নবজাতক শিশুর যত্ন কীভাবে নিতে হবে (পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন)

নবজাতক শিশুর যত্ন



শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম দিন থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত সময়কে নবজাত কাল বলে। এই সময়টা নবজাতক শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়টার মধ্যে শিশুর নানা সমস্যা দেখা দেয়, অনেক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি প্রাণহানীর আশংকাও থাকে। তাই এই সময়টার মধ্যে শিশুকে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। 

নবজাতক শিশুর যত্ন কীভাবে নিতে হবে  আর যত্নে জন্য কী কী করবেন না তা এখানে তার পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন  বিস্তারিত বলা হলো।

নবজাতক শিশুর যত্ন নিতে যা যা করবেন

১) প্রথমতো শিশু জন্ম হওয়ার পর পরই মায়ের কোলে দিয়ে দিতে হবে। কোনো রকমের মিষ্টি পানীয়, গরুর দুধ, প্যাকেট জাত দুধ, মধু, তাল মিস্রি ভুলেও শিশুর  মুখে দেওয়া যাবে না।
 জন্ম হওয়ার ১ ঘন্টার মধ্যেই মায়ের বুকের শালদুধ পান করাতে হবে। শালদুধে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিবডি থাকে যা শিশুকে রোগজীবাণু থেকে প্রতিরোধ করে । শালদুধকে শিশুর জীবনের প্রথম টিকা বলা হয়। শিশুকে জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধই পান করাতে হবে। 

২) উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিশুর দ্রুত ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে আর বড় রকমের ক্ষতিও হতে পারে । তাই শিশুকে রাখার জায়গাটা যেনো উষ্ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, শিশুরা জন্মের আগে মাতৃ গর্ভে উষ্ণ অবস্থায় থাকে এই জন্য জন্মের সাথে সাথেই শিশুকে উষ্ণ পরিবেশে গরম ও নরম মোলায়েম কাপড়ে আবৃত রাখতে হবে। 

বাচ্চাকে অতিরিক্ত গরমে রাখবেন না, তাহলে ঘেমে যাবে, আর ঘেমে গিয়েও ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।

৩) বাচ্চা কখন প্রস্রাব পায়খানা করছে তা দেখে  সাথে সাথে বাচ্চার জামা পরিবর্তন করবেন। আবহাওয়া গরম নাকি ঠাণ্ডা তা বুঝে শিশুর জামা বাছাই করবেন।

৪) সঠিক ডায়াপার নির্বাচন করা নবজাতকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ । নবজাতক শিশুরা যেহেতু দুধ বা তরল খাবার খেয়ে থাকে, এই জন্য দিনে ৫ থেকে ৮ বারের মতো বাচ্চা ডায়াপারে টয়লেট করে দিতে পারে। আটসাঁট ভেজা, নোংরা ডায়াপার শিশুর জন্য বেশ ক্ষতিকর। এতে বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। 

তাছাড়া অপরিষ্কার ডায়াপার বাচ্চার ত্বকে ফুস্কুড়ি অথবা র‍্যাশের সমস্যা দেখা দিতে পারে তাই বাচ্চা কখন কখন ডায়াপারে টয়লেট করেছে তা দেখে সময় মতো বদলে দিন । ডায়াপার চেঞ্জ করার সময় খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার নরম কাপড় বা বেবি ওয়াইপস দিয়ে মুছবেন। 

৫) শিশুকে কমপক্ষে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট সূর্যের রোদে রাখবেন। এর অনেক উপকারিতা আছে। যেমন:  ভিটামিন " ডি " আছে সূর্যের আলোতে যা ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে ফলে হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুদ হয়৷ তা ছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, জন্ডিস হওয়ার প্রবণতা কমায়। 

৬) বাহির থেকে এসেই স্যানিটাইজ না করে বা সঠিকভাবে পরিছন্ন না হয়ে বাচ্চাকে স্পর্শ করবেন না। এতে বাহির থেকে আসা জীবাণু শিশুর শরীরে যেতে পারে। তাতে শিশুর রোগ জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। 

৭) জন্মের পর সাথে সাথেই শিশুকে গোসল করাবেন না। নাভী পরে না যাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুরে হালকা গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে দিবেন। ফলে বাচ্চার কোনো এলার্জি বা ইনফেকশন হবে না। কিন্তু নাভী পরে যাওয়ার পর থেকে গোসল করাতে পারবেন। 

৮) শিশুর জন্মের ১৫ দিনের আগ পর্যন্ত তেল, সাবান, শ্যাম্পু লাগানো উচিত না। শিশুর ত্বক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তুলনায় অনেক সেনসিটিভ আর নরম থাকে। তাই বলা যায় নাভী পরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বা ১৫ দিন শিশুকে তেল, শ্যাম্পু, সাবান লাগাবেন না।

বাচ্চা জন্ম হওয়ার ১৫ দিন পরে বিশেষ করে ঝাঁঝালো তেল মোট কথা সরিষার তেল ভুলেও লাগাবেন না। কারণ এই তেলের  ঘনত্ব ও পুরুত্ব বেশি,  যার জন্য গায়ে ময়লা জমে আর র‍্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ও সংক্রামক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

যদি তেল, সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করতেই হয় তাহলে ১ থেকে দেড় মাস পরে করলে ভালো। 

৯) নবজাতক শিশুকে সময় মতো দুধ খেতে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পরপর  মোট ৮ থেকে ১২ বার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো উচিত। ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধই খাওয়াতে হবে। যদি বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব না হয় সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে হবে। ফর্মুলা দুধ খাওয়ার পরে যদি শিশুর পেটে সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

১০) নবজাতক শিশু যখন দুধ টেনে খায় , মুখ দিয়ে তখন কিছুটা বাতাসও গিলে ফেলে । তারপর এই বাতাসের কারণে শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি হয়। এতে পেটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ হয়, ফলে শিশু কান্না করতে থাকে,  মুখ থেকে দুধ বের করে দেয় বা বমি করে দেয়,  হাত-পা ছোটাছুটি করে ।

তাই শিশুদের প্রতিবার খাওয়ানোর পর তাদের বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে ঢেঁকুর তোলানো হলে অস্বস্তি কিছুটা কমে যায় । যাকে ইংরেজিতে 'বেবি বার্প' বলে। ঢেঁকুর তুলতে শিশুকে হাসানোর চেষ্টাও করা যায়। 

অথবা এর জন্য শিশুকে আস্তে আস্তে আপনার বুকের কাছে এক হাত দিয়ে ধরে রাখুন। তারপর শিশুর মাথা সোজা রেখে কোলে নিয়ে শিশুর মুখ নিজের কাঁধের ওপর রাখতে হবে। এক হাত দিয়ে শিশুর পিঠে হালকা আস্তে আস্তে টোকা দিতে হবে। শিশুকে আরও কিছুটা উপরে তুলে  তার পেট আপনার কাঁধের উপর রেখেও পিঠে হাত দিয়ে হালকা টোকা দিতে পারেন । ঢেঁকুর না আসা পর্যন্ত এটি বারবার করতে হতে হবে। 

তবে খেয়াল করতে হবে শিশুর মাথা ও ঘাড় আরেক হাত দিয়ে যেনো ভালো মতো সাপোর্ট দেওয়া থাকে। তা না হলে ঘাড়ে ব্যথা পাবে।

১১) দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর জিহ্বায় সাদা একটি স্তর পরতে দেখা যায়। এই স্তরকে বলা হয় "ওরাল থ্রাস"। যা " ক্যানডিডা অ্যালবিক্যানস” নামক একটি ফাঙ্গাস এর জন্য দায়ী। 

শিশুর জিহ্বা ঠিকমতন পরিষ্কার করানো হলে এই ওরাল থ্রাস হওয়ার সম্ভাবণা কমে যায়।

ওরাল থ্রাস ঠিক মতো পরিষ্কার না করলে শিশুদের জিহ্বাতে ঘা হয়ে যেতে পারে। তাই এটি থেকে নিস্তার পেতে পরিষ্কার নরম শুকনো কাপড় ব্যবহার করুন। আলতো করে  জিহ্বার উপর বৃত্তাকার ম্যাসাজ করুন, একই ভাবে মাড়িও মুছে নিন,  সপ্তাহে একদিন করে এই প্রক্রিয়ায় মুছে দিন বাচ্চাটিকে।

১২) নবজাতক শিশুর ত্বক যেহেতু খুব নাজুক, তাই শিশুর সংস্পর্শে আসার আগে সাবান দিয়ে হাত ভালোমতো ধুয়ে নেবেন। তাতে রোগ জীবাণু বাসা বাঁধবে না সহজে। বাহির থেকে যারা যারা আসবে তাদের কেও সেই ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।

১৩) শিশুর কান নাক পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বাচ্চা ঘুমিয়ে গেলে পরিষ্কার কটন বাডস নিয়ে হালকা অলিভ অয়েল লাগিয়ে নিন তারপর বাচ্চার কান ও  নাক পরিষ্কার করুন। খেয়াল রাখবেন বেশি ভিতরে বাডস প্রবেশ করাবেন না। আস্তে আস্তে পরিষ্কার করবেন।

১৪) শিশুর নখ যে দ্রুত বড় হয় সেই ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। নখ দ্রুত বড় হয়ে যাওয়ায় নিজের নখে নিজেই বড় রকম আচড় লাগতে পারে। যেহেতু বাচ্চাদের ত্বক সেনসিটিভ সেহেতু আচড় লাগায় ঘা হয়ে যেতে পারে। তাই বাচ্চা ঘুমিয়ে গেলে নখ কেটে নিন, যেহেতু বাচ্চা ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া তেমন করবে না। যেহেতু বাচ্চাদের নখ নরম হয় তাই নখ কাটতেও অসুবিধা হবে না।



নবজাতক শিশুর যত্ন


বাচ্চার যত্নের জন্য যেসব ভুল করবেন না 

নবজাতকের যত্নের ব্যাপারে নানা ধরনের লোককথা  ও ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে কিছু কিছু কথা আসলেই কাজের আবার কিছু কথা ও ধারণা কুসংস্কার । কিছু কিছু কুসংস্কার অনেক অনেক বছর ধরে চলে আসছে। এইসব কুসংস্কারগুলো মেনে চলতে গিয়ে শিশুর ভালো তো হয় না উল্টো ভালোর বদলে খারাপটাই বেশিভাগ হয় । এই সব কুসংস্কার বেশিরভাগই বয়োজ্যেষ্ঠরা মেনে থাকেন, এবং তাদেরই পরামর্শে ভালোভাবে  না জেনেই অভিভাবকরা শিশুর জন্য ক্ষতি ডেকে আনেন । 

তাই জেনে নিন যত্নের নামে ভুলগুলো প্রচলিত সমাজে অভিভাবকরা শিশুদের জন্য করে থাকেন:

১) খেয়াল করলে দেখবেন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই সমাজের কিছু প্রচলিত নিয়মের কারণে প্রায় প্রতি বছর অসংখ্য নবজাতকের অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কমে না সহজে । শিশু জন্ম হওয়ার পরপরই শিশুকে গোসল করিয়ে ফেলা একদমই ঠিক না কিন্তু এটি আমাদের দেশের নিয়মিত দৃশ্য। 

কারণ জন্মের পরপরই নবজাতকের শরীরে এক ধরণের সাদা আবরণ দেখা যায়। সেটাকে অনেকেই নোংরা জিনিস ভেবে গোসল করিয়ে ধুয়ে দেন।  আবার কেউ লিকুইড প্যারাফিনেও মুছে ফেলেন। অথচ এটি নবজাতকের সুরক্ষা কবজ যা নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে , আর যেকোনো জীবাণুর সংক্রমণ হতে প্রতিরোধ করে।

ভুলেও এই কাজটা করবেন না। বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর পরই নরম উষ্ণ তোয়ালে বা কাপড় দিয়ে পেচিয়ে বাচ্চার মায়ের কোলে দিবেন।

২) অনেকের ধারণা বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর চিনির পানি অথবা মধু দিতে হয়। কিন্তু এটা পুরোপুরি ডাক্তাররা নিষেধ করেন। কারণ, তাতে বাচ্চার পেটের অসুখ হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। তাই জন্মের পরপরই বাচ্চাকে এসব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৩) জন্ম হওয়ার পরেই বাচ্চাকে কাপড়ে পেচিয়ে শক্ত করে ধরবেন না, তাতে শিশুর অস্বস্তি লাগতে পারে। নড়াচড়া করতে পারে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে এমনভাবে নরম কাপড় দিয়ে পেচিয়ে বাচ্চাকে কোলে নেবেন। 

৪) জন্মের পরেই বাচ্চার চোখে কাজল দেওয়া বা কাজলের ফোটা দেওয়া একদমই ঠিক না। 

কিন্তু কিছু অভিভাবক আছে যাদের ধারণা কাজল লাগিয়ে বা কপালে ফোটো দিলে বিভিন্ন মানুষের কুনজর থেকে শিশু রক্ষা পাবে যা একটি প্রচলিত কুসংস্কার। এতে বাচ্চার ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবণা থাকে। 

৫) অনেক অভিভাবকরা মনে করেন বাচ্চাকে ছাগলের দুধ খাওয়ালে বাচ্চা অনেক পুষ্টিগুণ পাবে। হ্যাঁ ছাগলের দুধে পুষ্টি অনেক। তবুও বাচ্চার ৬ মাস পার হওয়ার পরও বাচ্চাকে ছাগলের দুধ খাওয়াবেন না। পুরোপুরি ৯ মাস পার হওয়ার পর বাচ্চাকে ছাগলের দুধ খাওয়াতে পারেন। তার আগে ছাগলের দুধ খাওয়ালে শিশু তা হজম করতে পারবে না আর পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে।


উপসংহার 

এতক্ষণ আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি কীভাবে নবজাতক শিশুর যত্ন নেওয়া উচিত এবং কোন কাজগুলো উচিত নয়। শিশুরা পরিবারের প্রদীপ। শিশুর ক্ষতি কোনো মা-বাবাই চায় না। তাই শিশুর ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ করা থেকে মা-বাবা ও অন্যদেরকেও সতর্ক রাখতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url