপসর্গ বলা হয়। মূলত শ্বাসকার্যের ব্যাঘাত ঘটাকেই স্লিপ অ্যাপ্নিয়া বলা হয়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় কেউ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে যায় এবং একনাগাড়ে অস্থির হয়ে শ্বাস নিতে থাকে। অথবা ঘুমের সময় নাক দিয়ে ঠিকভাবে শ্বাসক্রিয়া না চলায় মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে। এমন অবস্থা কারও মধ্যে দেখা গেলে এটাকে স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার একটি লক্ষণ হিসেবে ধরতে হবে।
তবে এই অবস্থা দেখা গেলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে তার স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হয়েছে। কারণ, অনেকসময় ঠাণ্ডা, সর্দির জন্যও নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে থাকে।
নাক ডাকা : শুধু বয়স হলেই নাক ডাকার সমস্যা হয় না, কম বয়সীদের মাঝেও নাক ডাকার সমস্যা হয়ে থাকে। বিশেষ করে চিৎ হয়ে ঘুমানোকালে নাক ডাকার সমস্যাটি বেশি হয়। স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হলে নাক ডাকার হার বেশি হয় এবং শব্দও বেশি হয়।
হাঁপানো : ঘুমের মধ্যে হঠাৎই হাঁপানো অবস্থায় ঘুম ভেঙে যায়। ভীতিকর কোনো স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে হাঁপাতে হাঁপাতে। অবস্থা এমন হয়ে যায় যে তখন হয়রান হয়ে এতটাই হাঁপানো দেখা দেয় ঠিক মতো কথাই বলতে পারছে না।
ইনসোমনিয়া : এটি হচ্ছে নির্ঘুম অবস্থা। রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যায় তবুও ঘুম আসে না। একদিন দুইদিন না, কয়েকদিন ধরে ঘুম হয় না, ঘুম আসে না। এমন অবস্থা হচ্ছে ইনসোমনিয়া। এটিও স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার অন্যতম লক্ষণ।
দিনে ঘুম : দুপুরের খাবার খাওয়ার পর ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসলে সেটা অন্ত্রের সমস্যার কারণ হতে পারে। আবার দুপুরের খাবারের পর ছাড়াও দিনের যেকোনো সময়ে তন্দ্রা জাগা, ঝিমানো, ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলে সেটা ঘুমের সমস্যাকে নির্দেশ করে।
মুখ শুকনো থাকা : ঘুম ভাঙার পর সাধারণত সবারই মুখে কিছুটা লালা জমা হয়ে থাকে। কিন্তু ঘুমের এই ডিসঅর্ডার যাদের হয়, তারা প্রায়শই শুকনো মুখ, তেঁতো গলা ও পিপাসা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে।
মনোযোগের ঘাটতি : ঘুম হচ্ছে মস্তিষ্কের বিশ্রামের মাধ্যম। ঘুম ঠিকমতো না হলে মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায় না, তাই মনোযোগে ঘাটতির সৃষ্টি হয়। পড়াশোনায়, অফিসে, যেকোনো কাজে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে যায় যদি কেউ এই সমস্যাতে অনেকদিন ভুগতে থাকে।
মাথাব্যথা : ঘুম ভালো হলে মাথা সহ সারা দেহ ভালো থাকতে পারে। ঘুমের কমতিতে অনেকের মাথাব্যথা হওয়ার অভ্যাস থাকে।
যৌন ক্ষমতা হ্রাস : দীর্ঘদিন ধরে স্লিপিং অ্যাপ্নিয়ায় ভোগার ফলে আক্রান্তের যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। যৌন চাহিদা কমতে থাকে।
ঘুমের ব্যাঘাতের সাথে এই উপসর্গ থাকলে সতর্ক হতে হবে। তবে স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে দুশ্চিন্তা না করে, উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসককে বিস্তারিত জানান। তারপর নিশ্চিত হওয়া যাবে এটা হয়েছে কি হয়নি।
যারা স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার ঝুঁকিতে
অতিরিক্ত স্থুল স্বাস্থ্য ও ওজন যাদের, যারা নেশাদ্রব্য যেমন অ্যালকোহল নিয়মিত গ্রহণ করে তারা এই রোগের ঝুঁকির তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে।
আর বয়স ৫০-৬০ বছর হয়ে গেলে ঘুমের সমস্যাটি হওয়ার হার অন্যান্য বয়সীদের তুলনায় কিছুটা বেশি।
স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার প্রতিরোধ
প্রাথমিক দশায় থাকতে নিজে কিছু ব্যবস্থা নিলেই এটি অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা যায়। যদি তীব্র থেকে তীব্রতর দশায় পৌঁছে যায় তখন সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবস্থাভেদে মেডিক্যাল ব্যবস্থাও নিতে হতে পারে।
এটি প্রতিরোধ করতে নিজে যেসকল ব্যবস্থা নিতে হবে -
- রেগুলার ব্যায়াম করতে হবে। হালকা অথবা মাঝারি ব্যায়াম হলেও। সম্ভব হলে ভারী ব্যায়ামও করবেন।
- অতিরিক্ত ওজন থাকলে স্লিপ অ্যাপ্নিয়া বেশি মাত্রায় হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই ওজন কমিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- ধুমপান, অ্যালকোহল পরিত্যাগ করুন।
- এলার্জি থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- ঘুমের ঔষধ নিবেন না।
- চিৎ হয়ে শোয়া বাদ দিতে হবে। খেয়াল করলে যাদের নাক ডাকার সমস্যা আছে, তারা চিৎ হয়ে শোয়াবস্থায়ই বেশি নাক ডাকে। স্লিপ অ্যাপ্নিয়া রোধে চিৎ হয়ে ঘুমানোর পজিশন পাল্টাতে হবে। কাত হয়ে অথবা উপুড় হয়ে সঠিক পজিশনে ঘুমাতে হবে।
এই ব্যবস্থা গুলো নিজেই নেওয়া যায়। যদি তবুও এটি চলে না যায় তাহলে মেডিক্যাল ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ব্যবস্থা না নিলে যে ক্ষতি হয়
যদি অনেকদিন এটি চিকিৎসা বিহীন চলতে থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি, হার্ট ডিজিজ এর সম্ভাবণা বাড়া, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস - এর মতো ক্ষতিগুলো হওয়ার সুযোগ থাকে।
স্লিপ অ্যাপ্নিয়া একটি সাধারণ ব্যাপার হলেও, এটি বড় অসুবিধাও বয়ে আনতে পারে যা উপরের আলোচনায় বলা হয়েছে।
সাবধান থাকুন, সতর্ক হোন।