কখন সিজার করা উচিত? সিজারের ঝুঁকি, সুবিধা , কর্তব্য

কখন সিজার করা উচিত? সিজারের ঝুঁকি, সুবিধা , কর্তব্য


আধুনিক যুগের নারীদের মাঝে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে দিনদিন। কিন্তু কখন সিজার করা উচিত, কেন করতে হয়, একবার সিজারের পরে কি স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব কি-না, এর সুবিধা- অসুবিধা, ঝুঁকি  সম্পর্কে অনেক নারীই জানেন না। না জেনেই তারা সিজার করার দিকে আগ্রহী হয়। আমার আজকের এই আলোচনায় চলুক জেনে নেওয়া যাক সিজার ও সিজারিয়ান সম্পর্কে বিস্তারিত।


সিজার বা সিজারিয়ান ডেলিভারি

সিজারিয়ান ডেলিভারিকে সহজে "সি-সেকশন" অথবা সহজ কথায় সিজার বলা হয়। উন্নত রাষ্ট্রের ও আধুনিক নারীদের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে এখন সারাবিশ্বেই এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদানের হার বেড়ে চলেছে।

নরমাল বা স্বাভাবিক ডেলিভারির মাধ্যমে যদি কোনো নারীর সন্তান প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়, মা ও শিশুর জন্য কোনো ক্ষতির আশংকা থাকলে তখন সেই প্রসূতির জন্য সিজার করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।

আবার রূপ সচেতনতার জন্যও মডার্ন নারীরা সিজারিয়ান ডেলিভারি বেছে নেয়, যাতে চেহারা নষ্ট না হয়।

এই পদ্ধতিতে প্রসূতির পেট ও জরায়ু তে সার্জিক্যাল অপারেশন বা কেটে বাচ্চা বের করে নিয়ে আসা হয়। এরকম করার কারণে পরবর্তী তে মা ও শিশুর উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি-না এই বিষয়টিও জেনে নিতে পারবেন এখান থেকে। পড়া চালু রাখুন।


গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ


কখন সিজার করা উচিত? 

নিম্নলিখিত কারণগুলোর ক্ষেত্রে কোনো গর্ভবতীর সিজারিয়ান ডেলিভারি করা অত্যাবশ্যক।

  • গর্ভে সন্তানের পজিশন ঠিকঠাক না থাকলে।
  • সময় হয়ে যাওয়ার পরও সন্তান প্রসবের কোনো অবস্থা দেখা না দিলে।
  • সন্তানের পা অথবা মাথা আকারে কিছু টা বড় হলে তা স্বাভাবিক ডেলিভারিতে প্রসব করা কষ্টসাধ্য বা অসম্ভব হলে।
  • শিশুর পা আগে বের হলে।
  • প্রসব পুরোপুরি সম্পন্ন না হলে, শিশু গর্ভাশয় থেকে বের হওয়ার পথে বাঁধা পেলে।
  • ডেলিভারির সময় শিশুর আগে শিশুর দেহে প্যাঁচানো নাড়ি আগে বের হয়ে আসলে।
  • শিশুর হৃৎস্পন্দন, নাড়াচাড়া স্বাভাবিক না থাকলে।
  • একাধিক বা টুইন বেবি প্রসবকালে।
  • প্লাসেন্টা প্রিভিয়া থাকলে। পড়ুন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া সম্পর্কে। 
  • গর্ভবতীর অন্য কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা থাকলে।
  • আগেও সিজারের মাধ্যমে ডেলভিভারি করে থাকলে।

সর্বোপরি, মা ও শিশুর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা গেলেই সিজার করা প্রয়োজন। তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। 


কীভাবে সিজার করা হয়?


কীভাবে সিজার করা হয়?

এই চিকিৎসার শুরুর পূর্বে প্রসূতির একটি কাজ করতে হয়। সেটি হলো চিকিৎসা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে গোপনাঙ্গের লোম শেইভ না করা। যদি লোম খুব বড় হয় অপারেশন থিয়েটারে নিযুক্ত কর্মী তলপেটের লোম ট্রিম করে দিবে।

এখন আসি চিকিৎসার পদ্ধতির কথায়, যেভাবে প্রক্রিয়াটি শেষ করা হয় :

পূর্বে বলেছি এই পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়া করতে হয়। কাটাছেঁড়ার কোনো কষ্ট যেন গর্ভবতী টের না পায় তার জন্য শুরুতেই প্রসূতিকে এনেস্থিসিয়া বা চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে রাখা হয়।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি এড়াতে আগে থেকেই রক্ত পরীক্ষা করে রাখা হয় যাতে পরবর্তী তে রক্ত জোগাড় করা সহজ হয়। 

অজ্ঞান করে রাখার পূর্বে প্রসূতিকে খাবার খেতে বারণ করা হয় পেট পরিষ্কার রাখতে। যাতে করে সহজেই শিশুকে বের করা যায়। প্রসূতির প্রস্রাব নিষ্কাশনের জন্য ক্যাথেটার নল যুক্ত করে দেওয়া হয় মূত্রনালীর সাথে। 

পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারপর অজ্ঞান করার মেডিসিন / ইঞ্জেকশন পুশ করে কর্তব্যরত ডাক্তার। 

অজ্ঞান করার কিছুক্ষণের মধ্যে তলপেটে কয়েক ইঞ্চি গভীরতা রেখে তলপেটের সেই অংশের চামড়া কাটা হয় সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে। পেটের চামড়া ভেদ করার পর জরায়ুর উপরের অংশও কাটা হয়। এভাবে দুই স্তর ভেদ করে অবশেষে শিশুর দেখা পাওয়া যায় এবং তখন শিশুকে বের করে আনা হয়।

শিশুকে বের করে শিশুর নাকমুখ পরিষ্কার করে নাড়ি কেটে তাকে আলাদা করে। অতঃপর সেলাই করে কাটাস্থান সংযুক্ত করা হয়। 

৪০-৬০ মিনিটের এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার পর অপারেশন সম্পন্ন হয়।


সিজার প্রকিয়ার পর মা'য়ের জন্য যা করতে হবে

চেতনানাশকের কারণে সিজারিয়ান নারী অজ্ঞান অবস্থায় থাকে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে পানি, তরল খাবার খাওয়াতে হবে। খেতে না চাইলে না নিজে খেতে না পারলে তাকে সহযোগিতা করতে হবে খাওয়াতে। 

বিছানা ছেড়ে উঠতে সক্ষম হলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে নিলে ভালো হয়।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। 

উক্ত অবস্থায় সিজারিয়ানকে ২ থেকে ৩ দিন হাসপাতালে থাকা লাগতে পারে। হাসপাতাল ত্যাগ করার উপযোগী হলে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক বাড়িতে সেবা নিতে এবং মা ও শিশুর করণীয় মেনে চলতে হবে।

কাটাস্থান, ক্ষত শুকাতে ও পুরোপুরি সুস্থ হতে এক মাস কিংবা দেড় মাস লাগে। তারপর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরা যাবে।


সিজারিয়ান ও নরমাল ডেলিভারির পার্থক্য ( সুবিধা ও অসুবিধা) 

নিঃসন্দেহে নরমাল ডেলিভারি সবচেয়ে নিরাপদ। এতে শিশুর মানসিক বিকাশ, বেড়ে ওঠা স্বাভাবিকভাবে হতে পারে। প্রসূতির কোনো সংক্রমণ ও ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। পরবর্তী তে আবার গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে তা উপকারী হয়।

আর সিজারিয়ান ডেলিভারিতে বুঝতেই পারছেন কাটাছেঁড়ার কারণে বিভিন্ন ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবণা রয়েছে। পরবর্তী গর্ভধারণের সময় জরায়ুর জন্য ক্ষতিকর। ক্ষতের জন্য জরায়ুর স্বাভাবিকতা বজায় থাকা কঠিন হয়ে যেতে পারে।

তাতে মা ও শিশুর মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবণা হতে পারে। 

কাটারর ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে গর্ভবতীর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। সুস্থ হতে অনেকদিন সময় লাগে।

একটি বিদেশি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিজারের মাধ্যমে হওয়া শিশুর মানসিক বিকাশ স্বাভাবিকভাবে হয় না। নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের তুলনায় সিজাররিয়ান শিশুদের মেধা কম থাকে। এমনটা হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, পেটে শিশুর ব্রেইন সঠিকভাবে গঠন হওয়ার আগেই সিজারের মাধ্যমে তাকে বের করে আনা।

তবে, সিজারের সবচেয়ে ভালো দিক হলো এই পদ্ধতিতে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই নিরাপদ। এবং প্লাসেন্টা প্রিভিয়া রোধ করা যায়।


সিজারের ঝুঁকি কী কী?

যেহেতু একটি চিকিৎসা পদ্ধতি বা অপারেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সেহেতু এতে ভুক্তভোগীর জন্য কিছু ঝুঁকি ও সমস্যা দেখা দিতেই পারে।

যেসমস্ত ঝুঁকি দেখা দিতে পারে :

  • কাটাছেঁড়ার জন্য ইনফেকশনের পসিবিলিটি বেশি। কাটাস্থান শুকাতে দেরি হওয়া, সেলাই ফেটে যাওয়া, ব্যথা, রক্তপাত, ঘা হওয়া।

  • শিশুর অক্সিজেন স্বল্পতা, শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়ে থাকে।
  • নারীর মূত্রাশয় ও মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়া।
  • কাটার সময় ভুলবশত শিশুর গায়ে কোনো আঁচড় পড়লে শিশুর চামড়াও কেটে যেতে পারে।
  • সুস্থতা লাভ করতে অনেক সময় লাগে। সেই সময়ের মধ্যে অন্যান্য কোনো রোগেও আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। 
  • শিশুর মানসিক বিকাশ দেরিতে হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকতে পারে। 
  • পরের বার বাচ্চা নিলে এবং প্রসবের সময় গর্ভাশয় অথবা জরায়ু ফেটে যেতে পারে যা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। 
  • পরবর্তী প্রসবে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।


এই ব্যাপারগুলো যে সবার মধ্যেই দেখা দিবে এমনটা নয়। সবার শারীরিক অবস্থা তো একরকম নয়। তবে এটা দেখা গিয়েছে যে উক্ত সমস্যা গুলো বেশিরভাগ সিজারিয়ান নারীদেরই হয়েছে।


পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব কি?

হ্যা, সিজারিয়ান নারীরা পরের বার নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবেন। এবং বেশিরভাগেরই কোনো সমস্যা হয় না তখন।

তবে এক্ষেত্রে আগে ডাক্তারের ( যার কাছে প্রথমবার সিজার করা হয়েছে) সাথে কথা বলে নিতে হবে।


আমাদের কথা,

নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত। এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ এবং ঝুঁকিমুক্ত। যদি কোনো গর্ভবতীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা ও বিরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে দেরি না করে মা এবং শিশুর প্রাণ বাঁচাতে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url