আদার কতগুলো গুণাগুণ
সুগন্ধি, স্বাদ, রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও আদার অনেক গুণাগুণ রয়েছে। আদাকে বলা হয় ইমিউনিটি বুস্টার। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় সকল মানুষ জানে আদা একটি রান্নার উপকরণ, মশলা। এর যে আরও ব্যবহার রয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা খুব কমসংখ্যক মানুষেরই আছে।
আদার কতগুলো গুণাগুণ, আদা খাওয়ার উপকার কী, কীভাবে আদা ব্যবহার করলে কার্যকরী হবে এসব আলোচনায় করা হবে।
আদার যত গুণাগুণ
জ্ঞানী গুণীদের একটি কথা আছে যে, খাবারকে ঔষধ বানাতে হবে। কিন্তু সব খাবারেই ঔষধি গুণ কি থাকে? থাকে না। আদায় রয়েছে এই গুণ।
আদা তে থাকে পানি, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, মিনারেল, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, এনজাইম, অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট, ভিটামিন-বি, আঁশ, প্রদাহ প্রতিরোধী সহ চারশো এরও বেশি ভেষজ গুণ। এসব গুণের জন্য আদা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী।
দীর্ঘকালীন অসুস্থতা বা ক্রনিক ডিজিজ, কোষের ক্ষতি, বিভিন্ন প্রদাহ, বমি হওয়া ইত্যাদি স্বাস্থ্য অবস্থা নিরাময়ে আদা অনেক উপকারী।
আদার গুণাগুণের কথা শুধু মানুষই নয়, বিজ্ঞানীদের সাহায্যে একাধিক পরীক্ষায় ও গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ শুধু আদাকে রান্নার উপকরণ হিসেবেই জানে। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায় আদাকে তখন ব্যবহার করা হতো মূলত ঔষধি উপাদান হিসেবে।
ঘ্রাণ, স্বাদের বৈশিষ্ট্যের জন্য রান্নার কাজেও এর ব্যবহার করা হতো, যা তখন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্তও বহমান।
আদা খাওয়ার উপকার
এটা প্রচলিত আছে যে, ঠাণ্ডা লাগলে ও জ্বর হলে আদা চা খাওয়া অথবা আদা চিবিয়ে খাওয়া। এটা অনেক আগে থেকে এখনকার প্রজন্ম পর্যন্ত চলে আসছে।
শুধু এ-ই নয়, আদার আরও অনেক ব্যবহার ও উপকার রয়েছে। যেমন -
ঠাণ্ডা, সর্দিকাশিতে
আদা আসলেই ঠাণ্ডা, জ্বর, ফ্লু, সর্দিকাশির বিরুদ্ধে মোক্ষম কার্যকর। ঠাণ্ডা, সর্দি-জ্বর দ্রুত সারিয়ে তুলতে আদার কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত হয়েছে।
রক্ত জমাট বাঁধতে
আদাতে অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট ও এন্টিবায়োটিক উপাদান থাকায় তা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, অণুচক্রিকার সংখ্যা, শ্বেত রক্ত কণিকার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। ফলে শরীরে কোনো ক্ষত হলে,কেটে গেলে দ্রুত রক্ত জমাট বেঁধে ক্ষত, কাটা সারিয়ে তুলে তাড়াতাড়ি।
কানের ব্যথায়
কারও কানে যদি ইনফেকশনের জন্য ব্যথা হয়, তাহলে আদার রস দিলে ব্যথা প্রশমিত হয়।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে
রক্তচাপ ভয়ংকর একটি রোগ। এর কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো প্রাণনাশকারী রোগের সৃষ্টি হয়। তাই রক্তচাপকে নীরব ঘাতকও বলা হয়ে থাকে। এই রোগগুলো যাতে না বাসা বাঁধতে পারে, তার জন্য শর্ত হচ্ছে রক্তচাপ দমিয়ে রাখা, নিয়ন্ত্রিত রাখা। আদা এই কাজটি করতে পারে।
একটি রিসার্চে দেখা গিয়েছে, আদায় এমন কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে যা রক্তচাপ এর জন্য ব্যবহৃত ঔষধের মতোই সমান কার্যকর।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত রাখতে
হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী আরেকটি কারণ হচ্ছে রক্তে অধিক কোলেস্টেরল। শরীরের জন্য খারাপ কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে আদা কার্যকর।
ক্যান্সার প্রতিরোধে
আদাতে "জিঞ্জারোল" নামক এক শক্তিশালী উপাদান আছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণ সম্পন্ন। নিয়মিত আদা খেয়ে গেলে কোষের ক্ষতি রোধ হবে এবং বিভিন্ন ক্যান্সার সৃষ্টিতে দায়ী কোষ নির্মূল করা যাবে।
আদা উপকারী হতে পারে ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে।
আলঝেইমার প্রতিরোধে
মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক একটি রোগ। ভুলে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, শর্ট-টার্ম মেমোরি এসমস্ত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে আদার অ্যান্টি - অক্সিডেন্ট ও এন্টিবায়োটিক।
অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট এনজাইম বৃদ্ধি করতে, মানসিক চাপ, স্ট্রেস কমাতে আদা ও আদার সাপ্লিমেন্ট খুব ভালো ফলদায়ক।
শরীর থেকে বিষাক্ততা দূরীকরণে
শরীরে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি বেশি হয়ে গেলে তা রক্তকে দূষিত করে তুলে, কিডনিজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে। অ্যান্টি - অক্সিডেন্ট যুক্ত হওয়ায় আদা সেসব বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে বের করে দিতে কাজ করে।
হাড়ের গঠনে
মহিলাদের এস্ট্রোজেন হরমোনের বৃদ্ধিতে আদার প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। যা নারীদের হাড় ক্ষয়, বাত ব্যথা, অস্টিওআর্থ্রাইটিসের হাত থেকে সমাধান দিয়ে থাকে।
ওজন কমানোয়
অধিক ওজনের নারীদের উপর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যারা নিয়মিত আদা খেয়েছে, তারা রক্তের ইনসুলিন কমাতে সক্ষম হয়েছে। ইনসুলিন ওজন বাড়ায়। এই ইনসুলিনকে নিয়ন্ত্রিত রাখে আদার ভেষজ গুণ।
রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখায়
অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করতে ও রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে বের দিতে পারে। নিয়মিত আদা খেলে তাই রক্ত চলাচল ভালো থাকবে।
যৌন ক্ষমতা বাড়াতে
অ্যান্টি - অক্সিডেন্ট যে কতটা উপকারী তা হিসাবের বাইরে। এই উপাদানটি রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে বিধায় পুরুষদের যৌন স্বাস্থ্যও ভালো রাখতে আদা সাহায্য করে। বীর্য ও টেস্টোস্টেরন হরমোন বাড়াতে আদার অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট এর প্রভাব রয়েছে।
এজমা নিরাময়ে
ফুসফুসের অন্যতম একটি রোগ এজমা। ফুসফুসে বায়ু চলাচল বাঁধাপ্রাপ্ত হলে, এজমা থাকলে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়মিত আদা বিশেষ করে আদার রস গ্রহণ করে তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত সমস্যা নিরাময় হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
শুধু এসব গুণই নয়, রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও এটি কাজ করে। এতে যে এনজাইম ও অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট থাকে, তা কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কোষগুলোকে কর্মশক্তি জুগিয়ে থাকে। ফলে সহজেই কোনো রোগ আক্রমণ করতে পারে না।
রাগ, দুশ্চিন্তা, চাপ কমাতে
ম্যাঙ্গানিজ ও অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট রাগ, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ কমাতে দারুণ কার্যকর।
গলা পরিষ্কারে
এটা নিশ্চয় সবাই লক্ষ্য করেছেন। গলার আওয়াজে সমস্যা হলে গলা পরিষ্কার করতে গরম চা বিশেষ করে আদা চা খেতে দেখা যায় অনেককেই।
বমি বন্ধ করতে
আমি নিজে একাধিক বার অন্যদের উপর পরীক্ষা করেছি যারা গাড়িতে চড়লে বমি করে, তাদেরকে আদা খাওয়ার জন্য বলেছিলাম গাড়িতে চড়ে। এবং তারা এটার বেনিফিট পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞগণও বমি বন্ধ করতে আদা খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
এছাড়াও মাথাব্যথা, মেয়েদের পিরিয়ডের ব্যথা, পেটে গ্যাসের সমস্যা, হজমের সমস্যা, আমাশয় সহ পেটের বিভিন্ন অসুখের নিরাময়েও আদার অবদান থাকে।
কীভাবে আদা ব্যবহার করতে হবে?
আদা কেটে, কুচিকুচি করে, পাটায় বেটে, পিষে, জুস বানিয়ে যেকোনো ভাবেই ব্যবহার করা যায়।
আদা গরম পানিতে ( যেমনটা চায়ে করা হয়) কুচিকুচি করে দিয়েও খাওয়া যায়। আবার কাঁচা চিবিয়েও।
বেশি ফলাফল পেতে মধুর সাথেও খাওয়া যায়।
আদা খাওয়ার সীমাবদ্ধতা
অতি মাত্রায় ব্যবহার করলে তা কিছু সাময়িক অসুবিধার দেখা দিতে পারে।
পেট ফাঁপা হয়ে যাওয়া, বমি, অতিরিক্ত ঝাল লাগা, বুক জ্বালাপোড়া, অস্থিরতার মতো অসুবিধা দেখা দিতে অধিক পরিমাণে খেলে।
সীমিত মাত্রায় খেতে হবে, ব্যবহার করতে হবে। ৫ গ্রাম অথবা প্রতিদিন ১০০ মিলিগ্রাম পরিমাণকে নিরাপদ হিসেবে বলা হয়।
যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ও অন্য কোনো ঔষধ নিতে হচ্ছে, তারা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে আদা ব্যবহার করতে হবে।
ইতি টানছি
আদার গুণাগুণের জন্য আদা খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক। আগে থেকে এ সম্পর্কে জানা থাকলে এই আলোচনায় নিশ্চয় জানতে পেরেছেন। তাই ডায়েট চার্টে নিয়মিত আদা রাখুন, কাঁচাও খাওয়ার অভ্যাস করুন।