পোস্টপার্টাম : মা ও সন্তানের জন্য বিপদজনক সময়

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন


পোস্টপার্টাম শব্দটার সাথে মানুষ আজকাল বেশ পরিচিত । সময়ের সাথে সাথে মা ও শিশুর যত্ন   এর ব্যাপারে মানুষ আরো সচেতন হচ্ছে। সাথে মা ও শিশুর মৃত্যুর হারও অনেকখানি কমে এসেছে।  

তো জেনে আসা যাক পোস্টপার্টম টা আসলে কী, কেন হয় সব খুঁটিনাটি। 


পোস্টপার্টাম

আসলে পোস্টপার্টাম কোনো রোগ নয়। শিশু জন্মের পরবর্তী সময় কে পোস্টপার্টাম বলে। 


পোস্টপার্টামের সময় সন্তান জন্মদানকারী মায়ের আচরণে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে,  যেমন : অকারণে মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বাচ্চাকে সহ্য করতে না পারা, সবকিছু বিরক্ত লাগা, অপরাধবোধ কাজ করা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ইত্যাদি নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। সেগুলোকে মানসিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  


সাধারণত সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পর থেকে সেক্স হরমোন এবং স্ট্রেস হরমোনের লেভেল নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে ওঠানামা করে, যার কারণে মস্তিষ্কের যে অংশ মানুষের অনুভূতি ও সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে , সে অংশে অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। তারপর উক্ত উপসর্গগুলো দেখা দেয়। 


অনেক ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার আগেই উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে পারে। 


রোগীর মানসিক অবস্থা, পরিস্থিতি, পরিবেশ, পারিবারিক সচেতনতা ও সহানুভূতি, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ইত্যাদি বিবেচনা করে একেকজনের অবস্থা একেক রকম হতেই পারে। কেউ কেউ সন্তান প্রসবের কিছুদিন পরেই সুস্থ হয়ে যায়। আবার কারো অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। 


তাই জেনে আসা যাক সন্তান প্রসবের পর মায়ের কী কী মানসিক সমস্যা হতে পারে। 


পোস্টপার্টাম এ কী কী সমস্যা হয়ে থাকে? 


প্রথম স্টেজ : পোস্ট পার্টাম ব্লু 

একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হচ্ছে  মাতৃত্ব। সন্তান জন্ম হওয়ার আগেই কত কিছু ভেবে রাখেন সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাটির জন্য। কিন্তু দেখা যায় সন্তান প্রসবের পর সবাই খুশি আনন্দে আত্মহারা বাচ্চাটির জন্য, অথচ বাচ্চার মা খুশি না, কেন?


সন্তান জন্ম হওয়ার প্রায় কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের মন খারাপ থাকতে পারে। সহজ ভাষায় একে 'পোস্টমার্টাম ব্লু' বলে। 

প্রসবের পরপরই প্রায় শতকরা ৮৫ শতাংশ নারী এই সমস্যায় ভুগেন । প্রসব জনিত সমস্যা ও শারীরিক যন্ত্রণা, তার উপর হরমোনের পরিবর্তন, সবকিছুর হঠাৎ পরিবর্তন আবার শিশু দেখাশোনার বাড়তি দায়িত্ব সব মিলে মায়ের উপর যে বিশাল ধকল যায় সেটাই মূলত মানসিক সমস্যার মূল কারণ। 


জেনে নিন পোস্ট পার্টাম ব্লু এর কিছু লক্ষণ :


১) অস্থির বা উদ্বিগ্ন বোধ করা।


২) অল্পতেই অধৈর্য্য হয়ে উঠা এবং কুরুচিপূর্ণ আচরণ করা।


৩)  অকারণেই কান্না পায়।


৪) মন মনে অনুভব হয় "আমি যেনো আমার মধ্যে নেই"


৫) কোনো কাজে মন না বসা, অন্যমনস্ক হয়ে থাকা।


৬) দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন। যেমন : অকারণে রেগে যাওয়া , এই মন খারাপ আবার এই হঠাৎ মন ভালো।


৭) সন্তানের প্রতি মনোযোগী না হওয়া। 


৮) নিজেকে বঞ্চিত আর অবহেলিত মনে করা। 


৯) অযথা বিরক্তিবোধ করা।


এই সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন একটা ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ে না । পরিবারের সদস্যদের সহয়তা পেলে ২ সপ্তাহের মধ্যেই মা স্বাভাবিক হয়ে উঠেন। তবে যদি দুই সপ্তাহের পরেও এই সমস্যা থেকে থাকে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ।

 

দ্বিতীয় স্টেজ : পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন 

এই স্টেজের ডিপ্রেশন প্রাথমিকভাবে পোস্টপার্টাম ব্লু এর মতো মনে হলেও এটা অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও মায়ের জন্য কষ্টদায়ক। অত্যাধিক মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন। সাধারণত শিশু জন্ম দেওয়ার ১ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে বা এক বছর পর্যন্ত যে কোনো সময়ের  মধ্যেই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা দেয়।


এই সময় সবাই সদ্যোজাত শিশুকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাই মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ তেমন  গুরুত্ব দেয় না। তারপর দেখা যায়, মায়ের মানসিক রোগটি গুরুতর আকার ধারণ করছে, ফলে দেখা যায় দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।


এই রোগে আক্রান্ত মা নিজেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে আর নিজের মৃত্যু কামনা করে। এমনকি বাচ্চাকে মেরে ফেলার কথাও চিন্তা করে তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে। 


তাহলে জেনে নিন পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে লক্ষণ গুলো :


১) ঘুম কম হওয়া, আবার সকালে সময় মতো ঘুম থেকে উঠতে না পারা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া।


২) ক্ষুধামন্দা, খাওয়ায় অরুচি। 


৩) কোনো কিছুতে আগ্রহ না পাওয়া, কিছুতেই মন ভালো হয় না, সারাদিন মন খারাপ থাকে।


৪) নিজের সদ্যোজাত সন্তানের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া।


৫) সব কিছুর আশা ছেড়ে দেওয়া। সদ্যোজাত নবজাতকের মা মনে করেন যে তাকে দিয়ে কিছুই হবে না, সে ভালো মা না। 


৬) সদ্যোজাত সন্তানের মা মনে করেন তার সব শেষ। তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। 


৭) একা থাকতে ভয় পায়।


৮) সদ্যোজাত বাচ্চাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করা।


৯) অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা আর কান্না করা।


তীব্র হতাশা ও অবসাদে আক্রান্ত মা নিজেকে অথবা সন্তানকেও আঘাত করতে পারেন এমনকি মেরেও ফেলতে দ্বিধা করবেন না । তাই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি  করবেন না। তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।



তৃতীয় স্টেজ : পোস্টপার্টাম সাইকোসিস 

প্রথম দুই স্টেজ এর চাইতে এই সমস্যাটি আরও বেশি গুরুতর। চিকিৎসকদের মতে এই ডিপ্রেশন অন্যসব ডিপ্রেশনের চাইতে অনেক গুরুতর ও বেদনাদায়ক। এই ডিপ্রেশন মাকে দুর্বল করে তোলে, তখন  মায়ের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি একটি গুরুতর মানসিক রোগ যার জন্য চিকিৎসা, ও মায়ের প্রতি বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয় । অথচ আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে কেউ জানতেই চায় না। 


মায়ের অবস্থা খারাপ দেখেও আমাদের দেশের কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি নাক ছিটকায়,  তারা মনে করেন এইগুলো ন্যাকামো, আদিখ্যেতা, জ্বিনের আছর, মায়ের চিকিৎসা তো দূর উল্টো মায়ের দোষ বের করতে থাকে যার কারণে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। সাথে কিছু লক্ষণ আছে তা জেনে নিন। 


এই স্টেজে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে তা হলো :

  

১) খুব বিভ্রান্তবোধ করা।  


২) ভ্রান্ত বিশ্বাস (যেমন অকারণে সন্দেহ)।


৩) হ্যালুসিনেশন (অদৃশ্য ব্যক্তিদের কথা শোনা, গন্ধ পাওয়া ও দেখা )।


৪) অস্বাভাবিক আচরণ ও কথাবার্তা। 


৫) ভয় ভয় থাকা। 


৬) অকারণে হাসা এবং বিড়বিড় করে কথা বলা।


 এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। শুরুর দিক থেকে মায়ের পর্যাপ্ত যত্ন নিলে এতো গুরুতর হতো না। তবে নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায় তবে তা একটু সময় সাপেক্ষ ।


পোস্টপার্টামে আক্রান্ত মায়ের যত্নে পরিবারের সদস্যদের করণীয় 


ইতি মধ্যেই আপনারা পোস্ট পার্টামের স্টেজ গুলো এবং এর ভয়াবহ দিক ও লক্ষণ সম্পর্কে জেনে এসেছেন। 

সন্তান প্রসবের পরে  হঠাৎ সব কিছু পরিবর্তন, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা এবং বাচ্চা লালন পালনের দায়িত্বের চাপ পড়ে মায়ের উপর। এই সময় পরিবারের সদস্যদের সহায়তা নিয়ে মায়ের মানসিক জটিলতা কমানো যায়।

১) সাধারণ মন খারাপ বা মুড সুইং ভেবে এড়িয়ে চললে হবে না, তাতে মা ও শিশুর জীবন হুমকির মধ্যে পরতে পারে। এই সময় তার মেন্টালি সাপোর্ট দরকার।  

২) মায়ের শরীর ও মন কেমন আছে, তার কোনো কিছু দরকার কি-না, কী কী লাগবে তা আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করতে ভুলবেন না।

৩) ঘরের কিছু ভারী কাজ কমিয়ে দেওয়া। যেমন : কাপড় কাচা, ঘর মোছা, রান্না করা থেকে কিছুদিন বিরত রাখবেন। যদি কিছুদিন বিশ্রাম নিতে পারে তাহলে সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।

৪) যদি আপনি কাছের মানুষ বা কোনো আত্মীয় হয়ে থাকেন তাহলে বাসায় আসার সময় বাচ্চা আর বাচ্চার  মায়ের জন্য চকোলেট বা পছন্দের জিনিস গিফট করতে পারেন। অথবা ছোট একটা চিরকুট দিতে পারেন তাতেই মায়ের মন ভালো করতে যথেষ্ট।


মায়ের সাথে যা যা করবেন  না

১) কখনো অন্য নারীদের সাথে তার তুলনা করবেন না। তাতে মা বিভ্রান্ত হবে আর নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগবে।

২) বাচ্চা লালন পালনের ব্যাপারে বার বার খুঁত ধরবেন না।  তাতে  মন খারাপ হওয়ার সম্ভাবণা বেশি।

৩) বাচ্চাকে পেয়ে বাচ্চার মাকে ভুলে যাবেন না।

৪) বাচ্চার মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করবেন না। এই সময়টা খুবই স্পর্শকাতর, আপনি যা-ই বলুন না কেন সে আবেগ দিয়ে ভাববে। আপনার কথা টা পছন্দ না হলে সে কখনোই ভুলবে না।

৫) বাচ্চার মায়ের শারীরিক মানসিক অসুস্থতার ব্যপারে অবহেলা করা যাবে না।

৬) যদি বাচ্চার মায়ের প্রসবের পরবর্তী সময়ের সাথে উপরোক্ত স্টেজ গুলোর মিল পেয়ে থাকেন তাহলে চুপ করে থাকবেন না।


উপসংহারে 

পোস্টপার্টাম মূলত একধরণের মানসিক অবস্থা যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর কিছুসংখ্যক নারীদের মাঝে দেখা যায়। এ নিয়ে চিন্তা নয়, ভয় নয়, প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের যত্ন বা কেয়ারিং এর মাধ্যমেই মা ও সন্তানের জন্য বিপদজনক এই সময়টি কাটিয়ে তোলা যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url