চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা
চিনি আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারের মধ্যে একটি অংশ। ছোট থেকে বড় এমন কোনো মানুষ নেই যে চিনির উপর নির্ভরশীল না। সকালে চায়ের চুমুক, বিকেলে আড্ডার মধ্যেও মিষ্টি জাতীয় খাবারের আয়োজন, শুভ কাজে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করা, কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে চিনির উপস্থিত বিদ্যমান আছে। চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানেন কি? জেনে নিন।
চিনির উৎপাদন কীভাবে হয়?
অনেকেই হয়তো জানেন না চিনির রাসায়নিক নাম কী। চিনির রাসায়নিক নাম হচ্ছে "সুক্রোজ"। এক অণু গ্লুকোজের সঙ্গে এক অণু ফ্রুক্টোজ মিশে এক অণু সুক্রোজ তৈরি হয়।
আর হ্যা, চিনির রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে C12H22O11 ।
কিন্তু চিনি তৈরির মূল উৎস কী? তা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আখের কথা। তবে আখ ছাড়াও চিনি মূলত তৈরি হয় সুগার বিট থেকে।
সুগার বিট হচ্ছে একধরণের গোলাকার সুক্রোজ জাতের উদ্ভিদ যা মাটির নিচে হয়।
এটি অনেকটা মূলার মতো দেখতে । উৎপাদিত মোট চিনি আসে ৫৫% সুগারবিট থেকে। বাকি টা আসে ৪৫% আখ থেকে।
চিনি দুই রকমের হয়। একটা হচ্ছে লাল চিনি, আরেকটা হচ্ছে সাদা চিনি।
মূলত আখের রসকে অথবা সুগারবিট কে আংশিকভাবে পরিশোধিত করে একে এক ধরণের সোনালী ক্রিস্টাল (স্বচ্ছ পদার) তৈরি করা হয়। এই সোনালী ক্রিস্টালকেই বলা হয় লাল চিনি। তাছাড়া গুড়ের উপস্থিতির কারণেও লাল চিনি গুলো মিষ্টি স্বাদযুক্ত একটি সুক্রোজ চিনিতে পরিণত হয়ে থাকে ।
পরবর্তীতে একে শোধনাগারে নিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে লাল চিনি কে সাদা চিনে তে রুপান্তরিত করা হয় ।
চিনির উপকারিতা
দ্রুত শক্তি বাড়ায় :
যখন শরীরে শক্তির ঘাটতি হয় অথবা রক্তচাপ কমে আসে, তখন চিনি দিয়ে বানানো শরবত বা স্যালাইন খেয়ে নিবেন । চিনি দেহে প্রবেশ করে গ্লুকোজ রূপান্তরিত হয় তারপর শক্তি উৎপাদন করে। চিনি নিম্ন রক্তচাপকে স্বাভাবিক হতে সহায়তা করে । যারা নিম্ন রক্তচাপে ভোগেন তাদেরকে সবসময় সঙ্গে চিনি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে মেজাজ ভালো রাখে :
এটা বলা আশ্চর্যের কিছু নয় যে চিনি আমাদের মন ভালো করে দিতে পারে, কেননা চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার আমাদের মস্তিষ্কে সুখের হরমোন অর্থাৎ ডোপামিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে , যার ফলে তাৎক্ষণিক ভাবে মেজাজ ফুরফুরে ও আনন্দময় লাগে । আপনার যখন মন খারাপ থাকবে তখন চিনি, মিছরি, চকলেট বা মিষ্টি কিছু খাওয়ার চেষ্টা করবেন, তাতে আপনার মেজাজ চট করে ভালো হয়ে যাবে এবং আপনার মন একটু হালকা অনুভব হবে ।
প্রাকৃতিক স্ক্রাব :
চিনির আশ্চর্যজনকভাবে স্বাস্থ্যের জন্য তেমন উপকারিতা নেই। তবে এটি ত্বকের জন্য বেশ উপকারী বলে বিবেচিত হয়। চিনিতে পাওয়া যায় এএইচএ অর্থাৎ আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড নামক একটি উপাদান, যাকে দুর্দান্ত এক্সফোলিয়েটর বলা যায় । এটি আপনার ত্বকের উপরের স্তরটির এক্সফোলিয়েট করতে, মৃত ত্বকের কোষগুলিকে দূর করতে সাহায্য করে এবং আপনার প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ফিরে আনতে সহায়তা করে।
কীভাবে করবেন এক্সফোলিয়েট ?
ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং মরা কোষ দূর করতে ২ টেবিল চামচ চিনি ও ১ টেবিল চামচ লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে হাত পা ও শরীরের অন্য অন্য অংশে ভালো করে ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন। তারপর ময়েশ্চারাইজার লাগাতে ভুলবেন না।
প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক :
চিনি কাটা ঘায়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। কারণ চিনির মধ্যে থাকা সুক্রোজ নামক উপাদান কাটা ঘা ঠিক করতে সহায়তা করে । তাই যখন কোথাও কেটে যাবে সেখানে চিনির প্রলেপ লাগিয়ে দিবেন। দ্রুত কাটা ঘা সেরে যাবে।
ফুল তাজা রাখতে চিনি :
একটি বোতলে ৩ টেবিল চামচ চিনি এবং ২ টেবিল চামচ ভিনেগার মিশিয়ে নিন । এরপর ফুলের ওপর তা ছিটিয়ে দিন। এখানে চিনি ফুলকে সতেজ রাখবে এবং ভিনেগার ফুলের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করবে ।
কাপড়ের দাগ দূর করতে :
অনেক সময় অসাবধানতার জন্য কাপড়ে কালির দাগ কিংবা খেলাধুলার সময় মাটির দাগ লেগে যায়। যা শুধু ডিটারজেন্ট দিয়ে সহজে উঠানো যায় না। এ ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণের গরম পানির মধ্যে একটু বেশি চিনি ভালো করে মিশিয়ে নিন। এরপর দাগের কাপড় গুলোকে সেই চিনি মিশ্রিত পানিতে ১ ঘণ্টার জন্য ভিজিয়ে রাখুন । তারপর ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন কাপড়ের দাগ দূর হয়ে গেছে ।
চিনির উপকারিতা সম্পর্কে তো জানলেন।প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চিনি খেলে শরীরে কী কী সমস্যা হতে পারে আর চিনির অপকারিতা কী কী তা জেনে নিন।
চিনির অপকারিতা
ওজন বেড়ে যাওয়া :
অতিরিক্ত চিনি ও চিনি জাতীয় খাবার খেলে দ্রুত ওজন বাড়তে থাকে । এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় । তা ছাড়াও ওবেসিটি বা অতি স্থুলতা , উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবণা বেশি থাকে।
ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া :
অতিরিক্ত চিনি লেপটিন নামক হরমোনের কাজকে বাঁধাগ্রস্ত করে, আর এই লেপটিনই আমাদের ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই অতিরিক্ত চিনি খেলে ক্ষুধা বাড়তেই থাকে।
কিডনির রোগ বাড়াতে সাহায্য করে :
অতিরিক্ত চিনি বিশেষ করে কোমল পানীয়, চা, ও শরবত অতিরিক্ত পান করলে কিডনির জন্য তা ক্ষতিকর। অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার অপুষ্টির কারণও হতে পারে। কারণ অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা থেকে ধীরে ধীরে চিনির প্রতি আসক্তি জন্মে যায়। ফলে এই আসক্তির জন্য অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে অনীহা চলে আসে । এতে করে পুষ্টিহীনতার সম্মুখীন হতে হয়। এইভাবে চলতে চলতে সময়ের সাথে সাথে, এটি কিডনি রোগ এবং কিডনি বিকল হওয়ার কারণ হতে পারে নিঃসন্দেহে।
লিভার নষ্ট করে :
মাত্রাতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাসে লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে । কারণ অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাস লিভারকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে অতিরিক্ত কাজের জন্য লিভারের ক্রিয়াকলাপে জটিলতা তৈরি হয়।
প্যানক্রিয়েটিক বা অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার:
অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের সম্ভাবণা বেড়ে যায়।
চিনি খান সীমিত, ব্যবহার করুন সীমিত। চিনির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন হয়েই এই মিষ্টি উপাদানটি গ্রহণ করুন।
উপসংহার
অবশ্যই চিনি নিত্য প্রয়োজনীয় একটি খাবার। চিনি ছাড়া একদিনও চলে না। চিনি খাওয়া কোনো সমস্যা না, কিন্তু অতিরিক্ত খাওয়া সমস্যা হয়ে যায়। তাই চিনি গ্রহণে সীমিত হোন।